মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪১৬)

জাদুর বুড়ির স্বরূপ সন্ধানে

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এক দরবেশ দূর থেকে শুনেছিলেন বাদশাহর ছেলে জাদুগ্রস্ত হয়েছে। শাহজাদা ৯০ বছর বয়েসি এক বুড়ির প্রেমে পড়ে ধ্বংসের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। কাবুলীওয়ালী সেই বুড়ি নিজেই মস্ত জাদুকর। জাদুমন্ত্রে তার চেয়ে সেরা বুঝি কেউ নেই। কিন্তু এ সত্যটি ভুললে ভুল হবে যে, যতবড় জ্ঞানী হোক, তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী অবশ্যই আছে।

মানুষ যখন নিজেকে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী বা জ্ঞানী মনে করে, তখন তার মনে অহংকার বাসা বাঁধে। অহংকারের কারণে তার চিন্তায়, ব্যবহারে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। তাতে অন্য মানুষ তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পালিয়ে বেড়ায়। মানুষের ঘৃণার শিকার হয়ে ক্রমে তার জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়।

কাজেই মানতে হবে যে, তোমার হাতের ওপরে অন্য হাত আছে। ক্ষমতার ওপরে ক্ষমতাবান অবশ্যই আছে। নিজেকে নিরঙ্কুশ ভাবলেই বিপদ আছে। যদি ক্ষমতার ওপর ক্ষমতাবান কে আছে চিন্তা করো, তাহলে তোমার চিন্তা আরো ওপরে যাবে, শেষ সীমানায় পরম ক্ষমতাময় আল্লাহর পরিচয় পাবে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির ওপর আছে মহাজ্ঞানী।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত-৭৬)।

মুন্তাহা’য়ে দস্তহা’ দস্তে খোদাস্ত

বাহর বীশক মুন্তহা’য়ে সেইলহা’

হাতের পর হাত শেষ প্রান্তে আল্লাহর হাত

বন্যার পানি গড়ায় শেষপ্রান্তে যেখানে সাগর।

সাগরের উপমাটি সামনে আনলে তোমার বুঝতে সুবিধা হবে। আকাশে মেঘমালার ঘনঘটা দেখ, তা আসলে সাগর থেকেই সৃষ্টি হয়। নদীনালা, খালবিল হয়ে প্লাবনের যে পানি গড়িয়ে যায়, তা শেষ হয় সাগরে গিয়ে। সৃষ্টিজগতের সবকিছুর চূড়ান্ত পরিণতিতেও যিনি আছেন, তিনিই মহামহিম সত্তা। তার কাছেই সবকিছুর প্রত্যাবর্তন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাদশাহ জাদুকররূপী আল্লাহর অলিকে সাদরে বরণ করলেন রাজদরবারে। ছেলের দুর্দশার কাহিনি তুলে ধরে বললেন, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ আমার প্রাণের প্রাণ ছেলেকে বুঝি বাঁচানো যাবে না। কুটনী বুড়ির ফাঁদে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আল্লাহর অলি অভয় দিলেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি এসেছি এই সংবাদ পেয়েই। জাদুবিদ্যার চিকিৎসায় আমি পারদর্শী। আপনার ছেলের ওপর যে বুড়ি আছর করেছে তার সমকক্ষ জাদুকর নেই ঠিক, তবে আমি ছাড়া। আমি এসেছি আল্লাহর হুকুমে। আল্লাহর হুকুম না হলে আসতাম না। বিজ্ঞজন বলেছেন, জাদুবিদ্যা চর্চা করা হারাম। তবে কেউ যদি কুফরি কালাম নষ্ট করতে আল্লাহর বান্দাদের বিপদমুক্ত করার নিয়তে জাদুবিদ্যা শেখে, তা জায়েয হবে। যেমন হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতা মানবরূপে সুলায়মান (আ.)-এর যমানায় মানুষকে জাদুবিদ্যা শিখিয়ে জাদুকরদের খপ্পড় থেকে বাঁচানোর পথ বাতলে দেওয়ার কথা কোরআন মাজিদে আছে। (দ্র. সুরা বাকারা : আয়াত-১০২)।

দরবেশ আরো বললেন, মূসা (আ.)-এর লাঠি যেভাবে ফেরাউনের জাদুকরদের জাদুর সাপগুলো খেয়ে সাবাড় করেছিল আমার জাদুও কুটনী বুড়ির জাদুর তিলিষ্মা নস্যাৎ করে ফেলবে। আপনি আমার বাতলানো কাজগুলো ঠিকমতো আঞ্জাম দেন, দেখবেন আপনার ছেলে কালই রাজপ্রাসাদের অলিন্দে।

কবরস্থানে যান। দেখবেন, সীমানা দেওয়ালের সঙ্গে একটি কবর, ধবধবে সাদা। কেবলার দিক থেকে কবরটি খুলবেন, তারপর আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন লক্ষ্য করবেন। বাদশাহ কবরস্থানে গিয়ে দেখেন, ঠিকই একটি সাদা কবর দেওয়াল ঘেঁষা। দরবেশের পরামর্শ মাফিক কবরটি খোলার পর দেখেন, একটি রশি। তাতে গিঁট দিয়ে জাদু করেছে কাবুলীওয়ালী। তিনি সতর্কভাবে গিঁটগুলো খুলে ফেললেন একেক করে।

ওদিকে শাহজাদা। দীর্ঘ বেঘোর অবস্থার বন্দিদশা হতে আজ যেন মুক্ত। ভোর না হতেই ছুটে এসেছে রাজপ্রাসাদে। পিতামাতার সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ কান্না। এতদিনের দুঃখ যাতনা বন্দিদশার কাহিনি বলতে বলতে ফুরায় না। বাদশাহ নির্দেশ দিলেন, চারদিকে জমকালো উৎসব পালনের। শাহজাদার মুক্তির আনন্দে আজ সবচেয়ে বেশি আনন্দিত নববধূ। আল্লাহর নেক বান্দার সেই মেয়ে গেল বছর শাহজাদার গৃহবধূ হয়ে রাজপ্রাসাদে এসেছে। সেই থেকে স্বামী ঘরহারা। ডাইনী বুড়ির চক্রান্ত জালে বন্দি স্বামীর চিন্তায় চরম উৎকণ্ঠায় দিনতিপাত করেছে।

বাদশাহর আনন্দ-উৎসবের বর্ণনা দেওয়া কী করে সম্ভব। এত আয়োজন, চারদিকে ছড়ানো খাওয়া মেওয়ার মহাধুমধাম। কুকুরদেরও যেন বিলানো হেেচ্ছ গোলাপজলের শরবত। জাদুকর বুড়ি এ দৃশ্য দেখে ক্ষোভে-দুঃখে কুপোকাত। শুয়ে পড়ল মৃত্যুর বিছানায়। তার ঠিকানা হল দোজখের গহ্বর।

ঘরে ঢুকেই শাহজাদা দেখে, তার সামনে নববধূ। এ তো নারী নয় অপ্সরী। পূর্ণিমার চাঁদও তার রূপ দেখে লজ্জায় মুখ লুকায়। এত রূপ, এত সৌন্দর্য ঐশ্বর্যের এই রানির সামনে কীভাবে আমি! এ কথা চিন্তা করতেই শাহজাদা বেহুঁশ পড়ে গেল। চারদিক থেকে শুরু হলো হাহাকার। নানাভাবে চলল তার চিকিৎসা আবার। তিনদিন পর হুঁশ ফিরে শাহজাদার। বছর খানেক অতিক্রান্ত হলে ছেলের মনোভাব জানতে চায় বাদশাহ। বাবা! তোমার হারানো দিনের সেই বুড়ির, সেই বন্দিদশার কথাও ভেবে দেখ একবার।

শাহজাদা বলল, মুক্তির পারাপার পার হয়ে এসেছি। শান্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। আমি আর যাব না বুড়ির কাছে, প্রতারণার সেই দেশে। মুমেনও যখন ঈমানের সুবাদে আল্লাহর নূরের পরশ পায় কখনো সে যায় না অন্ধকারের দেশে। নফস ও কুপ্রবৃত্তির কামনা বাসনার অন্ধকারে মন ও চিন্তাকে কলুষিত হতে দেয় না কিছুতে। মওলানা রুমি আরো বলেন,

আই বেরাদর দান কে শাহজাদা তুয়ী

দর জাহানে কুহনে যাদে আয নওয়ী

হে ভাই! জান যে, সেই শাহজাদা তুমিই

এই পুরোনো পৃথিবীতে এসেছ নবীন সৃষ্টি।

এই যে পৃথিবী তার বয়স ৯০ বছর নয়, আরো অধিক। এখানে তুমি জন্মেছ নতুন অতিথি শাহজাদা হয়ে। এসেই তুমি ফাঁদে পড়েছ এই কুটনী বুড়ির জাদুর চালে।

কাবুলীয়্যে জাদু ইন দুনিয়াস্ত কূ

কর্দ মর্দান রা’ আসীরে রঙ্গো বূ

এই দুনিয়া হল কাবুলী ওয়ালী ডাইনী বুড়ি

মানুষকে পরিয়েছে রঙ-রূপের মায়জাল বেড়ি।

এই বুড়ি শুধু তোমার নয়, হাজারো বরের নববধূ। যাদের মাথায় কামনা-বাসনার উন্মাদনা থাকে তারাই এই বুড়ির জালে আটকা পড়ে। যদি দেখ যে, তুমি এই বুড়ির মন্ত্রজালে আটকা পড়েছ, দুনিয়ার পঁচা দুর্গন্ধময় কূপে পতিত হয়েছ, যৌন কামনার পশুত্ব আর হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতায় আক্রান্ত, তখনই ‘কুল আউজু’ পড়তে আরম্ভ করো। একমাত্র আল্লাহর কাছে আশ্রয় নাও।

তা রহী যিন জাদুয়ী ওয়া যিন কালাক

এস্তেআযত খা’হ আয রব্বুল ফালাক

যাতে পাও রেহাই জাদুমন্ত্র-পেরেশানী হতে

ঊষার যিনি প্রভু আশ্রয় চাও তারই কাছে।

কিতাবে আছে, জাদুর ক্রিয়া, শয়তানের অনিষ্ট, সৃষ্টিজগতে বিদ্যমান দুর্যোগ হতে মুক্তি পাওয়ার নির্ভরযোগ্য অবলম্বন কোরআন মাজিদের দুই সুরা ‘কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক’ ও ‘কুল আউযু বিরাব্বিন নাস’। উভয় সুরার অর্থ অনুধাবন করলেই এর কার্যকরিতার পরিধি কিছুটা আন্দায করা যাবে।

সুরা নাস : বলো, আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের ইলাহের কাছে আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জিন জাতির মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতে।

সুরা ফালাক : বলো, আমি শরণ নিচ্ছি ঊষাার স্রষ্টার তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে, অনিষ্ট হতে রাতের অন্ধকারের, যখন তা গভীর হয় এবং অনিষ্ট হতে ওইসব নারীর, যারা গিঁটে ফুঁক দেয় এবং অনিষ্ট হতে হিংসুকের, যখন সে হিংসা করে।

হাদিস শরিফে ঘুমানোর সময় সুরা দুটি পাঠ করে হাতের তালুতে ফুঁক দিয়ে সেই তালু শরীরের সামনের অংশে মালিশ করার কথা বর্ণিত আছে। সুরা পাঠের মর্মার্থ হচ্ছে কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে স্মরণ করা। মওলানা রুমি বলেন, জাদুর বুড়ির আসল পরিচয় এই দুনিয়া। সে নববধূর সাজ নিয়ে প্রলুব্ধ করে কুমন্ত্রণা দেয় তোমার বুকের কন্দরে।

দর দরূনে সীনা নাফফাসাতে উস্ত

উকদেহা’য়ে সেহর রা’ এসবা’ত উস্ত

দুনিয়ার বুড়ি জাদু ফুঁকে তোমার বুকের ভেতর

জাদুর বেড়ি পরায় শক্ত কামনা বাসনার ওপর।

দুনিয়া ধন-সম্পদ, পদণ্ডক্ষমতা, কামনা-বাসনার প্রলোভনে দুনিয়া মানুষকে তার জাদুমন্ত্রের জালে আটকায়। দুনিয়ার জাদুর জাল অতি শক্ত। তার ফাঁদ হতে উদ্ধার পাওয়া সাধারণ লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি যদি এই ফাঁদ, এই মায়াজাল ছিন্ন করতে সক্ষম হত, তাহলে কি যুগে যুগে নবী রাসুল (আ.) গণকে দুনিয়াতে প্রেরণের প্রয়োজন হত? কাজেই তুমি এমন কাউকে খোঁজ করো-

হীন তলব কুন খোশ দমী উকদেগুশা

রাযদা’নে ইয়াফআলুল্লাহু মা’ ইয়াশা’

সন্ধান করো সৎসুন্দর জটখোলার কারিগর যিনি

‘আল্লাহ যা চান তা করেন’- এ সত্যের রহস্যজ্ঞানী।

‘আর আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’ (সুরা ইবরাহীম : আয়াত-২৭ এর অংশবিশেষ)। কোরআন মাজিদের উপরোক্ত ঘোষণার রহস্যজ্ঞানী বান্দা যারা, তারাই নবী রাসুলগণের ওয়ারিশ। ডাইনী বুড়ি দুনিয়ার ফিতনার জাল থেকে উদ্ধার হতে তোমাকে এ ধরনের কারো সাহচর্য পেতে হবে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩১৬০-৩১৯৮)।

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন। CHAYAPATH PROKASHONI