জায়নামাজে দাকুকির মারেফত লাভ

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আধ্যাত্মিক সফরের এক পর্যায়ে দাকুকি এখন নামাজের মুসল্লায়। সাতজন স্বর্গীয় পুরুষের অনুরোধে তিনি তাদের ইমামতি করবেন। এ ঘটনার আগে মওলানা রুমি মসনবির অনুলেখক হুসসাম উদ্দিন সালাবির প্রশংসা করেছেন মনপ্রাণ উজাড় করে। প্রাত্যহিক জীবনে আমরাও পছন্দের মানুষ বা সৃষ্টজীবের প্রশংসা করি। কিন্তু সুরা ফাতেহায় যে বলা হয়েছে, ‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য’, এর হাকিকত কী? মওলানার পক্ষ থেকে হুসসাম উদ্দিন সালাবির প্রশংসা বা পছন্দের কারো জন্য আমাদের প্রশংসার সীমানা কী হওয়া চাই? মওলানা রুমি দাকুকির নামাজের মুসল্লায় এ ধরনের প্রশংসার ব্যাখ্যা পেয়ে যান।

দরতাহিয়্যাত ও সালামিস সালেহীন

মদহে জুমলাআম্বিয়া আমদ আজীন

আত্তাহিয়্যাত ও নেককারদের সালাম দানে

সব নবী-রাসুলের প্রশংসা শামিল আছে মিশ্রণে।

নামাজের হালতে বৈঠকে যখন আত্তাহিয়্যাতু পড়া হয় তখন আমরা দুটি বাক্য বলি। একটি বাক্য প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাম নিবেদন করে। আমরা বলি, ‘আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নবীয়ু ওয়ারাহমতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ’ অর্থাৎ হে নবী! আপনার প্রতি সালাম (আল্লাহর অফুরন্ত শান্তি) আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত নাজিল হোক।’ এর পরের বাক্যে অন্য নবী-রাসুলদের প্রতি সালাম জানিয়ে আমরা বলি না ‘আসসালামু আলাল আন্বিয়া’ ‘সব নবীগর প্রতি সালাম’; বরং আমরা বলি, আসসালামু আলাইনা ওয়াআলা ইবাদিল্লাহিস সালেহীন।’ ‘আমাদের প্রতিও আল্লাহর সব নেক বান্দার প্রতি সালাম শান্তি বর্ষিত হোক।’ এই সালামে সব নবী-রাসুল এবং আল্লাহর নেক বান্দারা সবাই শামিল, একাকার হয়ে যান।

এই যে সালাম প্রদান এবং তাতে মানুষের প্রশংসা মিশে আছে, তার হাকিকত কী? মওলানা রুমি বলেন, এই প্রশংসায় মাজাজের পেছনে হাকিকত বিরাজমান। তার মানে প্রকৃত প্রশংসা সেই মহামহিমের জন্য নিবেদিত, যার গুণাবলির ঝলক কোনো সৃষ্টির ওপর পতিত হলে আমরা তার প্রতি মুগ্ধ হই ও তার জন্য আমাদের প্রশংসাবাক্য উৎসর্গ করি। আসলে সৃষ্টির প্রশংসা করতে গিয়ে আমরা স্রষ্টারই প্রশংসা করি। কাজেই সৃষ্টির প্রশংসার মূলে স্রষ্টার প্রশংসার চেতনা মিশে থাকতে হবে। কারণ সত্যিকার প্রশংসাভাজন তিনি একজনই। এই চেতনাবাদ দিয়ে কারো প্রশংসা করা হলে তা হবে নির্জলা গোমরাহি। চেতনার আরো গভীরে গেলে দেখা যাবে যুগে যুগে নবী-রাসুলদের (আ.) আনীত ধর্মের মূল সুর একটিই। এখানেই আন্তঃধর্ম ঐক্যসূত্র ও অভিন্নতার সুর ধ্বনিত। মওলানা বলেন,

যাঁকে খোদ মামদূহ জুযয়্যকবীশনীস্ত

কীশ হাযিনরূয়জুযয়্যককীশ নীস্ত

কারণ, প্রশংসিত তিনি একজনের বেশি নন

নানা ধর্মও এদিক থেকে একটির বেশি নয়।

সব প্রশংসার একচ্ছত্র মালিক একজনই। যুগে যুগে তার পক্ষ থেকে প্রেরিত সব ধর্মের বাণীও একটিই। গবেষকদের মতে, মওলানা রুমি এখানে কোরআন মজিদের নিম্নোক্ত আয়াতের ভাবার্থ তুলে ধরেছেন।

‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দ্বীন, যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন নুহকে আর যা আমি ওহি করেছি আপনার প্রতি এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ করো না। আপনি মুশরিকদের যেদিকে আহ্বান করছেন তা তাদের কাছে দুর্বহ মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তার অভিমুখী হবে তাকে দ্বীনের দিকে পরিচালিত করেন। (সুরা শূরা : ১৩)।

ধর্মকর্ম ইবাদত বন্দেগির মূল সুর আল্লাহর প্রশংসা, তার সমীপে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করা। তাই নামাজে দাঁড়িয়ে প্রথম উচ্চারণ আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ অর্থাৎ সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক।’ কাজেই জীবনযাত্রার প্রতিটি বাঁকে আমাদের মনে একমাত্র আল্লাহর প্রশংসার চেতনা বিরাজমান থাকতে হবে। বুঝতে হবে যে,

দান কে হারমাদহী বে নূরে হক রওয়াদ

বরসূয়ার ও আশখাস আরিয়াত বুয়াদ

মনে রেখ, যে কোনো প্রশংসা মিশে যায় আল্লাহর নুরে

কোনো আকৃতি বা মানুষের বেলায় তা দেখ কৃত্রিমরূপে।

মওলানা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, প্রশংসার যিনি যোগ্য ও উপযুক্ত তিনি তো আল্লাহ। সব প্রশংসা একমাত্র তারই প্রাপ্য। কিন্তু মানুষ নিজের কল্পনা ও ধারণার পেছনে পড়ে গোমরাহ হয়ে যায়। সুন্দরের যিনি আঁধারতার কথা ভুলে যায়। তার পরিবর্তে যার ওপর সুন্দরের প্রতিফলন হয়েছে তার প্রশংসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে করে এই সৌন্দর্য সৃষ্টবস্তু বা ব্যক্তির নিজস্ব। এই চেতনা থেকে স্রষ্টার কথা ভুলে সৃষ্টির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। সেই প্রশংসা পূজা-অর্চনা পর্যন্ত গড়ায়। তখন মানুষ গোমরাহি, বিভ্রান্তির শিকার হয়, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কিছুর পূজায় সত্য ও সুন্দরের পথ হারায়।

মওলানা বুঝিয়ে বলেন, মানুষ বা কোনো সৃষ্টির মধ্যে যে সৌন্দর্যের উদ্ভাস দেখা যায়, তা তার নিজস্ব নয়। তার উদাহরণ আলো। আলো যদি দেয়ালের ওপর পতিত হয় তাতে আলোর সঙ্গে দেয়ালের কী সম্পর্ক? ছায়ার বিষয়টা চিন্তা কর, ছায়া যেমন খানিক পরে সরে যায়, তেমনি আলোও ফিরে যায় তার আধার সূর্য বা চন্দ্রের কাছে। কাজেই আলোর প্রতিফলনে উজ্জ্বল দেয়ালের প্রশংসায় আত্মভোলা না হয়ে তোমার উচিত আলোর উৎস চাঁদসূর্যের সন্ধান নেয়া।

বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করার জন্য আরেকটি উপমা:

য়া যে চাহী আকসেমাহী ওয়ানামুদ

সর বে চাহ দরকর্দ ও আন রা মীসতূদ

কিংবা চাঁদের ছবি ভেসে উঠলএকটি কুয়ায়

কুয়ার দিকে তাকিয়ে পঞ্চমুখ তার প্রশংসায়।

এক লোক জোসনা রাতে কুয়ার ভেতরে চাঁদের প্রতিফলন দেখে ভাবছে এই বুঝি আসল চাঁদ, কত সুন্দর তার রূপের বাহার। সে মূর্খ বিভ্রান্ত। কারণ আকাশের চাঁদের কথা ভুলে সে কুয়ার চাঁদকে ভাবছে রূপের খনি আসল চাঁদ। আরো গভীরে গেলে সে বুঝতে পারত চাঁদের রূপও নিজের নয়, এসেছে সূর্য থেকে আর সূর্য কিরণ পেয়েছে আরশের মালিকের কাছ থেকে। বস্তুত কেউ যদি ব্যক্তি বা বস্তুর মাঝে প্রতিফলিত সৌন্দর্যের উদ্ভাসকে বস্তু বা ব্যক্তির নিজস্ব ও মৌলিক বলে মনে করে আর সৌন্দর্যের আসল মালিকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তা হবে নির্ঘাত গোমরাহি। এরাই শেষে কাফের মুশরিক হয়ে যায়। কারণ কী?

কায শাকাওয়াতগশত গুমরাহ অন দলীর

মাহ বে বালা বূদ ও উ পিন্দাশতযীর

অবাধ্যতায় গোমরাহ হলো সেই দূরাচারী

চাঁদ ছিল আকাশে সে ভাবল নিচে বুঝি।

যে চাঁদের বাহ্যিক রূপদেখে মুগ্ধ হলো, রূপের উৎসকে ভুলে রইল সে অবাধ্য, ইন্দ্রিয়ের পূজারি। আকাশের বুকে দেদীপ্যমান চাঁদ দেখল না; নিচে কুয়ায় টলমলে চাঁদের রূপ দেখে মনের অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। মওলানা দেয়ালের গায়ে আলোর কিরণ আর কুয়ার পানিতে চাঁদের প্রতিফলনের উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, সৃষ্টিজগতের সর্বত্র যত সুন্দর, পূর্ণতা, গুণাবলির সমারোহ দেখা যায় তা আসল মালিকের রূপ, গুণ তার সিফাত ও ৯৯ নামের জলওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এই উদ্ভাস দেখে আসলের খোঁজ করাই যুক্তির দাবি। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে মানুষ দুনিয়ার ভোগবিলাস, অর্থবিত্ত, কৃত্রিম সুন্দরের পেছনে জীবন উজাড় করে দেয়।

দুনিয়ার আকর্ষণের তুলনা সুন্দরী রূপসী বেগানা নারী। রূপসীদের মিছা প্রেমের ফাঁপরে পরে যেলোক জীবন-যৌবন উজাড় করে দেয়; সাময়িক কামনাবাসনা চরিতার্থ করার পর সে হতাশায় আক্রান্ত হয়। মওলানা বলেন,

চোন বেরান্দী শাহওয়াতীপররত বেরীখত

লঙ্গ গশতিওয়ান খেয়ালআয তো গুরীখত

যৌনতা কামনার পেছনে তুমি উজাড় করলে যৌবন

কল্পনা উধাও হলো তাই তুমি ল্যাংড়া বিধ্বস্ত এখন।

বিষয়টি স্বপ্নদোষে আক্রান্ত হওয়ার মতো। স্বপ্নে মানুষ কাল্পনিক শয়তানকে মনে করে বাস্তব রূপসী, ঘুম ভাঙলে বুঝে অবাস্তব কল্পনার সঙ্গে রাত কাটিয়ে এখন শরীর নাপাক, দুর্বল, মাথা ঘুরায়। যৌবনের ডানার শক্তি নাই, যার ওপর ভর করে জীবনের প্রকৃত উন্নতির পথে উড়াল দেয়া যায়। মওলানা বলেন, তোমার ডানা জোরদার রাখ। কামনাবাসনার পেছনে জীবন ক্ষয় করো না। ঊর্ধ্বলোকে বেহেশতের বাগানে ওড়ার শক্তি তোমার বাহুতে থাকতেই হবে।

পর নেগাহদার ও চুনীনশাহওয়াতমরান

তাপরে মেইলাতবরদ সূয়ে জানান

ডানা বাঁচাও যেয়ো না বেসামাল কামনার পেছনে

তোমার প্রেরণার ডানা যেন নিয়ে যায় জান্নাত কাননে।

ঊর্ধ্বলোকে সান্নিধ্যের প্রাান্তরে উড়াল দিতে হলে তোমার জোরদার ডানা থাকতে হবে। কামনাবাসনা, দুনিয়ার ভোগলিপ্সার পেছনে যদি জীবন যৌবন শেষ করে দাও, ডানার শক্তি কোথায় পাবে? পরম আরাধ্যকে পাওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত থাকতে হবে তোমার ধ্যানমন সারাক্ষণ। বিশেষত জায়নামাজে থাকতে হবে এর জাগ্রত অনুশীলন।

তত্ত্বজ্ঞানী দাকুকি এখন নামাজে ইমামতির মুসল্লায়। পেছনে সারিবদ্ধ সাতজন আল্লাহর ওলি। দাকুকি যখন আল্লাহু আকবর বলে নিয়ত বাঁধলেন মনে হলো পশু জবাই হওয়ার মতো সবাই কোরবান হয়ে এ জগৎ ছেড়ে চলে গেলেন।

চোনকে বাতাকবীরহামকরুন শুদন্দ

হামচো কুরবান আযজাহান বীরুন শুদন্দ

যখনই তারা তাকবির বলার সাথে একাকার হন

এই জগৎ ছেড়ে অন্য জগতে চলে যান বিলক্ষণ।

আল্লাহু আকবর তকবরি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ধ্যান-জ্ঞান যেন চলে গেল এ জগৎ ছেড়ে। জুনাইদ বাগদাদি (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের সারবস্তু আছে নামাজের সারবস্তু হলো, তকবীরেউলা তথা প্রথম তকবির।’ এর কারণ, নিয়ত হলো সব ইবাদতে প্রাণ। আর নিয়ত সাব্যস্ত হয় প্রথম তকবিরের সময়। তকবির বলার সময় মুসল্লির মনের অবস্থা কী হওয়া চাই সে বিষয়ে মওলানা রুমি (রহ.) বলেন,

মা‘নিয়েতকবীর ইন আস্তআইআমীম

কাই খোদাপীশে তোমা কুরবান শুদীম

তকবিরের অর্থ কী তা বলছি হে ইমাম

‘হে খোদা তোমার সম্মুখে কোরবান হলাম।’

প্রভু হে! আমি আল্লাহু আকবর বললাম। তার মানে আমি তোমার সামনে কোরবান হয়ে গেলাম। এই বয়েতের ব্যাখ্যায় খারেযামি বলেন, ‘আল্লাহু আকবর এর সঠিক মূল্যায়ন সেই লোকের পক্ষেই সম্ভব যে দিলের আয়না থেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর জং মুছে ফেলেছে। যে অন্ধকার জগতের বাসিন্দা নফসের আকর্ষণ ছিন্ন এবং নাপাকি-কলুষতার আখড়া মন্দস্বভাব ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।’

(মসনবি শরিফ ৩য় খণ্ড. বয়েত-২১২২-২১৪৩)

মসনবি শরিফের ওপর ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর

নিয়মিত আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন CHAYAPATH PROKASHONI