ঢাকা ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্বিমুখিতায় যত ক্ষতি

মুফতি শাহাদাত হোসাইন
দ্বিমুখিতায় যত ক্ষতি

কথায় ভাত-কাপড়, কথায় চড়-থাপ্পড়। বহুল প্রচলিত একটি গ্রাম্য প্রবাদ। অর্থাৎ যার কথায় সততা আছে, সে তার কথার জন্য পুরস্কৃত হয়। বাহবা পায়। সমাজের মানুষের প্রশংসা কুড়ায়। অন্যদিকে যার কথায় সততা নেই, বরং শঠতা আছে। সে তার শঠতা ও দ্বিমুখিতার কারণে জনেজনে ধীকৃত হয়। অর্জন করে ঘৃণা, অপমান ও লাঞ্ছনা। দু’মুখো মানুষ দ্বিমুখিতাসুলভ প্রতারণার কারণে আল্লাহতায়ালা ও নবী (সা.)-এর অপ্রিয় পাত্রে পরিণত হয়।

দ্বিমুখিতা কী

দ্বিমুখিতা বা দ্বিচারিতা বলতে বোঝায়, একমুখে দুই কথা বলা বা স্বার্থের টানে একই ব্যক্তির ব্যক্তিভেদে নিজের ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা আচরণ প্রকাশ করা। এমন আচরণ ও স্বভাবে হীন ফায়দা হলেও তা ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে, যা সুবোধ ব্যক্তি ও প্রকৃত মানুষের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। যে ব্যক্তি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য একজনের সঙ্গে একরকম কথা বলে এবং অন্যজনের সঙ্গে অন্যরকম কথা বলে হাদিসে তাকে নিকৃষ্ট মানুষ বলা হয়েছে। হাদিসে এসেছে, নিকৃষ্ট সে ব্যক্তি যে দু’মুখো কথা বলে। (বোখারি : ৭১৭৯)।

দ্বিমুখীর ক্ষতি

সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যারা তাদের দ্বিমুখী কথার দ্বারা অন্যকে সমস্যায় ফেলেন এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেন। এরা ঘৃণিত পাপিষ্ঠ। এমন ব্যক্তিকে সমাজের লোকেরা ভালোবাসেন না। ভালো চোখে দেখেন না। আল্লাহ ও তাঁর নবী (সা.) ও এমন লোককে পছন্দ করেন না। নবী (সা.) বলেছেন, মোমিন সহজ-সরল-ভদ্র হয়, আর পাপিষ্ঠ চতুরতাপূর্ণ ধোঁকাবাজ হয়। (সুনানু আবি দাউদ : ৪৭৯০)।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, তারা মুখে তোমাদের সন্তুষ্ট করে; কিন্তু তাদের অন্তরগুলো তা অস্বীকার করে। আর তাদের অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী। (সুরা তাওবাহ : ৮)।

দু’মুখো লোক লোভে পড়ে কিংবা নিছক ফ্যাসাদ সৃষ্টির জন্য এমন একটি নিকৃষ্ট কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। তখন সে আর সত্যের পক্ষে থাকতে পারে না। মিথ্যা তার স্বভাবে পরিণত হয়। এক সময় সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে ছিটকে পড়ে। কোরআনের ভাষায়, এরা দোদুল্যমান, এদিকেও নয়, সেদিকেও নয়। বরং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তাদের জন্য কোনো পথই পাবে না। (সুরা নিসা : ১৪৩)। এ স্বভাবের মানুষ তার দুমুখো আচরণ দ্বারা মূলত অন্যের ক্ষতি করতে চায়; কিন্তু সে নিজেই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করতে চাইবে আল্লাহ তারই ক্ষতি করবেন। (জামে তিরমিজি : ১৯৪০)। দ্বিমুখী ব্যক্তি তার দ্বিমুখিতার কারণে পরকালে কঠিন ভয়াবহতার সম্মুখীন হবে। ভোগ করবে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। রাসুল (সা.) বলেন, দুনিয়ায় যে ব্যক্তি দুমুখো ছিল কেয়ামতে সে আগুনের দুটি মুখ নিয়ে উত্থিত হবে। (তাবারানি : ৩৬০, আলমুজামুল আওসাত : ৬:২৩৪)।

দ্বিমুখীর পরকাল

দু’মুখো মানুষ মোনাফেক। রাসুল (সা.) বলেছেন, জবানের ভিন্নতা নেফাকি। (আত-তাকরিব : ১৯৫) নেফাকির পরিণাম ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই মোনাফেক জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। (নিসা : ১৪৫)।

জাহান্নাম হবে ঠিকানা

দুমুখো স্বভাবের মানুষের আখেরাত হবে কাফেরদের সঙ্গে। তারা জাহান্নামে কাফেরদের সঙ্গে থাকবে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লা হজাহান্নামে মোনাফেক ও কাফেরদের একত্রিত করবেন। (সুরা নিসা : ১৪০)।

দ্বিমুখী মোনাফেকদের কোনো ইবাদতই আল্লাহ কবুল করবেন না। রাসুল (সা.) বলেন, মোনাফেক নামাজ পড়ে; কিন্তু আল্লাহ নামাজের ব্যাপারে তাকে মিথ্যাবাদী বলেন। সে রোজা রাখে; কিন্তু আল্লাহ রোজার ব্যাপারেও তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেন। সে সদকা করে, তখনও আল্লাহ দানের ব্যাপারে তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেন, এমনকি সে জিহাদে অংশগ্রহণ করে জীবন দেয়, তারপরেও আল্লাহ তাকে মিথ্যাবাদী বলে অবহিত করেন এবং জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করেন। (আত-তাকরিব ১ : ১৫৯)।

দ্বিমুখী মোনাফেকের ওপর আল্লাহর লানত এবং তারা চিরস্থায়ী আজাবে থাকবে। যেমন আল্লাহ বলেন, আল্লাহ মোনাফেক নারী-পুরুষ ও কাফেরদের জন্য চিরস্থায়ী জাহাজান্নামের অঙ্গীকার করেছেনে। এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহর লানত তাদের প্রতি আর তাদের জন্য রয়েছে লাগাতার আজাব। (সুরা তাওবাহ : ৬৮)।

দ্বিমুখিতা পরিহারে করণীয়

দ্বিমুখিতা পরিহারে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে রাসুল (সা.) এর উত্তম চরিত্রের অনুসরণ ও চর্চাকে নিজের জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করা। কোরআন হাদিসের শিক্ষায় নিজেকে আলোকিত করা। অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দেয়া। ‘পারলে অন্যের উপকার করব; কিন্তু কখনও ক্ষতি করব না’- এ মানসিকতায় নিজের অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধতায় পরিপুষ্ট করা। অন্যের ক্ষতি নয়, বরং কল্যাণকামিতাই ধর্ম হাদিসের এ চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জীবন পরিচালনা করা। পরিশেষে. দ্বিমুখিতাজনিত অপরাধ বোধে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। তওবা করা। আল্লাহ ক্ষমাশীল। আল্লাহ ক্ষমাপ্রার্থী বান্দাকে ভালোবাসেন। দ্বিমুখী আচরণে মানুষ কষ্ট পায়। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। আর একজন প্রকৃত মোমিন বান্দা মানুষকে কষ্ট দিতে পারে না। কারণ, অন্যকে কষ্ট না দেওয়াই ঈমান ও ইসলামের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। এ ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) এর একটি হাদিস মনে রাখা যায়, রাসুল (সা.) বলেন, প্রকৃত মুসলমান সে, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। (মুসলিম : ৪০)।

লেখক : খতিব ও মুহাদ্দিস

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত