ঢাকা ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জিহ্বার পাপ বর্জন করি

শাহাদাত হোসাইন
জিহ্বার পাপ বর্জন করি

মানুষ যেসব অঙ্গ দ্বারা গোনাহের কাজে লিপ্ত হয়, আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, তার অন্যতম হলো জিহ্বা। জিহ্বা এমন একটি অঙ্গ, যার সঠিক ব্যবহারের দ্বারা মানুষ মহান আল্লাহর প্রিয় থেকে প্রিয়তম হতে পারে। আবার এর যথেচ্ছ ব্যবহারে মানুষ তার রবের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের কাছে হয় ঘৃণিত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, জিহ্বা অঙ্গটি অতি ছোট; কিন্তু এর ব্যবহারজনিত লাভ বা ক্ষতি অনেক বড়। জিহ্বার মাধ্যমে আল্লাহর জিকির করে বান্দা আল্লাহর খুব প্রিয় হতে পারে। আবার কুফরি বাক্য বলে ঈমানহারাও হতে পারে। জিহ্বার প্রয়োগে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয় মোমিন বান্দাকে। জিহ্বারও পাপ আছে। সে পাপ বর্জন করে চলা ঈমানের দাবি। কী বলছি? যা বলছি তাতে আমার পাপ হচ্ছে কিনা? কথা বলার আগে এ আত্মজিজ্ঞাসা মানুষকে তাসাউফের উচ্চ শিখরে উপনীত করে। দেহমন পবিত্র রাখতে জিহ্বার পবিত্রতা জরুরি। জিহ্বা দ্বারা ঘটিত পাপের একটি তালিকা পেশ করা হলো-

শিরক

আল্লাহর ব্যাপারে মানুষের কৃত সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো শিরক করা। শিরক যদিও কথা, কাজ ও বিশ্বাসের দ্বারাও হয়। তবে জিহ্বার দ্বারা যেটা হয় সেটাই মুখ্য। তাই শিরকের প্রধান বাহন হলো জিহ্বা। জিহ্বার মাধ্যমেই মানুষ এই বড় অপরাধটি করে থাকে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন লোকমান স্বীয় ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিলেন, হে ছেলে! শিরক কর না। নিশ্চয়ই শিরক বড় জুলুম। (সুরা লোকমান : ১৩)।

অন্য আয়াতে এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শিরককারীকে মাফ করবেন না। তা ছাড়া অন্য কোনো গোনাহ তিনি চাইলে মাফ করতে পারেন। যে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল, সে বড় আপবাদ আরোপ করলো। (সুরা নিসা : ৪৮)।

রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক গোনাহ থেকে বেঁচে থাক, সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সেগুলো কী? রাসুল বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা। জাদু করা। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। সুদ খাওয়া। এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা। যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা। সতী সাধ্বী নারীকে অপবাদ দেওয়া। (বোখারি : ২৭৬৬০)।

নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ। (তিরমিজি : ৩০২০)।

গিবত

কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চা করাকে গিবত বলে। ইসলামি শরিয়তে গিবত করা হারাম। অন্যের দোষ চর্চা করা, ত্রুটি অন্বেষণে পিছে লেগে থাকা, কোনো দোষ পেলে জনে জনে তা বলে বেড়ানো মারাত্মক গোনাহের কাজ। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। (বোখারি : ৬৮০১, মুসলিম : ১৭০৯)।

গিবত ব্যভিচারের থেকেও গুরুতর অপরাধ। গিবতের দ্বারা ব্যক্তির অধিকার নষ্ট হয়। তাই শুধু তওবা দ্বারা তা মাফ হয় না। গিবতকারীকে আল্লাহও ক্ষমা করেন না, যার গিবত করা হয়েছে, সে যদি ক্ষমা না করে। হাদিসে এসেছে, তোমরা গিবত থেকে বেঁচে থাক, কেননা গিবত জেনার থেকেও খারাপ। কারণ কোনো ব্যক্তি জেনা করে তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। কিন্তু গিবতকারীকে ততক্ষণ ক্ষমা করা হয় না, যতক্ষণ গিবতকৃত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করেন। (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি ৫ : ২২৯৮)।

গিবতের কারণে কবরের আজাব হয়। সাহাবি জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, একবার আমরা রাসুল (সা.) এর সঙ্গে কোথাও যাচ্ছিলাম, পথিমধ্যে দুটি কবর অতিক্রম করলাম, যার বাসিন্দাদের আজাব দেয়া হচ্ছিল। তাদের ব্যাপারে রাসুল বলেন, বড় কোনো অপরাধের কারণে তাদের আজাব দেয়া হচ্ছে না বরং তাদের একজন মানুষের গিবত করত। (মুসলিম : ২৯২)। গিবত ব্যক্তির নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়। তাই রাসুল (সা.) গিবত করতেও বারণ করেছেন, শুনতেও বারণ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) গিবত করতেও বারণ করেছেন শুনতেও বারণ করেছেন। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ৮:৯৪)।

গালমন্দ

মানুষের যেসব অভ্যাস বা স্বভাব নিন্দনীয়, তার একটি হলো গালমন্দ। গালিগালাজ করা কোনো ভদ্র ও মার্জিত লোকের স্বভাব হতে পারে না। মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ। রাসুল (সা.) কোনো মুসলমানকে গালি দিতে নিষেধ করেছেন। নবী (সা.) বলেন, হে মুয়াজ! আমি তোমাকে কোনো মুসলমানকে গালি দিতে নিষেধ করছি। (তাবরানি : ২০/১৫৯)।

রাসুল (সা.) পিতা-মাতাকে গালি প্রদানকারীর ওপর লানত-অভিশাপ করেছেন, তিনি বলেন, যে তার পিতা-মাতাকে গালি দেয় সে লানতপ্রাপ্ত, অভিশপ্ত। (মিযানুল ইতেদাল : ১/১০৬)।

মৃত ব্যক্তিকে গালি দেয়াও ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা মৃতকে গালি দিয়ো না। (বোখারি : ১৩৯৩)।

মিথ্যা বলা

সত্যবাদি আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মানুষের কাছে গ্রহণীয়। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকতে বলেছেন, হে ঈমানদাররা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক। (সুরা তওবা : ১১৯)। পক্ষান্তরে মিথ্যাবাদী মহান আল্লাহর কাছেও অপ্রিয় এবং মানুষের কাছেও অগ্রহণীয়। লোকমান (আ.) স্বীয় ছেলেকে বলেছিলেন, মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকো কেননা, তা পাখির গোশতের মতো লোভনীয়-রুচিকর। (ইয়াহিয়া লিল গাজালি : ৩/১৩৬)।

মিথ্যাবাদি লোক মোনাফেক, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে মিথ্যা বলে সে মোনাফেক। (আল-ইত্তেহাফ : ৭/৫২২)।

আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার জীবন, প্রকৃতপক্ষে বা ঠাট্টারছলে আল্লাহ কখনোই মিথ্যাকে হালাল করেননি। (সুনানে দারেমি : ২/২৯৯)।

নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন সত্য কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বোখারি : ৫৭৮৫)।

মিথ্যা সাক্ষ্য

একজন মুসলিম কখনোই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারেন না। কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে নিষেধ করেছেন, তোমরা মূর্তির নাপাক থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাক। (সুরা হজ্জ : ৩০)।

সুরা ফুরকানে ক্ষমাপ্রাপ্ত জান্নাতি লোকদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, আর যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। (সুরা ফুরকান : ৭২)। নবী (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের কবিরাহ গোনাহ সম্পর্কে জানাব না? আর তা হলো, মিথ্যা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। অন্য হাদিসে এসেছে নবী (সা.) বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার দুই পা ততক্ষণ পর্যন্ত সরবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করেন। (ইবনে মাজাহ : ২৩৭৩)।

সাহাবি আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিল, সে তার স্থান জাহান্নামে করে নিল। (আল মুসনাদ : ২/৫০৯)।

মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়। রাসুল (সা.) বলেন, যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিল, তার ওপর আল্লাহর লানত। (কানজুল উম্মাল : ১৭৬৭২)।

ওয়াদা খেলাফি

জিহ্বা দ্বারা মানুষ যেসব পাপে লিপ্ত হয়, তার একটি হলো ওয়াদা খেলাফি, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। বর্তমান সময়ে ওয়াদা খেলাফি মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে কৃত অঙ্গীকার ভেঙে দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল অঙ্গীকার ভঙ্গ করাকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। রাসুল (সা.) ওয়াদা খেলাফিকে মোনাফেকের চিহ্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওয়াদা খেলাফি শয়তানের কাজ। কোরআনে এসেছে, কেয়ামতে শয়তান তার অনুসারীদের বলবে, যখন বিচার শেষ হবে তখন শয়তান বলবে, আল্লাহতায়ালা তোমাদের সঙ্গে সত্য ওয়াদা করেছিলেন। আমিও তোমাদের সঙ্গে ওয়াদা করেছিলাম, এখন তা ভঙ্গ করলাম। (সুরা ইবরাহিম : ২২)।

আল্লাহ কখনোই তার কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। কোরআনে এসেছে, আল্লাহর ওয়াদা, তিনি কখনোই তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সুরা রুম : ৬)।

মোমিন যারা তারা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়। আল্লাহর রঙে রঙিন হয়। আর আল্লাহর গুণ হলো ওয়াদা ভঙ্গ না করা। তাই প্রকৃত মোমিন বান্দা কখনোই ওয়াদাহ ভঙ্গ করতে পারে না।

ঝগড়া করা

ইসলাম মানুষকে অন্যের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে উত্তম ব্যবহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। ঝগড়াটে স্বভাবের ব্যক্তির ব্যাপারে হাদিসে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। নবী (সা.) বলেন, অতিরিক্ত ঝগড়াটে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত। (বোখারি : ৭১৮৮, মুসলিম : ২৬৬৮)।

ব্যঙ্গ করা

কাউকে ব্যঙ্গ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। তা যে ধরনের ব্যঙ্গ-ই হোক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা আমাদের ব্যঙ্গ করতে নিষেধ করেছেন, তোমরা একে অপরকে দোষারোপ কর না এবং একে অপরকে মন্দ নামে (ব্যঙ্গ করে) ডেক না। (সুরা হুজুরাত : ১১)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত