ওয়াদা রক্ষা করা মোমেনের বৈশিষ্ট্য

দীদার মাহদী

প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ওয়াদা রক্ষা করা মোমেনের গুণ, অনন্য বেশিষ্ট্য। যে ওয়াদা রক্ষা করে না, সে মানুষ হিসেবে অপূর্ণ মানুষ। তাই চলার পথে ওয়াদার গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াদা কী? কাউকে কোনো কথা দেওয়া বা কোনো কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়াকে ওয়াদা বলে। কাউকে প্রতিশ্রুতি দিলে তা যথাযথভাবে রক্ষা করতে হয়। এটাই ইসলামের সভ্যতা ধর্মীয় রীতি। ধর্মমতে, ওয়াদা ভঙ্গ করা মারাত্মক গুনাহ।এটা অনেক সমস্যার জন্ম দেয়। ওয়াদা পাওয়া ব্যক্তি কোনো বিষয়ে নিশ্চিন্তে থাকে, কিন্তু ওয়াদা ভঙ্গ হলে সে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে করে বড় রকমের ঝগড়া বেঁধে যেতে পারে। নষ্ট হতে পারে শৃঙ্খলা। তাই সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ওয়াদা রক্ষার গুরুত্ব অনেক। বড় অবাক করা বিষয় হলো, আজকাল ওয়াদা ভঙ্গ করাটা স্বাভাবিক স্বভাবে পরিণত হয়েছে। এটাকে অপরাধ মনে করা হয় না। সমাজে উচ্চ শিক্ষিতরাও আজ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে। আজকাল প্রায় সর্বক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাকে মামুলি ব্যাপার মনে করা হচ্ছে। অথচ এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওয়াদা ভঙ্গকারীকে হাদিসে মুনাফেক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যা বড় ভাবনার বিষয়। ঈমানদার ব্যক্তির কাছে তো এটি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাওয়ার মতো একটি ব্যাপার। ওয়াদা ভঙ্গের কারণে সমাজে নানান সমস্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এ সমস্যা নিরসনে ওয়াদা রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা খুবই প্রয়োজন।

ওয়াদা পালনে কোরআনের বক্তব্য : কোরআন মানবজাতির আলোকবর্তিকা। সত্যের উৎস। জীবন চলার মূলনীতি। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম ওয়াদা পালনে দৃঢ় হওয়া। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ওয়াদা পালনে দৃঢ়তার সুনাম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর স্মরণ করুন, এই কিতাবে ইসমাঈলকে, তিনি তো ছিলেন প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসুল, নবী।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৫৪)। ওই আয়াতে ইসমাঈল (আ.)-এর ওয়াদা পালনে দৃঢ় থাকার সুনাম করা হয়েছে।

অনেক সময় জেনেশুনেই অনেকে এমন বিষয়ে ওয়াদা করে, যা সে পালন করবে না বা করতে পারবে না, এটা ঠিক নয়। মহান আল্লাহ এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যা করো না, তোমাদের তা বলা আল্লাহর কাছে অতিশয় অসন্তোষজনক।’ (সুরা, আস-সফ, আয়াত : ৩)। অঙ্গীকার তো করাই হয় পূরণ করার জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ওয়াদা বা অঙ্গীকার পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই ওয়াদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে’। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪)। আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর তোমরা যখন অঙ্গীকার করো, তখন আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমরা পাকাপোক্ত অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করো না এবং প্রকৃত পক্ষে তোমরা নিজদের জন্য আল্লাহকে জিম্মাদার বানিয়েছ। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন, যা তোমরা করো’। (সুরা নাহল, আয়াত-৯১)। ঈমানদারদের অন্যতম আকর্ষণীয় গুণই হচ্ছে ওয়াদা পূর্ণ করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ওয়াদাগুলো পূরণ করো।’ (সুরা মাইদা, আয়াত ১)। ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ক্ষতি নিজের ওপর বর্তাবে। ‘সুতরাং যে এ ওয়াদা ভঙ্গ করবে-এর কুফল তার ওপরই পড়বে। আর আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করে যে তা পূরণ করবে, আল্লাহ অচিরেই তাকে মহাপুরস্কার দেবেন।’ (সুরা : ফাতহ ৪৮ : ১০)।

ওয়াদা সম্পর্কে হাদিসের নির্দেশনা : কারো সঙ্গে কোনো ব্যাপারে চুক্তি বা ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করা আরেকটি কবিরা গোনাহ। তাই তো এ জাতীয় ব্যক্তিকে মোনাফেক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে বিদ্যমান সে হচ্ছে খাঁটি মোনাফেক। যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মোনাফেকের একটি স্বভাব থেকে যায়। ১. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। ২. কথা বললে মিথ্যা বলে। ৩. অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে। ৪. বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করে।’ (বোখারি : ৩৪)।

কেয়ামতের দিন প্রত্যেক চুক্তি ভঙ্গকারী বা ওয়াদা খেলাফির পাছার কাছে একটি করে ঝান্ডা প্রোথিত থাকবে এবং যা দিয়ে সে কেয়ামতের দিন বিশ্ব জনসমাবেশে পরিচিতি লাভ করবে। ‘কেয়ামতের দিন প্রত্যেক চুক্তি ভঙ্গকারীর একটি করে ঝান্ডা হবে, যা তার চুক্তি ভঙ্গের পরিমাণ অনুযায়ী উত্তোলন করা হবে। জেনে রাখো, সে ব্যক্তি অপেক্ষা বড় চুক্তি ভঙ্গকারী আর কেউ হতে পারে না; যে সাধারণ জনগণের দায়িত্বভার হাতে নিয়ে তাদের সঙ্গেই চুক্তি ভঙ্গ করে’। (মুসলিম : ১৭৩৮)।ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি যে ‘(কেয়ামতের দিন) ওয়াদা ভঙ্গের নিদর্শন হিসেবে প্রত্যেক ওয়াদা ভঙ্গকারীর জন্য একটি পতাকা স্থাপন করা হবে।’ (বোখারি : ৩১৮৮)। অর্থাৎ তাদের দেখলেই মানুষ বুঝবে, এই লোক দুনিয়াতে ওয়াদা পালন করত না। হাদিসে কুদসিতে আছে, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি বিচার দিবসে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। ১. যে ব্যক্তি অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে, ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে এবং ৩. যে ব্যক্তি কোনো কর্মচারী নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে; কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না’ (সহিহ বুখারি)। তাই আসুন ওয়াদা পালনে সচেষ্ট হই। একান্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করে সমাধান করি। অযথা ওয়াদা ভঙ্গ করে নিজের সম্মান নষ্ট না করি। দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হই।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, দারুলহুদা মডেল মাদ্রাসা, কোদালপুর।