ঢাকা ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪/১৯৭)

পিঁপড়ার তত্ত্বজ্ঞান ও সত্যদর্শন

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
পিঁপড়ার তত্ত্বজ্ঞান ও সত্যদর্শন

বাদশাহ যুল-কারনাইন একবার কুহেকাফ পর্বতে গেলেন পরিদর্শনে। দেখলেন, চারদিকে চুন্নিপান্নার ছড়াছড়ি। যমররুদ পাথরের শুভ্রতা থইথই করে। বিশাল এ পর্বত বেড় দিয়ে লেপ্টে আছে সমগ্র জগৎ। সৃষ্টির বিস্ময় কুহেকাফের বিশালতা দেখে তিনি হতবাক। যুল-কারনাইন বাদশাহর কথা উল্লেখ আছে কোরআন মাজিদে। দুনিয়ার সর্বপূর্ব প্রান্তে ইয়াজুজ-মাজুজের ধ্বংসযজ্ঞ রোধে তিনি সীসাঢালা প্রাচীর নির্মাণ করে দেয়ার তথ্যসহ আরো বিবরণ আছে সুরা কাহফের ৮৩-৯৭ আয়াতে। অনন্য সাধারণ ক্ষমতাবান ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন তিনি। পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের ওপর কর্তৃত্বের সুবাদে তিনি যুল-কারনাইন নামে খ্যাত।

কুহেকাফের সামনে দাঁড়িয়ে যুল-কারনাইন বললেন, হে কুহেকাফ! তোমার বিশালতার মাঝে আল্লাহর কুদরতের একটু বর্ণনা দাও। তোমার নাম যদি হয় পর্বত, তাহলে পৃথিবীর অপরাপর পর্বতকে কী বলব। সেগুলো যে তোমার তুলনায় অতি নগণ্য পুচ্ছ-তুচ্ছ। কুহেকাফ জবাব দেয়, দুনিয়াতে যত পাহাড়-পর্বত আছে, সব আমার শরীরের রগরেশা। রূপে ঔজ্জ্বল্যে দৃঢ়তায় আমার সমান হওয়ার যোগ্যতা ওদের কারো নেই।

মন বে হার শহরী রগী দা’রম নেহা’ন

বর উরুকম বস্তে আতরা’ফে জাহা’ন

প্রত্যেক শহরে আছে আমার একেক রগ গোপনে

জগতের আনাচণ্ডকানাচ বাঁধা আছে আমার রগে।

কুহেকাফ বুঝিয়ে বলল, আল্লাহতায়ালা যখন কোনো শহরে ভূমিকম্প দেয়ার ইচ্ছা করেন, আমাকে নির্দেশ দেন, তোমার একটি রগে ঝাঁকি দাও। তখনই সেই রগের সঙ্গে যুক্ত শহরে ভূমিকম্প ঘটে যায়। আবার যখন আল্লাহ বলেন, শান্ত হও, তখনই আমার রগ থেমে যায়, ভূমিকম্পও থেমে যায় সঙ্গে সঙ্গে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি কর্মব্যস্ত অবিরত। আমার উদাহরণ পট্টির মতো, দেখতে একেবারে শান্ত, বসে আছি ক্ষতের ওপর। কিন্তু ভেতরে আমার চিকিৎসা চলে অবিরত। দৃশ্যত আমি শান্ত স্থির; কিন্তু অভ্যন্তরে নিয়ত কর্মব্যস্ত, অস্থির। কারণ, আমার ভেতরে ক্রিয়াশীল আল্লাহর ফরমান। যারা বুদ্ধিজীবী বা বিজ্ঞানী তারা বুঝতে পারে না এই হাকিকত। তারা মনে করে ভূগর্ভের অভ্যন্তরে পুঞ্জীভূত বাষ্পের তৎপরতার বিকর্ষণ ঘটে ভূমিকম্পের আকৃতিতে।

মওলানা রুমি বলেন, যারা আংশিক বুদ্ধির অধিকারী, নিজেদের বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী মনে করেন, তারা নানা প্রাকৃতিক ঘটনার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ খোঁজেন। ভূমিকম্পের কারণ নির্ণয়ে নানা তত্ত্ব রচনা করে বলেন, অমুক কারণে ভূমিকম্প হয়েছে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি নেমেছে। দখিনা হাওয়ার প্রবাহে বসন্ত এসেছে। কিন্তু এসবের পেছনে ক্রিয়াশীল আল্লাহর ইচ্ছার কার্যকারিতা তারা দেখে না। তাই স্বয়ং স্রষ্টার পরিচয় তারা পায় না। তিনি তো শুধু স্রষ্টা নন, সবকিছুর সার্বক্ষণিক নিয়ন্তা, কাইয়ুম। বিজ্ঞানীদের বিদ্যার দৌড় বোঝার জন্য একটি গল্প বলছি শুনো।

একবার এক বিদ্বান পিঁপড়া লক্ষ করল, একটি কাগজের ওপর কালো কালো রেখা অঙ্কিত হচ্ছে। চিন্তাবিদের ভঙ্গিতে সে আরেক পিঁপড়াকে বলল, বন্ধু! দেখ, কাগজের গায়ে কী সুন্দর রেখাচিত্র! গোলাপ, চামেলী, বেলি হরেক ফুলের ছবি ফুটছে। এর রহস্য আমি জানি। কলম নামের একটি জিনিস এসব অঙ্কন করছে শিল্পীর তুলির মতো। সে পিঁপড়া ছিল আরো বুদ্ধিমান। বলল, বন্ধু! বলো কী? আমি তো আরো হাকিকত জানি। কলম তো নয়, কলমের সঙ্গে যুক্ত আঙ্গুল এসব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। লেখার কাজে এই কলমের ভূমিকা শাখা বা অনুগতের মতো। তৃতীয় এক পিঁপড়া বলল, তোমরা দুজন যা আবিষ্কার করেছ, তা চূড়ান্ত কথা নয়। আসলে আঙুলের সঙ্গে যুক্ত একখানা হাত ও বাহু দেখ। কীভাবে লেখা সঞ্চালন করে। দুর্বল আঙুল তো শক্তি সঞ্চয় করে বাহুর কাছ থেকে। এভাবে একেকটি পিঁপড়া কাগজের ওপর লেখার রহস্য উদ্ঘাটনে নতুন নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন করছিল। অবশেষে সবচেয়ে জ্ঞানী পিঁপড়ার পালা এলো।

গোফত কায সূরত মবীনীদ ইন হুনার

কে বেখা’ব ও মর্গ গর্দদ বী খবর

বলল, আকৃতির মাঝে লুকায়িত নয় এই শিল্প আঁচড়

কারণ, ঘুমে বা মরণে থাকে না তার এ খবর।

সূরত আ’মদ চোন লেবা’স ও চোন আসা’

জুয বে আকল ও জা’ন নজুম্বদ নকশহা’

আকৃতির উপমা পোশাক কিংবা লাঠির মতো

নকশা নড়ে না, যদি না থাকে বুদ্ধি ও প্রাণের স্পন্দন।

তত্ত্বজ্ঞানী পিঁপড়া বুঝিয়ে বলল, দৃশ্যমান কলম, আঙুল, হাত-বাহু বা মানব দেহের যে ভূমিকা দেখছ, মনে করো না যে কাগজের গায়ে লেখার পেছনে এদের শক্তি ক্রিয়াশীল। দেখো না, যখন মানুষ ঘুমায় কিংবা মারা যায়, তখন সবই অকেজো নিথর পড়ে থাকে। কাজেই দৃশ্যমান বস্তুগুলো লেবাস পোশাকের মতো। মূল হলো অবস্তু বুদ্ধি ও প্রাণ। মাথার বুদ্ধি যখন সক্রিয় হয় বা প্রাণে যতক্ষণ স্পন্দন থাকে, ততক্ষণ এগুলো সক্রিয়। মওলানা রুমি (রহ.) আরো বলেন, সেই জ্ঞানী পিঁপড়াও এই সত্যদর্শন জানত না যে, দেহের মধ্যে যে প্রাণ ও মাথায় বুদ্ধি, যদি আল্লাহর ইচ্ছা তাতে আলোড়ন না আনে, তাহলে দেহ কর্মতৎপর হয় না, সব অসাড় নিথর পড়ে থাকে। আল্লাহর রহমতের পরশ উঠে গেলে বুদ্ধিমান লোকও আহম্মক গর্দভে পরিণত হয়।

যুল-কারনাইন লক্ষ করলেন, বেশ তো! কুহেকাফ পর্বত হয়েও মানুষের মতো কথা বলে। তাকে বললেন, তুমি তো দেখছি অনেক রহস্যজ্ঞানী। আমাকে আল্লাহর গুণাবলির মহানত্ব সম্পর্কে একটু ধারণা দাও। কুহেকাফ সাফ জবাব দেয়; জানেন তো, আল্লাহর গুণাবলির মহিমা, তার বিশালতা, তা কি মানুষের মুখে উচ্চারণ করা সম্ভব? সেই বুকের পাটা আছে কারো?

শত হাজারো লক্ষ কোটি কলম একত্র হয়ে সাত সাগর তেরো সমুদ্রের পানি কালি বানিয়ে লিখলেও কি শেষ হবে তার গুণগান?

‘পৃথিবীর সকল গাছপালা যদি কলম হয় আর সমুদ্র হয় কালি এবং তার সঙ্গে আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয়, তবুও আল্লাহর বাণী নিঃশেষ হবে না। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের সকলের সৃষ্টি ও পুনরুত্থান একটি প্রাণীর সৃষ্টি ও পুনরুত্থানেরই অনুরূপ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা লুকমান : আয়াত-২৭, ২৮)।

যুল-কারনাইন বললেন, হে তত্ত্বজ্ঞ, মহাজ্ঞানী কূহেকাফ! আল্লাহর গুণাবলির বিস্ময়কর হাকিকত পুরোপুরি বলতে না পারলেও অন্তত একটি রহস্য খুলে বলো, আমার মনে সান্ত¡না দাও। পর্বত বলল, বাদশাহ নামদার! অস্তিত্বের যিনি বাদশহ, তিনি পর্বতগামী ৩০ বছরের দীর্ঘ মরুপথকে বরফ আর বরফের পাহাড় দিয়ে স্তূপ করে রেখেছেন। শুধুই বরফ আর বরফের হিমালয়, অসংখ্য অগণিত, জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত প্রলম্বিত। এরূপ বরফের আস্তরণ আড়াল যদি না থাকত, তাহলে দোযখের উত্তাপ আমাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিত।

সৃষ্টিলোকের বিস্ময় এই বরফের কাহিনির পর শুনুন আরেক হাকিকত, এই জগতে যারা হাকিকত সম্পর্কে অজ্ঞ গাফেল, তারা জ্ঞানীদের সম্মুখে আড়াল আচ্ছাদন। যারা দুনিয়াদার, দুনিয়া নিয়ে মত্ত তাদের রূহ এমন জমাট বরফে আচ্ছাদিত, যা হকিকতের তত্ত্ব-জ্ঞানীদের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। এরাও যদি অবহেলা মূর্খতা ঝেড়ে হাকিকতের সন্ধানী হত, তাহলে হাকিকতের তাজাল্লি ও নুরের বিচ্ছুরণে সবাই জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যেত। তত্ত্ব-জ্ঞানীরা বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের মতো। অজ্ঞদের অজ্ঞতা রাবারের আস্তরণের মতো। যদি এই তারের ওপর রাবারের প্রলেপ না হত, বৈদ্যুতিক অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু ছারখার হয়ে যেত।

আগুনের কথা বলছি। আগুনের আঁধার দোজখ। দোজখ আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের স্ফুলিঙ্গমাত্র। কত ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে দুনিয়ার আগুন। পরকালে দোযখ কত ভয়াবহ চিন্তা করো। তবে আরো বিস্ময়কর সত্য হলো, ‘আল্লাহর রহমত তার গযবের ওপর অনেক প্রবল।’ বান্দার প্রতি তার ক্রোধকে মুহূর্তে প্রশমিত করে শান্তির পরশ বুলাতে পারে রহমত। চিন্তা করো, এই রহমতের হাকিকত কত বিশাল। হ্যাঁ, চিন্তা করে কুল-কিনারা তুমি পাবে না সহজে। কারণ তোমার জ্ঞানবুদ্ধি অতি নগণ্য। গভীরে গেলে দেখবে আল্লাহর কহরের মধ্যেই লুকায়িত অফুরান রহমত।

যত বড় জ্ঞানী হোক কোথাও গিয়ে দিকহারা হয়ে উত্তর দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম উল্টে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি, এমন দাবি করতে পারবে না কেউ। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার এটি হাতেনাতে প্রমাণ। কাজেই সৃষ্টিলোকের বিস্ময় আর আল্লাহর রহমত ও গজবের স্বরূপ যদি বুঝে না আসে, অস্বীকার করতে যেও না, ধ্বংস হয়ে যাবে। বরং নিজেকে সঁপে দাও তার কাছে। বুকের ও মুখের ভাষায়, তোমার আচরণে বলো-

চোনকে হায়রা’ন গশতী ও গীচ ও ফানা’

বা’ যবা’নে হা’ল গোফতি ইহদিনা’

যখন দিশেহারা বিহ্বল হয়ে যায় চেতনা

অন্তর খুলে মাগো হেদায়াত, বলো ইহদিনা। (৪খ. ব-৩৭৫২)

‘প্রভু হে! সরল পথে করো আমাদের চালনা।’

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩৭১১-৩৭৫৪)

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত