মোমেনের আখলাক কেমন হওয়া উচিত?

আব্দুল মুমিন

প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কথা ও কাজের মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র প্রকাশ পায়। সুতরাং কথা ও কাজ শরিয়ত মোতাবেক হলে তখন তাকে ইসলামি আখলাক বা ধর্মীয় আচরণ বলা হয়। একজন মুসলমানের মূল বুনিয়াদ হলো ঈমান। কার ঈমান কেমন, কতটুকু? এ বিষয়ে আমাদের তেমন ভাবনা নেই। জ্ঞানও শূন্যের কোঠায়। এটা আমাদের শুধু নৈতিক পতন নয়, ধর্ম ও চেতনারও বিরাট অপূর্ণতা। ধারণাবশত কারো ঈমান বা আমল নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (১৭-৩৬)। যার ঈমান যত খাঁটি, আল্লাহর সঙ্গে তার সম্পর্ক তত গভীর ও সুদৃঢ়। ঈমান আনার পর আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো, সালাত আদায় করা। রমজান মাসে সিয়াম পালন করা। বিত্তশালী হলে হজ পালন করা এবং জাকাত প্রদান করা। এছাড়া ঈমানদার হিসেবে আমাদের ওপর রয়েছে শত শত দায়িত্ব। এক মুসলমানের আরেক মুসলমানের প্রতি প্রাথমিক কর্তব্য হলো, সাক্ষাতে সালাম দেওয়া ও হাসিমুখে সম্মানের সঙ্গে কথা বলা। মুখে হাসি টেনে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করা মুসলমানের আখলাক বা আচরণের একবারে শুরুর ধাপ। যে আগে সালাম দেয়, সে অহংকারমুক্ত। তাই বয়সে ছোট-বড় সবাইকে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। কেউ সালাম দিলে কোনোরকম দায়সারা বা আনমনা হয়ে সালামের উত্তর দেওয়া ঠিক নয়। আন্তরিকতার সঙ্গে মুখে মৃদু হাসি টেনে সালাম দিলে বা সালামের উত্তর দিলে পরস্পরে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। মনোমালিন্য দূর হয়। সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থকড়ি বিত্ত-বৈভবের তারতম্য করা উচিত নয়। অফিসের সাহেবরা সাধারণ কর্মচারীদের সালাম দেয় না। সাধারণ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন হিসেবে উপরস্থ কর্মকর্তাদের সালাম দেয়। উপরস্থ কর্মকর্তারাও দাম্ভিকতাবশত মাথা নাড়িয়ে অথবা হুহু করে উত্তর দেয়। এরূপ সালামের দ্বারা পরস্পর ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয় না। অন্ধ আভিজাত্যের নিচু মনের স্বভাব থেকে যায়। অথচ সালাম দেওয়ার জন্য কোনো প্রকার অর্থ-কড়ি, শক্তি-সামর্থ্যরে প্রয়োজন হয় না। শুধু আমাদের চেষ্টা, চিন্তা ও চেতনার অভাব।

ইসলামে আখলাকের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, সত্যবাদিতা। একজন অপরজনকে সালাম দেয়ার পর ভালো মন্দের খোঁজখবর নেয়া নৈতিক দায়িত্ব। প্রয়োজনে গল্পগুজব, কথাবার্তা বলা?। কথাবার্তার প্রাথমিক লক্ষণীয় বিষয়, সত্য বলা। মিথ্যা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা। রাসুল (সা.) মক্কা ও মদিনাসহ গোটা আরব বিশ্বে সত্যবাদী, বিশ্বাসী বা আল-আমিন নামে ভূষিত ছিলেন- আমানতদারি ও সততার বলেই। একবার জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে বললেন, মোমেন কি কখনো জ্বিনা করতে পারে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ পারে! শয়তানের কুমন্ত্রণায় করতে পারে। এমন অনেকগুলো গুনাহের কথা জিজ্ঞেস করাতে রাসুল (সা.) বলেছিলেন করতে পারে। কিন্তু রাসুল (সা.) কে যখন বলা হলো মোমেন কি কখনো মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বলেছিলেন, মোমেন কখনোই মিথ্যা বলতে পারে না! এর দ্বারা অনুমান করা যায়, ইসলামে আখলাক বা ইসলামি আচরণের ক্ষেত্রে সত্যবাদীতার মূল্যায়ন কত ঊর্ধ্বে!

ইসলামি আখলাকের তৃতীয় নম্বর বৈশিষ্ট্য হলো, আমানত রক্ষা করা?। শুধু একজনের ধন-সম্পদ অন্যজনের কাছে গচ্ছিত রাখার নাম আমানত নয়। পরস্পর কথা হলে অন্যেন কাছে সেটা প্রকাশের অনুমোদন না থাকলে সেটাও আমানত। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপতঙ্গ আমাদের কাছে আমানত। ইচ্ছে করে নিজেকে ক্ষতি করার অধিকার আমাদের নেই। এমন অনেক আমানত আমাদের কাছে গচ্ছিত আছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, মুনাফিকদের নিদর্শন তিনটি। তার মধ্যে একটি হলো আমানতের খেয়ানত করা। এ হাদিসে মূলত আমানতের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আখলাকের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো, ওয়াদা রক্ষা করা। ওয়াদা ভঙ্গের দ্বারা বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়। আর মুনাফিকের নিদর্শন হলো, মুনাফিক ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করা।

আখলাকের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো, প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি বিশেষ বিবেচনা করা। মানুষ আর পশুর মাঝে মূল পার্থক্য, মানুষের বিবেক আছে পশুর বিবেক নেই। যে নিজ স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে পারে, তার মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই বললেই চলে। মুসলমান হিসেবে বিবেচনার মন-মানসিকতা থাকা আবশ্যক। এমন অনেক ইসলামি আখলাক বা আচরণ রয়েছে, যেগুলো জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে লক্ষ্য করা জরুরি। মোটকথা, কথায়-কাজে ও সামাজিকতায় স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে ওঠে মানবিক হওয়া মুসলিম সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা ব্যক্তিকে সম্মানিত করে। সমাজকে কল্যাণের পথে এগিয়ে নেয়। জীবনকে করে ছন্দময়, অর্থবহ। তাই আমাদের উচিত, আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে সদা সচেষ্ট থাকা। মানবিকতায় এগিয়ে আসা। আর হিংস্রতা ও পশুত্বকে দিল থেকে দূরে সরিয়ে দিলকে শুদ্ধবিমল করে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করা। কেন না, সুখ জিনিসটা অনুভবের। যা দেখা যায় না। ছোঁয়া যায় না। আর প্রকৃত সুখ মনের সুখ। মন স্থির সব স্থির। মন পাক দেহ পাক। মন নাপাক দেহ নাপাক। আমাদের সবকিছু মনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়। তাই সবকিছুর আগে শরিয়া শাসিত একটি পবিত্র মন জরুরি। এটাই আখলাকের চূড়ান্ত পর্ব। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুক, আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া।