ঢাকা ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অতি চালাকের গলায় দড়ি

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
অতি চালাকের গলায় দড়ি

মোরগ ও কুকুরের ভাষা শিখতে পেরে যুবক যারপরনাই খুশি। হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি সে কৃতজ্ঞ। এই জ্ঞান আহরণের নগদ ফল সে পেয়েছে কুকুর ও মোরগের আলাপচারিতায় ঘোড়া ও গাধা মরে যাওয়ার আগাম সংবাদ পেয়ে। মোরগের বিরুদ্ধে কুকুরের অভিযোগ, তুমি একবার বলেছ, আগামীকাল বাড়িওয়ালার ঘোড়া মারা যাবে, মরা ঘোড়ার গোশত খাওয়ার উৎসব হবে। সে উৎসব হয়নি। পরদিন বলেছ, বাড়িওয়ালার গাধা মারা যাবে। তার গোশত খেতে পারব, তাও হয়নি। মোরগ বলল, আসলে ঘোড়া ও গাধা ঠিকই মারা গেছে। কিন্তু আগের দিনই বাড়িওয়ালা বিক্রি করায় মৃত্যুটা হয়েছে ওদের বাড়িতে যারা খরিদ করেছিল। আমাদের বাড়িওয়ালা চালাক কিনা, তাই বড় বড় লোকসান থেকে বেঁচে গেছেন। নচেৎ আমি মিথ্যা বলি না। সবসময় সত্য কথা জোর গলায় বলি। নামাজের সময় ঘোষণা করার দায়িত্ব পালন করি। মুয়াজ্জিনের কাজই আঞ্জাম দেই। মোরগ আরও বলল,

আসলে মা’রা’ হক পেয়ে বা’ঙ্গে নামাজ

দা’দ হাদয়ে আ’দমী রা’ দর জেহা’য

আমাদের স্বভাবে গচ্ছিত নামাজের ডাক

মানুষের জন্য আমরা আল্লাহর উপহার।

ব্যাপার ছিল, কুকুরের সঙ্গে মোরগের আলাপচারিতা শুনে মনিব জানতে পারে, কাল তার গোলামটি মারা যাবে। চালাকি করে সেদিনই গোলামটি দাসবাজারে বিক্রি করে দেয়। ফলে মনিবের বাড়িতে জেয়াফত হয়নি। এ কারণে কুকুর মোরগকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে। আত্মপক্ষ সমর্থন ও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য মোরগের হৃদয়গ্রাহী যুক্তি আমরা আগের সংখ্যায় সবিস্তারে শুনেছি। মওলানা বলেন, গোলাম ঠিকই মরেছে; তবে ক্রেতার ঘরে গিয়ে। বিক্রেতা মনিব চালাকি করে আর্থিক ক্ষতি থেকে বেঁচে গেছে; কিন্তু চিন্তা করলে বুঝা যাবে, মনিব নিজেই নিজের রক্তপাত ঘটিয়েছে। বিপদ এসেছিল, মালের ওপর যাচ্ছিল, চালাকি করাতে সে বিপদ তার জানের ওপর এসে পড়েছে। মওলানা রুমি বলেন, বাদশাহর রোষানলে পড়লে ধনমাল যা আছে, দিয়ে খালাস নিয়ে নাও। নচেৎ তোমার কল্লা যাবে। তুমি তকদিরের বিষয়ে অজ্ঞ, তাই আল্লাহর জন্য নিজের সম্পদ বিলিয়ে দিতে গড়িমসি করো। মোরগ কুকুরকে বলল, এবারের খেলাটা দেখবে মারাত্মক। আমাদের মনিব নিজেই মারা যাবেন আগামীকাল। তার ওয়ারিশরা ফাতেহা দিবে, গরু জবাই করবে, জেয়াফত হবে। গরুর অস্থিমাংস খেয়ে তুমি নাদুস নুদুস হবে।

মর্গে আসব উস্তুরো মর্গে গোলাম

বুদ কাযা গর্দানে আন মগরুরে খা’ম

ঘোড়ার মৃত্যু, খচ্চর ও গোলামের মরণ

ফিরিয়ে দিত এই দাম্ভিকের তকদির লিখন।

আমি প্রথমে বলেছিলাম যে, আমাদের মনিবের ঘোড়াটি কাল মারা যাবে। চালাকি করে তিনি সেদিনেই ঘোড়াটি বিক্রি করে দেন। ঘোড়াটি মারা গেলে মনিবের জীবনের ওপর যে বিপদ এসেছিল তার কাফফারা হয়ে যেত। বিপদ কেটে যেত। মোরগ ও কুকুরের কথার অর্থ বুঝতে পেরে তিনি এই চালাকি করেছেন। তারপর বিপদটি যেতে ছিল খচ্চরের ওপর দিয়ে। আমাদের কথার সূত্রে তিনি খচ্চরটিও বিক্রি করে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে গেছেন। যখন গোলামটি মারা যাওয়ার আগাম সংবাদ পেলেন, দাস বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিলেন। বিপদ ধনের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। চালাকি করে তিনি ধনরক্ষা করলেন। উচিত ছিল আল্লাহর রাস্তায় দানসদকা করে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া। কারণ, সদকা দ্বারা বালা মুসিবত দূর হয়ে যায়। এখন দেখ, ব্যাপার কোথায় গড়িয়েছে। কাল মনিব নিজে মারা যাবেন। তার আত্মীয়স্বজন তার জন্য কুলখানি দেবে। যত্রতত্র রুটি গোশত হাড় ছড়িয়ে থাকবে। তোমরা যত কুকুর আছ সবার জন্য উৎসব হবে। কারণ,

আয যিয়া’নে মা’ল ও দরদে আ’ন গুরীখত

মা’ল আফযূন কর্দো খোনে খীশ রীখত

মালের ক্ষতি ও তার বেদনা থেকে পালিয়েছে সে

মাল কামাই করেছে, তবে নিজেকেই খুন করেছে।

মাল হারানোর বেদনা তিনি সহ্য করতে পারেননি। মওলানা রুমি বলেন, জীবনে সিদ্ধি লাভ করতে হলে বেদনা সইতে হবে।

ইন রিয়াযতহা’য়ে দরভীশা’নচেরা’স্ত

কা’ন বলা’ বরতান বকা’য়ে জা’নহা’স্ত

দরবেশদের এত কৃচ্ছ্রসাধনার কারণ কী জান?

দেহের বালা মুসিবত হলো প্রাণের রক্ষাকবচ সম।

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, পরিশ্রম কর, ঘাম ঝরাও শরীর ভালো থাকবে। ইসলাম বলে, শরীরকে কষ্টের মধ্যে রাখ, কৃচ্ছ্রসাধনা কর, নামাজ পড়, রোজা রাখ, দান সদকা কর, তাহলে মন ও আত্মা ভালো থাকবে।

মুর্দনে তান দর রেয়াযত যিন্দেগীস্ত

রঞ্জে ইন তান রূহ রা’ পা’য়ান্দাগীস্ত

কৃচ্ছ্রসাধনায় দেহের মৃত্যুতে জীবন নিহিত

দেহের বেদনায় হয় রূহের স্থায়িত্ব নিশ্চিত।

দেহকে সুস্থ রাখার জন্য খাওয়া দাওয়ায় নানা বিধিনিষেধ আমরা মেনে চলি। কিন্তু রুহের পরিচর্যার জন্য দেহকে কৃচ্ছ্রসাধনার বাতিতে জ্বালানোর চিন্তা ক’জন করি? মওলানা বলেন, মোরগের কথাগুলো কান পেতে শুনছিল খবিস লোকটি। মোরগের মুখে তার নিজের মৃত্যুর কথা শুনে সে এখন দিশেহারা উন্মাদ। দৌড়ে হজরত মুসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর কাছে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মৃত্যুর ভয়ে চরম আতঙ্কে কম্পিত। মুসা (আ.) এর কাছে আরজ করল, হে আল্লাহর নবী! আমাকে বাঁচান। মুসা (আ.) বলে দিলেন, যাও এবার নিজেকে বিক্রি দিয়ে এসো। কারণ, তুমি তো লোকসান ঠেকানোর উস্তাদ, চালাকের ওপর চালাক। সব মুসলমানের ক্ষতি করে নিজের সম্পদ স্ফীত করেছ বহুগুণ। তোমার তকদিরের ফায়সালা আমার জানা ছিল, তাই পশুপাখির বুলি তোমাকে শিখাতে প্রথমে রাজি হইনি। বুদ্ধিমান শুরুতেই দেখে পথের শেষ গন্তব্য কোথায়। আর বোকারা পথের শেষ প্রান্তে গিয়ে বুঝতে পারে, ব্যাপার কী। লোকটি আবার অনুনয়-বিনয় শুরু করল, হে আল্লাহর নবী! নিশ্চয়ই আমি ভালো লোক নই। তাই এ অন্যায় কাজটি করে ফেলেছি। এখন আপনি আমাকে বাঁচান, আপনি আল্লাহর নবী, আল্লাহ আপনার কথা শুনবেন। আমি তওবা করছি। মুসা (আ.) বললেন, দেখ, তোমার ব্যাপারটি তিরন্দাজের হাত থেকে তির ছুটে যাওয়ার মতো। ধনুক থেকে বের হয়ে যাওয়া তীর আর ফিরে আসবে না। এটি আল্লাহর বিধানের বরখেলাফ। তোমার মৃত্যু এখন অবধারিত। আমি তোমার জন্য যেটুকু করতে পারি তা হলো, তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারি, যাতে ঈমান নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পার। দুনিয়া থেকে ঈমান নিয়ে বিদায় হওয়ার মধ্যেই প্রকৃত জীবন নিহিত। লোকটি যখনই বুঝতে পারল, তার বেঁচে থাকার আশা নেই। ভয়ে আতঙ্কে চরম অবস্থা শুরু হলো। বমি, অস্থিরতায় ছটফট করতে করতে শুরু হলো জানকান্দানী। লোকেরা এসে তাকে নিয়ে গেল অন্যত্র। শেষ রাতে মুসা (আ.) দু’হাত তুলে মোনাজাত করলেন আল্লাহর দরবারে। প্রভুহে তাকে মাফ করে দাও। সে বুঝেনি। গায়েবের রহস্য এমন লোকই শিখতে পারে, যে তা প্রকাশ করবে না, মুখ সামলে রাখবে।

আল্লাহ পাক মুসা (আ.) এর দোয়া কবুল করেন। বললেন, মুসা আমি তাকে ঈমান দিলাম, তুমি যদি চাও এখনই তাকে জিন্দা করে দেব। মুসা (আ.) বললেন, এই জগৎ তো থাকার জন্য নয়। যখন মরতেই হবে, তাকে সেই জগতেই জীবন দিও, যে জগৎ আলো আর আলোর। মওলানা এই কাহিনির উপসংহার টেনে বলেন,

তা’ বেদা’নী কে যিয়া’নে জেসমো ও মা’ল

সূদে জা’ন বা’শদ রেহা’নদ আয ওবা’ল

তুমি যাতে জান যে, দেহ ও মালের লোকসান

রুহের জন্য লাভজনক বিপদে আনে পরিত্রাণ।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প, ৩খ. বয়েত-৩২৬৬-৩৩৯৫) মসনবি শরিফের ওপর ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর নিয়মিত আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত