ঈমান ও কুফুরের পরিণাম

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঈমান অর্থ আস্থা, বিশ্বাস, প্রত্যয়-প্রতিজ্ঞা। পরিভাষায় ঈমান বলতে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এ বিশ্বাসকে বোঝায়। ব্যাপক ও প্রায়োগিক অর্থে ঈমান হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আনীত বিধানকে সত্যায়ন করে তা ব্যক্তিজীবনে সর্বত্র কার্যত বাস্তবায়ন করা। আর কুফুরি হলো, অস্বীকার, অবিশ্বাস ও অমান্যতা। পরিভাষায়, এক আল্লাহয় অবিশ্বাস ও অমান্যতাকে কুফুরি বলে। ঈমান মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার মাধ্যমে সৌভাগ্যবান বানায়। পক্ষান্তরে কুফুরি মানুষকে হতভাগা বানায়। ঈমান মানুষকে আলোর পথ দেখায় আর কুফুরি মানুষকে অন্ধকারে পরিচালিত করে। ঈমানের শেষ পরিণাম জান্নাত আর কুফুরির চূড়ান্ত পরিণাম জাহান্নাম। আমাদের উচিত ঈমানের পথে পরিচালিত হওয়া। আসুন, কোরআন হাদিসের আলোকে ঈমান ও কুফুরির পরিণাম সম্পর্কে জেনে নিই।

ঈমানের পরিণাম : ঈমান হলো, আল্লাহতায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাস, তার ফেরেস্তা, কিতাব, রাসুল, শেষ দিবস এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের ওপর বিশ্বাস রাখা (মুসলিম : ০১)। এগুলো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেওয়া এবং কার্যে পরিণত করা। যে ব্যক্তি এমনটা করবে, সে মোমেন বলে স্বীকৃত হবেন। তিনি দুনিয়া এবং আখেরাতে বিভিন্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত হবেন।

পবিত্র ও আনন্দময় জীবন লাভ : ঈমানের কারণে ব্যক্তি দুনিয়াতে পবিত্র ও আনন্দময় জীবন লাভ করবে। মোমেন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় কলুষতামুক্ত, স্বচ্ছ-সফেদ জীবনের উত্তারাধিকারী হবেন। আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন, মোমেন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, অবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব (সুরা নাহল : ৯৭)। অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে আয়াতে ’হায়াতে তাইয়্যিবা’ বলতে দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্যময় পবিত্র জীবনকে বোঝানো হয়েছে (মাআরেফুল কোরআন : ১৪৪৬)। মনে রাখবেন, পবিত্র ও আনন্দময় জীবনের জন্য সম্পদের আধিক্যতার প্রয়োজন হয় না। বরং অল্পতুষ্টি ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের অভ্যাস প্রয়োজন হয়। যা একজন খাঁটি মোমেনের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান থাকে। যে কারণে মোমেনের জীবন সুন্দর হয়।

দৃঢ়পদতা ও অবিচলতা অর্জন : ঈমানের কারণে ব্যক্তি দুনিয়া এবং আখেরাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। কাজে কর্মে অবিচলতা ও অটলতা অর্জন করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য লাভে ধন্য হয়। যার কারণে প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ যখন দিশাহারা হয়ে যায়, তখন আল্লাহতায়ালা তাকে তা থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করেন। আবার কবরে ফেরেস্তাদের প্রশ্নে এবং কেয়ামতের বিভীষিকায়ও আল্লাহতায়ালা তাদের নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টন করে রাখবেন এবং দৃঢ়তা দান করবেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের সুদৃঢ় বাক্যের দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন (সুরা ইবরাহিম : ২৭)।

দুনিয়ার জীবনে বরকত প্রাপ্তি : ঈমানের কারণে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে বরকত লাভ করবেন। প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন। বরকতের অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছু নিয়মিত থাকা এবং যতটুকু আছে, তাতেই আত্মিক প্রশান্তি থাকা; চিত্তে অপ্রাপ্তিজনিত অস্থিরতা না থাকা। ঈমানের কারণে ব্যক্তি আসমান ও জমিনের বরকত লাভে ধন্য হয়। সঠিক সময়ে আসমান বৃষ্টিবর্ষণ করে আর জমিন থেকে প্রয়োজনীয় ফসল ও ফলফলাদি উৎপাদিত হয়। সুরা আরাফের ৯৬ নম্বর আয়াতে এসেছে, আর যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতগুলো উন্মোক্ত করে দিতাম। একমাত্র ঈমানের কারণে মানুষ দুনিয়া আখেরাতের এই বরকত পেতে পারেন।

আল্লাহর নিরাপত্তা লাভে ধন্য হওয়া : আল্লাহর নিরাপত্তাই প্রকৃত নিরাপত্তা। সে ব্যক্তি ধন্য যে, তা লাভ করবে। আর মোমেনরা দুনিয়া এবং আখেরাতে আল্লাহতায়ালার ভয়াবহ শাস্তি থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে এবং ঈমানের ওপর অটল থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত (সুরা আনআম : ৮২)।

 

শত্রুদের থেকে হেফাজত থাকবেন : ঈমানের কারণে আল্লাহতায়ালা ব্যক্তিকে শারীরিক, মানসিক, আর্থিকসহ সব প্রকারের ক্ষয়ক্ষতি থেকে হেফাজত রাখবেন। কাফেরদের শত্রুতা, শয়তানের কুমন্ত্রনা, আত্মার কুপ্রভাব ও কলুষতা থেকে আল্লাহতায়ালা তাদের মুক্ত রাখবেন। শত্রুর প্রতিরোধে তারা আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবেন। কোরআনে এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মোমেনদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করেন (সুরা হজ : ৩৮)।

উন্নত মর্যাদার অধিকারী হবেন : ঈমান এমন একটি দামি সম্পদ, যে কারো কাছে এই সম্পদ থাকবে, সে আল্লাহতায়ালার কাছে দামি হবেন। সম্মানিত বলে বিবেচিত হবেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন, আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত (সুরা মুজাদালাহ : ১১)।

ঈমানদার বিচলিত হবেন না : যারা ঈমান আনায়ন করবে তারা আল্লাহর বন্ধু বলে বিবেচিত হবেন। আর যারা আল্লাহর বন্ধু বলে বিবেচিত হবেন, তাদের কোনো চিন্তা-পেরেশানি থাকবে না। সুরা ইউনুসে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করত। তাদের জন্যই আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে (৬২-৬৩)।

চির-কাঙ্ক্ষিত জান্নাত অর্জন : ঈমানের চূড়ান্ত পরিণাম হলো, ঈমান ব্যক্তিকে চির-কাঙ্ক্ষিত জান্নাতে প্রবেশ করাবে। যারা ঈমান আনয়ন করবে আল্লাহতায়ালা খুশি হয়ে তাদের জন্য চিরস্থায়ী জান্নাতে বসবাসের সুযোগ করে দেবেন। কোরআনে এসেছে, আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের শুভ সংবাদ দিন যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত (সুরা বাকারা : ২৫)।

জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ : জান্নাম চির-শাস্তির জায়গা। যার থেকে আমরা প্রতিনিয়ত রক্ষা পাওয়ার প্রার্থনা করি। সেই জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ মিলবে ঈমানের বদৌলতে। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, যখন জান্নাতিরা জান্নাতে আর জাহান্নামিরা জাহান্নামে চলে যাবে, তখন আল্লাহ বলবেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে তাকে জাহান্নাম থেকে বের কর। অতপর তাদের এমন অবস্থায় বের করা হবে যে, তারা পোড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তাদের জীবন-নদে নামিয়ে দেওয়া হবে। এতে তারা তরতাজা হয়ে ওঠবে, যেমন নদীর তীরে জমাট আবর্জনায় সজীব উদ্ভিদ গজিয়ে ওঠে (বোখারি : ৬৫৬০)।

কুফুরের পরিণাম : কুফুর অর্থ অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা, অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় কুফুর বলতে বোঝায়, আল্লাহ ও তার রাসুল এবং ঈমানের অন্যান্য রোকনে বিশ্বাসের অবিদ্যমানতা। কুফুর ব্যক্তিকে রবের অবাধ্য বানায় এবং জাহান্নামের উপযুক্ত করে। কোরআনে এসেছে, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা আল্লাহর সাক্ষাৎ অস্বীকার করেছে (সুরা ইউনুস : ৪৫)।

সংকীর্ণ জীবন লাভ : কুফুরের কারণে আল্লাহতায়ালা সেই ব্যক্তির জীবন সংকীর্ণ করে দেন। দুনিয়াবি আসবাব পরিপূর্ণভাবে থাকার পরেও মনে হবে যেন কিছুই নেই। মনের শান্তি উবে যাবে। কোনো কিছুতেই মন ভরবে না। চারদিক থেকে সংকীর্ণতা জেকে বসবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হয়, তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত আর আমি তাকে কেয়ামতের দিন উত্থিত করবো অন্ধ অবস্থায় (সুরা ত্বহা : ১২৪)।

সংঘাতময়-অশান্ত পৃথিবী : কুফুর এমন একটি খারাপ কর্ম যার কারণে মানুষ নিজ স্রষ্টাকে অস্বীকার করে। তার ওপর এমন কিছু অপবাদ আরোপ করে, যা তার সত্তার সঙ্গে যায় না। তখন আল্লাহর গোস্বা ও ক্রোধ এতটাই বেড়ে যায় যে, জমিন-আসমান ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। তবে আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে পৃথিবীকে শান্ত রাখেন। কোরআনে এসেছে, আর তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। তোমরা তো এমন এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করেছ, যাতে আসমানগুলো বিদীর্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, আর জমিন খণ্ড-বিখণ্ড এবং পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে আপতিত হবে (সুরা মারইয়াম : ৮৮-৯০)।

কুফর দয়াহীনতার দ্বার উন্মোচন করে : পৃথিবী সংঘাতময়, পৃথিবীকে বসবাসের অনুপোযোগী করার দায়ভার একমাত্র কুফুরের। আল্লাহয় অবিশ্বাসীরাই দুনিয়াকে অশান্ত করার পেছনে একমাত্র দায়ী। তাই, কাফেরের প্রতি দুনিয়ার কোনো সৃষ্টিজীবের মায়া থাকে না। তাদের কষ্টে ও ধ্বংসে কেউ ব্যথিত হয় না। ক্রন্দন করে না। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আকাশ ও পৃথিবী কেউই তাদের জন্য অশ্রুপাত করেনি এবং তাদের অবকাশও দেয়া হয়নি (সুরা দুখান : ২৯)।

আল্লাহর ঘৃণা ও আজাবের উপযুক্ত করে : কুফুর ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালার ঘৃণা ও আজাব-গজবের উপযুক্ত করে। দুনিয়াতে যত জাতি ধ্বংস হয়েছে, তারা নিজেদের পাপ ও কুফুরির কারণে ধ্বংস হয়েছে। পরকালে যারা জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে, তারাও কুফুরের কারণে শাস্তির সম্মুখীন হবেন। দুনিয়াতে বালা-মুসিবত নাজিলের কারণ, মানুষের কুফুরি। আল্লাহ বলেন, যারা কুকর্মের ষড়যন্ত্র করে তারা কি এ বিষয়ে নির্ভয় হয়েছে যে, আল্লাহ তাদের ভূগর্ভে বিলীন করবেন না অথবা তাদের ওপর আসবে না শাস্তি এমনভাবে যে, তারা উপলব্ধিও করবে না। অথবা চলাফেরাকালে তিনি তাদের পাকড়াও করবেন না? আর তারা তা ব্যর্থ করতে পারবে না (সুরা নাহল : ৪৫, ৪৬)।

অনিবার্য ধ্বংস : কেয়ামতের সফলতা প্রকৃত সফলতা আর সেদিনের ব্যর্থতা প্রকৃত ব্যর্থতা। কুফুর ব্যক্তিকে সেদিন অনিবার্য ধ্বংসের মুখোমুখি করে। তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের মাধ্যমে চূড়ান্ত ব্যর্থ করে। আল্লাহ বলেন, আর যাদের নেকির পাল্লা হালকা হবে, তারা হবে সেই সব লোক, যারা নিজেদের ধ্বংস ও ক্ষতি নিজেরাই করেছে, কারণ তারা আমার নিদর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করত (সুরা আরাফ : ৯)।

কুফুরের চূড়ান্ত পরিণাম চিরস্থায়ী জাহান্নাম : কুফুর কাফেরকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যা হতে পরিত্রাণের কোনো উপায় তাদের থাকবে না। আল্লাহ বলেছেন, আর আপনি যদি সেই অবস্থা দেখতেন, যখন ফেরেস্তারা তাদের রুহ কবজ করার সময় তাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করেন (সুরা আনফাল : ৫০)। অন্যত্র এসেছে, সকাল-সন্ধায় তাদের উপস্থিত করা হয় আগুনের সম্মুখে। (সুরা গাফির : ৪৬)।

লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর