ঢাকা ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪/১৯৪)

উটের কাছে খচ্চরের নালিশ

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
উটের কাছে খচ্চরের নালিশ

এক খচ্চর খোঁয়াড়ে পাশে পেয়ে উটের কাছে নালিশ করে, মান্যবর! আমি তো সারাদিন পথ চলি, মানুষের বোঝা টানি। বাজারে, মহল্লায়, চলাচল পথে, অলিগলিতে আমার যাতায়াত। কিন্তু বারবার হোঁচট খাই। মাটিতে পড়ে যাই। আমার শরীরে মোটেও জোর নাই। টিলার উপর থেকে যখন নিচে নামতে চাই, ভয়ে চমকে উঠি, উল্টে পড়ে যাই। অথচ এসব পরিস্থিতিতে দেখি আপনার গতি থাকে অবিচল। পথ চলতে কোথাও হোঁচট খান না, পা পিছলে পড়ে যান না। কারণ কী? আপনার অন্তরাত্মা কী সত্যিই পবিত্র? আপনার মনোবল শক্তিশালী। তাই কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন?

আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, আমার পথ চলা কত নড়বড়ে। পিঠের বোঝা হেলে পড়ে। চালকের চাবুকের ঘায়ে কঁকিয়ে উঠি। আমার অবস্থা সেই নির্বোধ লোকের মতো, যার বোধশক্তি ধ্বংস হওয়ায় বারবার তওবা ভঙ্গ করে। অন্যায় করে বলে, ভবিষ্যতে ভালো হয়ে যাব, আর করব না। কিন্তু সে কথায় অবিচল থাকে না। গোনাহের কাজ আর করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়, পাপের জন্য অনুশোচনাও করে; পরক্ষণে সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে। চিন্তার অস্থিরতা, ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতার কারণে ইবলিস সুযোগ পায়। সহজে ইবলিসের ক্রীড়নক হয়ে যায়। উচ্চ মনোবল হারা এসব লোক প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখলেই ঘাবড়ে যায়, খেই হারিয়ে ফেলে। লোভনীয় কিছু দেখলে নিজেকে সামলাতে পারে না। এদের অবস্থা ল্যাংড়া ঘোড়ার মতো, যে বোঝা পিঠে পাথুরে জমিতে পথ চলতে বারবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।

এরা বদবখত। এদের হোঁচট খাওয়া আসলে গাইবি জগতের অদৃশ্য ধাক্কা। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলার কারণে আহম্মকদের অদৃশ্য থেকে ধাক্কা দিয়ে সতর্ক করা হয়, কখনো বিপদগ্রস্ত হয়। বুঝতে পারলে তওবা করে। তবে সে তওবায় মনোভাব থাকে ইতস্তত নড়বড়ে। মনে মনে বলে, অন্যায় কাজ আর করব না। কিন্তু মনের প্রত্যয়ের দুর্বলতার কারণে সুযোগ পেলে হাতছাড়া করে না। এদের তওবায় খাঁটি মনে হয় না, তাই শয়তান থুথু দিলেই তাদের তওবা ভেঙ্গে যায়।

যা‘ফ আন্দর যা‘ফ ও কিব্রাশ আ’নচুনা’ন

কে বে খা’রী বেন্গারাদ দর ওয়া’সেলা’ন

বুৃদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তিতে কত দুর্বল তবুও অহংকারে

আল্লাহ ওয়ালাদের দিকে তাকায় তাচ্ছিল্যের নজরে।

এদের মনোবল দুর্বল, বারবার তওবা ভাঙে। তারপরও নিজের অন্যায়ের পক্ষে ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, যুক্তি দেখায়। যারা সৎপথের অভিসারী, আল্লাহর নেক বান্দা, তাদের দেখে তুচ্ছজ্ঞান করে। নিজেকে বড় ও ভালো মনে করে।

খচ্চর বলে, আমার অবস্থা সেই নির্বোধ দুনিয়াপূজারীর মতো। হে উট! আপনার অবস্থা সত্যিই প্রত্যয়দীপ্ত মুমিনের মতো। পথ চলায় হোঁচট খেলেও নিয়ন্ত্রণ হারান না, পড়ে যান না। অহংকার আপনার মনে বাসা বাঁধতে পারে না। ওহে উট! আপনার এমন কী ফজিলত আছে, যে কারণে পথ চলা এত গতিময়। দুর্বলতা অলসতা আপনাকে স্পর্শ করতে পারে না?

গোফত গরচে হার সাআদাত আয খোদাস্ত

দরমিয়া’নে মা ও তো বস ফারকহা’স্ত

বলল, যদিও সৌভাগ্য আসে আল্লাহর রহমতে

তোমার ও আমার মাঝে অনেক তফাত আছে।

তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য হলো, আমার মাথাটা অনেক উঁচা। আমার দুচোখের বিচরণক্ষেত্র অনেক উপরে। আমার দৃষ্টিভঙ্গি, মনোবল উচ্চ, তাই বিপদের হোঁচট থেকে তাই আমি নিরাপদ। কেননা, যার চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোবল উচ্চ তাকে নফস কাবু করতে পারে না, কৃপ্রবৃত্তির ফাঁদে সে পা দেয় না।

পথচলার শুরুতে আমি পথের শেষ প্রান্ত দেখে নিই। পাহাড়ের উপর থেকে পাহাড়ের নিচের অবস্থা আমার নজরে আসে। কোথায় গর্ত, কোথায় চড়াই-উৎরাই দেখে দেখে পা ফেলি। আমার অবস্থা সেই দিব্যদৃষ্টির বুযর্গের মতো, যিনি এখান থেকেই মৃত্যুর বিছানায় কী কী ঘটতে পারে, দেখতে পান। তার দূরদৃষ্টির অবস্থা হলো,

আঁনচে খা’হাদ বুদ বা’দে বীস্ত সা’ল

দা’নদ আন্দর হা’ল আ’ন নেকূ খেসা’ল

আজ থেকে বিশ বছর পর কী ঘটবে তা

এখনই জানতে পারেন অন্তরদৃষ্টির বান্দা।

তার চোখে, অন্তরে জ্বলে নুরের বাতি, সে বাতি দিয়ে তিনি শুধু নিজের অবস্থা দেখেন না, দেখেন প্্ূর্ব পশ্চিম, মাগরিব-মাশরিক। এমন নুরের বাতি কীভাবে জ্বলে? হ্যাঁ, যে দেশ থেকে এসেছে আবার যেতে হবে ফিরে, সেই ঠিকানার ভালোবাসায় তার হৃদয়ে আলো জ্বলে। সেই আলোর প্রদীপ তার চিন্তায় মননে অস্তিত্বজুড়ে। উদাহরণ চাও তো অনেক আছে। ইউসুফ (আ.) শৈশবে স্বপ্নে দেখেছিলেন, ১১টি তারকা ও চন্দ্র-সূর্য তাকে সিজদা করছে। (দ্র. সুরা ইউসুফ, আয়াত-৪) ১০ বা ২০ বছর গত না হতেই সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।

নীস্ত আ’ন ইয়ানযুর বেনুরিল্লাহ গযা’ফ

নূরে রব্বানী বুয়াদ গার্দূন শেকা’ফ

‘আল্লাহর নুরে দেখে’- এ হাদিস নহে অবান্তর

আল্লাহর নুর ভেদ করে যায় আকাশের যত স্তর।

‘তোমরা মুমিনের বিচক্ষণতাকে ভয় কর, কেন না, সে আল্লাহর নুরের আলোতে দেখে।’ এই হাদিসের মর্মবাণীকে অবাস্তব অবান্তর মনে করো না। কেননা, মুমিনের হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত খোদায়ি নুর আঁধারের পর্দা ছিন্ন করে ঊর্ধ্বলোকের ভেদ রহস্য ও হাকিকত অনুধাবনের শক্তি রাখে। ওহে খচ্চর স্বভাবের দুর্বল মন ও চরিত্রের মানুষ! তোমার চোখে যে রব্বানি নুর নেই তার কারণ, তোমার অস্তিত্বটা বন্দি হয়ে আছে জৈবিক ইন্দ্রিয়ের বন্দিশালায়। জৈবিক চাহিদার বন্দিদশা থেকে মুক্ত না হলে আল্লাহর নুরের আলোতে জীবন আলোকিত করতে পারবে না- এই সত্যটি উপলব্ধি করার চেষ্টা করো।

তোমার বস্তুগত চোখ তোমাকে পথ দেখায় খোঁয়াড় পর্যন্ত। বৈষয়িক ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করাই তোমার একমাত্র লক্ষ্য। তোমার হাত-পা সব কিছুর গতি ও গন্তব্য ওই পর্যন্ত। উট হিসেবে আমার বৈশিষ্ট্য হলো, আমার দৃষ্টিভঙ্গি তোমার চেয়ে উজ্জ্বল, উচ্চ ও উন্নত। তাছাড়া আমার বংশধারা তোমার চেয়ে পবিত্র। আমি বৈধ মা-বাবার সন্তান। অথচ তুমি জারজ। কারণ, নর-গাধা আর মাদি-ঘোড়ার জোড় থেকেই খচ্চরের জন্ম। কাজেই দুর্বলতা স্বীকার কর, তাহলে হয়তো তোমার অবস্থা পরিবর্তনের একটা পথ বের হবে।

‘আাপনি আমার ব্যাপারে যাকিছু বলেছেন সব সত্য’- একথা বলেই খচ্চর কাঁদতে থাকে। বিনয়ের সুরে আরো বলে, ওহে আল্লাহর মকবুল বান্দা! আমি পতিত দুর্বল, আপনি যদি দয়া করেন, দোয়া করেন আল্লাহর দরবারে আমি মাফ পাব। আমার দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার উপায় হয়তো হবে। উটের রূপকে আল্লাহর নেক বান্দা বলেন, ওহে দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত খচ্চর স্বভাবের মানুষ! তুমি যখন নিজের দুর্বলতা স্বীকার করেছ, নিজের অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কসরত করনি, যাও এখন তোমার ভাগ্যের কপাল খুলে যাবে। সৎপথে চলা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। এতদিন তুমি শত্রুর কাতারে ছিলে, খাঁটি মনে তওবা করে এখন থেকে বন্ধুর কাতারে শামিল হলে। তোমার মধ্যে মন্দের যে স্বভাব তা আপেক্ষিক ছিল, মজ্জাগত ছিল না, তাই আল্লাহর পথে ফিরে আসতে পেরেছ। যদি মন্দণ্ডস্বভাব তোমার মজ্জাগত হয়ে যেত, তাহলে সত্যকে বুঝতে পারতে না, সত্যের বিরোধিতায় ওঠেপড়ে লেগে যেতে।

আ’ন বদে আরিয়্যতী বা’শদ কে উ

আ’রদ একরা’র ও শওয়াদ উ তওবা জু

মন্দ যার স্বভাবে আপেক্ষিক আপতিত সাময়িক

অন্যায় স্বীকার করে সে তওবা করে তাৎক্ষণিক।

যে ব্যক্তি নিজের দোষ স্বীকার করে এবং তওবার সন্ধানী হয়, বুঝতে হবে, তার স্বভাবে-চরিত্রে মন্দ বাইরে থেকে আপতিত, মজ্জাগত নয়। ব্যাপারটি আদম (আ.)-এর গন্দুম খাওয়ার মতো। বুঝতে পারার সাথে সাথে তিনি তওবা করেছেন। কিন্তু ইবলিসের স্বভাবে মন্দ ছিল মজ্জাগত, তাই সে তওবার দিকে পথ খুঁজে পায়নি।

হে খচ্চর! হে দুনিয়ার মোহে মত্ত-ব্যস্ত মানুষ! তুমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধন হয়েছ, সংশেধন হতে গোঁড়ামী দেখাওনি। পরিণামে আগুনের শিখা থেকে, তোমার স্বভাব ও কার্যকলাপের মন্দ প্রভাব থেকে, যা কেয়ামতে সাপ-বিচ্ছু হয়ে দেখা দিত- তার ছোবল থেকে রক্ষা পেয়েছ। যাও এখন চিরন্তন সৌভাগ্যের আহ্বান কান পেতে শোনো-

উদখুলূ তো ফী ইবাদী য়া’ফতী

উদখুলী ফী জান্নাতী দরয়া’ফতী

‘শামিল হও আমার বান্দাদের মাঝে’ আহ্বানে

‘দাখিল হও সাজানো জান্নাতে’ এই আমন্ত্রণে।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,

‘হে প্রশান্তচিত্ত! ‘...ফাদখুলি ফী ইবাদী ওয়াদখুলী জান্নাতি’- তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে, আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও, আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (সুরা ফাজর, আয়াত, ২৭-৩০)।

তোমার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট। উত্তম প্রতিদান পেয়ে তুমিও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তোমার সামনে এখন জান্নাত কাননের সুখ সম্ভোগের হাতছানি। কারণ অন্তরের গভীর থেকেই তুমি বলেছ-

‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম’ ‘হে প্রভু! আমাদের সরল সঠিক পথ দেখাও।’ তাই তিনি শুধু পথ দেখাননি, নিজে হাতে ধরে নিয়ে গেছেন এমন পথে, যার শেষপ্রান্তে আছে সুখময় জান্নাত, জান্নাতুন নাঈম। তুমি আগ্নেয় স্বভাবের ছিলে এখন থেকে হয়ে গেছ নুরি স্বভাবের। এতকাল তারকা ছিলে এখন থেকে সূর্যে পরিণত হলে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩৩৭৭-৩৪২২)।

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত