গোনাহ হৃদয়কে কলুষিত ও মনকে অস্থির করে

গোনাহ মানে ময়লা, যা সৌন্দর্যকে মলিন করে। গোনাহ হৃদয়কে কলুষিত করে। মনকে অস্থির করে তুলে। গোনাহের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মানুষ হয় অধিকার বঞ্চিত। পরকালে স্থান হয় জাহান্নামে। তাই গোনাহ বর্জন করে চলা মোমিনের জন্য অতি আবশ্যক বিষয়। কবিরা গোনাহ বর্জন ও নেক কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে বস্তুত একজন মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়। প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য চাই একটি স¦চ্ছ মন। গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-কে সন্তুষ্ট করার দৃঢ় মানসিকতা। গোনাহ বর্জন তাসাউফের একটি প্রাথমিক ধাপ। তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতার মূল ভিত্তিই হলো গোনাহ বর্জন করে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা হৃদয়ে সদা জাগ্রত রাখা। আর মুজাহাদার মাধ্যমে মন্দ গুণগুলো অন্তর থেকে দূর করে ভালো গুণের মাধ্যমে অন্তরকে সজ্জিত করা। হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, আমিত্ব, অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা, জীবে নির্দয়তা মন্দ গুণ। এগুলো হৃদয় থেকে দূর করার নিরন্তর প্রচেষ্টা তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতায় উৎকর্ষ সাধনের অন্যতম মাধ্যম।

গোনাহ বর্জনে সওয়াব

নেক কাজ করলে যেমন সওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি গোনাহের কাজ বর্জন করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। নামাজ-রোজা করলে যেমন আল্লাহতায়ালার নিকটবর্তী হওয়া যায়, তেমনি সুদণ্ডঘুষ, জুলুম, মিথ্যাচার, অন্যের অধিকার লুটে নেওয়া থেকে বিরত থাকার মাধ্যমেও নেকি অর্জিত হয়। জুলুম করার শক্তি-সামর্থ্য থাকার পরেও জুলুম না করা, জেনা-ব্যভিচার করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জেনা-ব্যভিচার থেকে বিরত থাকাটাই হলো সওয়াবের কাজ। প্রকৃত মোমিন বান্দা প্রকাশ্য ও গোপনীয় ছোট-বড় সব ধরনের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় গোনাহ বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন গোনাহ পরিহার কর। নিশ্চয়ই যারা পাপ করেছে তাদের শিগগির সেসব পাপের শাস্তি দেওয়া হবে। (সুরা আনআম : ১২০)।

কবিরা গোনাহ পরিচিতি

কবিরা গোনাহ মানে বড় গোনাহ। যে গোনাহের কারণে বান্দাকে শাস্তি পেতে হয়। জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হয় কিংবা দুনিয়ার জীবনে রাষ্ট্রীয় কোনো শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। যে গোনাহ করলে কোরআন ও হাদিসের কোনো বিধান লঙ্ঘিত হয় বা যা করা হলে কোনো ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এসব কাজকে ইসলামি শরিয়তে কবিরা গোনাহ বলে। কবিরা গোনাহ করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। কবিরা গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তাওবা কর। আশা করা যায়, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের পাপগুলো মোচন করে দেবেন।

(সুরা তাহরিম : ৮)।

১০টি বর্জনীয় কবিরা গোনাহ

সুদ : সুদদাতা, গ্রহীতা এবং সুদের কাজের সহযোগীরা যেমন সাক্ষী, দলিল লেখক সবাই কবিরা গোনাহে লিপ্ত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মোমিনরা! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার। (সুরা আলে ইমরান : ১৩০)। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী (সা.) সুদদাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদি কারবারের সাক্ষীদ্বয় ও লেখককে অভিশাপ দিয়েছেন। (নাসায়ি : ৫১০৪, তিরমিজি : ১১১৯)

অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা

অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ দখল করা। অন্যের হক মেরে দেওয়া কবিরা গোনাহ। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেন, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ কর না। এবং জনগণের সম্পদের কিছু অংশ জেনেশুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসন কর্তৃপক্ষের (বিচারকদের) হাতে তুলে দিয়ো না। (সুরা বাকারা : ১৮৮)।

মিথ্যা কথা বলা

মিথ্যা কথা বলা কবিরা গোনাহ। মিথ্যা কথা না বলা সওয়াবের কাজ। কথায় আছে, একটি মিথ্যা প্রতিষ্ঠিতি করতে ১০টি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। হাদিসে এসেছে, সত্যে মুক্তি আর মিথ্যায় ধ্বংস। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের জন্য সত্য আঁকড়ে ধরা অপরিহার্য। কেননা সত্য কল্যাণের পথ দেখায়। আর কল্যাণ পথ দেখায় জান্নাতের। যে লোক সর্বদা সত্য বলে এবং সত্য বলার প্রয়াসী হয়, এক পর্যায়ে আল্লাহর কাছে তার নাম অতি সত্যবাদী হিসেবে লিখিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে বিরত থাক। কেননা মিথ্যা পাপের পথ দেখায়। আর পাপ পথ দেখায় জাহান্নামের। যে লোক সর্বদা মিথ্যা বলে এবং মিথ্যা বলার প্রয়াসী হয়, এক পর্যায়ে আল্লাহর কাছে তার নাম অতি মিথ্যুক হিসেবে লিখিত হয়। (বোখারি : ৬০৯৪, মুসলিম : ২৬০৭)। মিথ্যা বললে আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করা হয়। আর মিথ্যা বর্জন করলে আল্লাহর আদেশ মানা হয়। মিথ্যা বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর। (সুরা হজ : ৩০)।

মদ পান

মদ অপবিত্র। মদ পান করা শয়তানি কাজ। আল্লাহর আদেশের অবাধ্যতা। কবিরা গোনাহ। আল্লাহতায়ালা মদকে অপবিত্র ঘোষণা করে বলেন, হে মোমিনরা! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদি ও জুয়ার তীর অপবিত্র, শয়তানি কাজ। সুতরাং তোমরা এসব পরিহার করে চল, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। (সুরা মায়েদা : ৯০)। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মদ হলো পাপের মূল এবং এটি কবিরা গোনাহ। যে ব্যক্তি মদ পান করল, সে তার মা, খালা বা ফুফুর সঙ্গে জেনা করার সমপর্যায়ের পাপ করল। (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ : ৫/৭০)।

পিতা-মাতার অবাধ্যতা

আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতা হয় না এমন সব কাজে পিতামাতার আদেশ মেনে চলা সন্তানের জন্য আবশ্যক। সন্তান পিতামাতার বাধ্য হওয়া সন্তানের সওয়াব ও সফলতা লাভের একটি শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। পিতামাতার বৈধ আদেশে সন্তানের অবাধ্যতা কবিরা গোনাহ। পিতামাতার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা কবিরা গোনাহ। বার্ধক্যে তাদের সেবা না করা, খোঁজ-খবর না রাখা কবিরা গোনাহ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণ করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কর না এবং পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। পিতামাতার কোনো একজন বা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না, বরং তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। (বনি ইসরাইল : ২৩)। পিতামাতার অবাধ্যতা কবিরা গোনাহ এ বিষয়টি হাদিসে স্পষ্ট শব্দে বর্ণিত হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল (সা.) কবিরা গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে উত্তরে বলেন, ‘ আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, মানুষ হত্যা করা ও মা-বাবার নাফরমানি করা।’ (বোখারি : ৫৫৫২)।

মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া

কোনো ঘটনাকে বাস্তবতার পরিপন্থি উপস্থাপন করাকে মিথ্যা সাক্ষ্য বলে। মিথ্যা সাক্ষ্য সমাজে নানান বিপর্যয় সৃষ্টি করে। মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে ন্যায্য অধিকার ও সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয় বিচারপ্রার্থী। দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য কিংবা প্রকৃত ঘটনা না জেনে অনুমানে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবিরা গোনাহ। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘ আমি কি তোমাদের জঘন্য কবিরা গোনাহ সম্পর্কে অবগত করব না? এর পর তিনি বললেন, (কবিরা গোনাহ হলো) ‘মিথ্যা কথা বলা অথবা বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’ (বোখারি : ৫৫৫২)।

পর্দা না করা

পর্দা না করা কবিরা গোনাহ। নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর আল্লাহতায়ালা পর্দা ফরজ করেছেন। পর্দা মেনে চলা নারী ও পুরুষের জন্য কল্যাণকর। পর্দা নারীর নিরাপত্তাকে দৃঢ় ও মজবুত করে। পুরুষকে বাঁচায় হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে। পর্দা শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও ফরজ। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দা জরুরি এ কথা বোঝাতে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুরা নুরে পাশাপাশি দুটি আয়াতে নারী ও পুরুষকে পৃথকভাবে সম্বোধন করেছেন। পুরুষদের পর্দার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’ (সুরা নুর : ৩০)। ঠিক এর পরের আয়াতেই আল্লাহতায়ালা নারীদের পর্দার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘মোমিন নারীদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। (সুরা নুর : ৩১)।

অন্যের ক্ষতি করা

অন্যের ক্ষতি করা বড় পাপ। কবিরা গোনাহ। একজন মোমিন বান্দা অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। অন্যের উপকার করার চেষ্টা করা ও ভালো কাজে একে অপরের সহযোগী হওয়া মোমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে। গোনাহ ও জুলুমের কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করে চল। নিশ্চয় আল্লাহর শাস্তি অতি কঠিন।’ (সুরা মায়েদা : ০২)।

গিবত বা অন্যের দোষচর্চা

অন্যের মন্দ গুণ বা কৃত মন্দ কাজ তার পেছনে বলে বেড়ানোকে গিবত বলে। এটা কবিরা গোনাহ। বর্জনীয়। গিবত খুবই মারাত্মক গোনাহ। গিবতকারী হাশরের মাঠে দুনিয়ায় যার গিবত করেছে তাকে তার কষ্টার্জিত নেক আমল দিয়ে দিতে হবে। এটা গিবতের চরম খেসারত। গিবত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কিছু ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো পেছনে গিবত (নিন্দা) না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? এটাকে তো তোমরা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর।’ (সুরা হুজুরাত : ১২)।

ধর্ষণ-জেনা-নারীর চরিত্র হরণ

নারীর চরিত্র হরণ করা কবিরা গোনাহ। বিয়ের সম্পর্ক ছাড়া কোনো নারীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করা মারাত্মক অপরাধ। কবিরা গোনাহ। এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। পরিণাম জাহান্নাম। জেনা না করাকে আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের গুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং জেনা করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গোনাহের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। (সুরা ফুরকান : ৬৮)।

লেখক : ইমাম ও খতিব, মসজিদণ্ডই বায়তুস সালাম

(পিয়াসসা সেন্টার জামে মসজিদ) পিয়েভে দি সলিগো, ত্রেভেজো, ইটালি