ঢাকা ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪১৩)

জীবন রহস্যের জানা-অজানা তথ্য

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
জীবন রহস্যের জানা-অজানা তথ্য

বিচার দিনের মালিক, কৃতকর্মের প্রতিফলদাতা মহান আল্লাহর কাছে একদিন মূসা (আ.) বললেন, প্রভু হে! এই যে বিশাল সৃষ্টিজগৎ, দৃষ্টিনন্দন এত আয়োজন, বিশ্ব প্রকৃতিকে সাজিয়েছ মানুষের জন্য, মানুষকে সৃষ্টি করেছ নারী ও পুরুষরূপে, আমার জিজ্ঞাসা, তুমি কেন সৃষ্টির পর আবার সবকিছু ধ্বংস করবে? একবার সাজানো আবার ভেঙে ফেলার খেলার মাঝে কী রহস্য লুক্কায়িত আছে? আল্লাহ বললেন, মূসা! আমি জানি তোমার এ প্রশ্নে আমার সৃষ্টিরহস্য অস্বীকার করা কিংবা অজ্ঞতা বা প্রবৃত্তির কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। এমনটি হলে অবশ্যই এমন প্রশ্নের জন্য আমি তোমাকে পাকড়াও করতাম।

লেকে মী খা’হী কে দর আফআ’লে মা’

বা’য জূয়ী হেকমত ও সিররে বাকা’

তবে তুমি জানতে চাও আমার এ সৃষ্টিলোকে

সবকিছু স্থিত চলমান, কী রহস্য আছে লুকে।

হে মূসা! আমার কার্যাবলির হেকমত, সৃষ্টিজগৎ চলমান থাকার রহস্য ও নিত্য নবসৃষ্টির অন্তর্নিহিত গূঢ়তত্ত্ব তুমি জানতে চাও। আমি জানি, তোমার এই চাওয়া নিজে জানার জন্য নয়, অন্যকে জানানোর জন্য। কারণ, এই প্রশ্নের জবাব তোমার জানা আছে। এরপরও এই প্রশ্ন উত্থাপন করছ, যাতে প্রশ্নোত্তরে আমার কার্যাবলির হেকমত পরিষ্কার হয়ে যায় মানুষের কাছে। মূসা যে আগে থেকে এই প্রশ্নের জবাব জানেন, তার প্রমাণ, ‘প্রশ্নই জ্ঞানের অর্ধেক’। যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে ওই বিষয়ের অর্ধেকটা তার জানা থাকে। আগে থেকে কিছু জানা না থাকলে কেউ কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে না। জীবন জগতে বিরাজিত সৃষ্টিরহস্য আল্লাহর নবী মূসা (আ.)-এর জানা আছে, তাই তিনি প্রশ্ন করতে পারছেন।

আরেকটি সত্য হলো, জ্ঞান থেকেই প্রশ্ন জাগে। আবার জ্ঞানের মাঝেই উত্তর থাকে। যেমন ফুল জন্মায় মাটি থেকে, পানির সহযোগে। আবার কাঁটারও জন্ম হয় মাটির পরশে, পানির সংযোগে। তাই তো মানুষের জ্ঞান যত গভীর হয়, তার প্রশ্নও তত গভীর, ব্যাপক অর্থবোধক হয়। আরো একটি বিষয় হলো, জ্ঞান থেকেই হেদায়ত লাভ করা যায়। আবার গোমরাহিও আসে জ্ঞান থেকে। দেখ, বৃষ্টির পানির দিকে। বৃষ্টির পানি সিঞ্চনে বাগানে প্রাণের প্রবাহ আসে, সুস্বাদু ফল, মন মাতানো ফুলের সমারোহ হয়। কাঁটার দঙ্গল আর তিতা ফলও; কিন্তু জন্মায় বৃষ্টির পানির পরিচর্যা পেয়ে। মসনবির ব্যাখ্যাকার বলে, যে জ্ঞানে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার জবাব আছে তা মানুষকে হেদায়ত ও সৎপথে পরিচালিত করে। মানুষ জীব অন্য জানোয়াররাও জীব। সকল জীবের জীবন আছে, আহার বিহার আছে, বংশবিস্তার করে। তাহলে মানুষ অন্য জীবজন্তু থেকে আলাদা কোথায়? মানুষ এখানে কোত্থেকে এসেছে, কী জন্য এসেছে, কোথায় যেতে হবে- এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব যে জ্ঞান চর্চায় নেই তা মানুষকে বিভ্রান্ত ও গোমরাহ করে। জ্ঞান থেকে হেদায়ত ও গোমরাহি একত্রে উৎসারিত হওয়ার স্বরূপ বুঝবর একটি উপমা, মানুষের সঙ্গে মানুষের কখন বন্ধুত্ব বা শত্রুতা হয়? নিশ্চয়ই পরস্পরের পরিচয় লাভের পর। আদৌ পরিচয় না থাকলে কীভাবে কারো সঙ্গে শত্রুতা বা বন্ধুত্ব হবে। ভালো খাবারের অবস্থাও তাই। পরিমাণ অনুযায়ী খেলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। নাক ডুবিয়ে খেলে একই খাবার স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়। যাইহোক অজ্ঞ মূর্খদের বুঝানোর জন্য মূসা (আ.) জানেন না এমন প্রেক্ষাপটে আল্লাহতায়ালা জবাবে বলেন,

মূসিয়া’ তোখমী বেকা’র আন্দর যমীন

তা’ তো খোদ হাম ওয়াদেহী ইনসাফে ইন

ওহে মূসা! কিছু দানা বপন কর মাটির ভেতর

তাতে পেয়ে যাবে দানার কাছে তোমার উত্তর।

আদিষ্ট হয়ে মূসা কিছু শষ্যদানা বপন করলেন মাটির ভেতর। সে দানা সুজলা-সুফলা হয়ে খেতে জৌলুস দেখাল। অল্পদিনে পাকা ধান-গম মাঠজুড়ে সোনালি আবির ছড়াল। মূসা (আ.) কাস্তে হাতে খেতে গেলেন। শষ্য কেটে ঘরে তুললেন, মাড়াই করে খড় থেকে ধানগম আলাদা করছেন- এমন সময় আসমান থেকে অহি আসল। কী হে মূসা! শষ্য যখন দানার আকৃতিতে ছিল, তখন জমিতে বপন করেছ, আর এখন পাকার পর কেন কেটে আনছ?

মূসা জবাব দিলেন, প্রভু হে! ধান-গম গোলায় তোলার জন্যই এই ফসল কাটা। আমি দেখতে চাই, দেখাতে চাই যে, ধানগাছ বা গমগাছের যে খড় আছে সে খড়ের সঙ্গে দানা আছে। খড়ের ভেতর দানা রেখে দেওয়া নিরাপদ নয়। আবার দানার গোলায় খড় রেখে দিলে সব সাবাড় হয়ে যাওয়ার ভয়। আমি খড় ও দানা আলাদা করতে চাই। তাই মাড়াই করার এই কসরত। জ্ঞান বুদ্ধির দাবিও তাই। উভয়ের মাঝে তফাৎ থাকা চাই। আল্লাহপাক জানতে চাইলেন, হে মূসা এই জ্ঞান তুমি কার কাছ থেকে পেয়েছ? দানা ও খড় একত্রে রাখা বিপজ্জনক এই বিদ্যা কীভাবে তোমার আয়ত্ত হলো? মূসা বলেন, প্রভু হে! এই পার্থক্যজ্ঞান তো তুমিই আমাকে শিখিয়েছ স্বভাবগতভাবে। আল্লাহ বলেন, ব্যাপার যদি তাই হয়, তাহলে আমি নিজে আমার সৃষ্টিতে কেন এই পার্থক্য, এমন তফাৎ করব না বল?

দর খলায়েক রূহহা’য়ে পাক হাস্ত

রূহহায়ে তীরেয়ে গেলনা’ক হাস্ত

সৃষ্টিরাজির মাঝে আছে বহু রূহ পবিত্র

আবার আছে বহু রূহ কলুষিত কাদা-মিশ্রিত।

আমার বিশাল সৃষ্টিলোকে বহু মানুষ আছে, তাদের প্রাণ আছে, প্রাণের সঙ্গে আত্মা আছে। কারো আত্মা পবিত্র, কলুষমুক্ত, স্বচ্ছ, কামনা বাসনার, জড়বস্তুর কদর্যতা হতে নির্মল। আবার কিছু আত্মা আছে, কামনা বাসনায় কলুষিত, হীনতা নিচতার রোগে আক্রান্ত। খনিতে দেখ অনেক মহামূল্যবান পাথর-রত্ন আছে। আবার সটান পাথরও আছে কর্কশ রুক্ষ কালচে। কিছুসংখ্যক মানুষের চরিত্র সুন্দর, নির্মল। আবার কিছুসংখ্যক মানুষের চরিত্র কদর্য পশুত্বনির্ভর।

ওয়াজেব আস্ত ইযহা’রে ইন নেক ও তবা’হ

হামচুনা’নকে এযহা’রে গন্দুমহা’ যে কা’হ

অবশ্যই ভালো ও মন্দের মধ্যে তফাৎ থাকতে হবে

খড় থেকে গম পৃথক করে নেয়া কর্তব্য যেমনিভাবে।

ধান-গম যেমন খড়কুটো থেকে পৃথক করা জরুরি, তেমনি মানুষের মধ্যে বিরাজিত ভালো ও মন্দের সত্তাও আলাদা হওয়া আবশ্যক। যাতে প্রত্যেকে নিজের কর্মফল প্রত্যক্ষ করে আর মনুষ্যত্বের হাকিকত উদ্ভাসিত ও সপ্রমাণিত হয়ে যায়। আল্লাহপাক নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদের মধ্যে কৃতকর্মে কে অধিক উত্তম তা তিনি পরীক্ষা করে দেখেন। আর তিনি পরাক্রমশালী ক্ষমাশীল।’ (সুরা মুলক : ২)। ওহে! তোমার অস্তিত্বে সততার যে রত্ন আছে তা লুকিয়ে গেছে মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার আচ্ছাদনে। অস্তিত্বের এই মিথ্যা প্রবঞ্চনা হচ্ছে তোমার দেহসত্তা, জৈবিকতা, যা খুবই ক্ষণভঙ্গুর। আর তোমার সত্য ও সততার রত্ন তোমার দেহসত্তার চাহিদা, জৈবিকতার পর্দায় ঢাকা। বছরের পর বছর তোমার অস্তিত্বের মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার দিকটিই প্রকাশিত ও উদ্ভাসিত হয়ে আছে। তোমার প্রাণের যে সারসত্য, সত্যিকার রুহানি অস্তিত্ব তা দৃশ্যত অস্তিত্বহীন, পশুত্বের উৎপাতে নেহাত তুচ্ছ নগণ্য। জৈবিকতার কবলে বিধ্বস্ত রুহানি সত্তাকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ তার বান্দাদের মাঝ থেকে রাসুল প্রেরণ করেন।

রাসুল (সা.) মানুষের দেহের মিথ্যা আবরণে ঝাঁকি দেন। তারপর ভেতরে লুক্কায়িত আসল মানুষটিকে উদ্ধার করেন। আসমানি শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে যাতে মানুষকে প্রশিক্ষিত করেন, মানুষের মিথ্যা ‘আমি’র পর্দা থেকে সত্যিকার ‘আমি’কে বের করে আনেন, সে জন্যই নবী রাসুলদের প্রেরণ করেছেন আল্লাহতায়ালা। রাসুল (সা.) এখন নেই, আর আসবেন না। রাসুলের নায়েবরাই সে কাজটি এখন আঞ্জাম দেন। যেসব বান্দা রাসুল (সা.)-এর বাণী মানুষের কানে পৌঁছায়, মানুষকে আল্লাহর পথে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা চালায় তারা রাসুল (সা.)-এর নায়েব, প্রতিনিধি। তাদের আহ্বান ওইসব লোকেরাই শ্রবণ করে, যারা মনের দিক থেকে অহির সন্ধানী হয়। মওলানা রুমি (রহ.) মিথ্যা ‘আমি’র পর্দার ভেতর থেকে সত্যিকার ‘আমি’কে বের করে আনার পথ বাতলে দিয়ে বলছেন, যে মোমেনের কান অহি শ্রবণ করতে আগ্রহী, তা অহির সত্যিকার বাহকদের মুখের বচন মন-প্রাণ দিয়ে শ্রবণ করতে আকুল থাকে। রাসুল (সা.)-এর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে আত্মার আকর্ষণ ও বন্ধন অনুভব করে। তাদের এই আগ্রহ ও আল্লাহর নেক বান্দাদের উপদেশ শোনার উদাহরণ, মায়ের কোলের মানব শিশুর শ্রবণ কথন।

শিশু মায়ের কথা শুনতে থাকে। তারপরেই সে কথা বলতে শেখে। যে শিশু আদৌ শুনে না, জন্ম থেকে বধির সে কথা বলতে পারে না। যে লোক কানে শোনে না, সেই কথা বলতে পারে না, বধির। কাজেই যারা আল্লাহর রাসুলের কথা বলেন, আল্লাহর দিকে ডাকেন, যাদের বুকের কথা ও মুখের ভাষা এক, কথা ও কাজে গড়মিল নেই, তাদের সাহচর্য অবলম্বন কর, তাদের কথা মনের কানে শোনো। তাদের নির্দেশনায় সাধনার পথে কঠোর পরিশ্রম কর। লাগাতার চেষ্টা চালাও। তবেই তুমি মিথ্যা ‘আমি’র পর্দা ছিন্ন করে তোমার আসল ‘আমি’কে বের করে আনতে পারবে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩০০১-৩০৪৫)।

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন।

CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত