ঢাকা ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪/১৯৮)

তৃণলতা-বৃক্ষরাজি স্রষ্টার সিজদায়রত

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
তৃণলতা-বৃক্ষরাজি স্রষ্টার সিজদায়রত

জ্যোতির্ময় সাতজন পুরুষের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অবাক বিস্ময়ে। এ বিস্ময় বিহ্বলতায় রূপ নিল- যখন দেখলাম, সাতজনের প্রত্যেকে একেকটি গাছে রূপান্তরিত হলো। আধ্যাত্মিক সফরে সাগর তীরে দাঁড়িয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন দাকুকি। তিনি বলেন, সেই গাছের ঘনসন্নিবিষ্ট পাতাপত্তরে সবুজের সমারোহ ছিল চোখ জুড়ানো। গাছের ডালপালা মুখ লুকিয়ে আছে পাতাবাহারের স্তূপে। তাকিয়ে দেখি, এখানে পাতপত্তর কই, সবই তো ফল আর ফল। এমন গাছের বর্ণনা দেয়ার সাধ্য কার আছে! শাখাগুলো প্রসারিত বিস্তারিত আকাশজুড়ে। মনে হচ্ছে আকাশ ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে ঊর্ধ্বজগতের সীমানাবৃক্ষ সিদরাতুল মুন্তাহায়। আরো উপরে নিঃসীমশূন্যতায় প্রসারিত গোটা অস্তিত্ব জগতজুড়ে। এদিকে গাছের শিঁকড় প্রোথিত সাত তবকা জমিন ভেদ করে তাহতাস সারায়। শিকড়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, মনে হয় শাখার চেয়েও উজ্জ্বল, মাটির গভীরেও ঠিকরে পড়ছে জ্যোতির দ্যুতি। শাখায় শাখায় রসেঠাসা ফলের থোকা এই বুঝি ফেটে যাবে পরিপক্বতায়।

দাকুকি আরো বলে যান : আমার কাছে আরো বিস্ময়কর হলো, শত-হাজারো মানুষ চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে অথচ কেউ তাকাচ্ছে না এসব গাছের দিকে। মরুভূমির মুসাফির, একটুখানি ছায়ার পরশ পাওয়ার জন্য কাপড় চাদর মাথায় টানিয়ে চলে। তীব্র দহন মরুভূমির লু হাওয়ায় প্রাণ যায় যায়; অথচ সবুজের সমাারোহে দাঁড়ানো এসব গাছ তারা দেখতে পাচ্ছে না বড় আশ্চর্য! অজ্ঞতার অন্ধত্বে তারা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য দিশাহারা। এ অবস্থার আসল কারণ বলি,

খত্ম কর্দে কাহরে হকবর দীদেহা

কে নবীনদ মাহরা’বীনদ সুহা

আল্লাহর কহর অন্ধ করে দিয়েছে দুচোখ দৃষ্টিহারা

তাই দেখে না পূর্ণিমা চাঁদ দেখে মিটিমিটি তারা।

এত লোক পাশ দিয়ে গমনাগমন করে অথচ তাদের চোখ স্থির হয় না এসব বৃক্ষে সবুজের সৌরভ দেখে। হীনতুচ্ছ জিনিসের প্রতি তাদের একমাত্র নজর। জীবনকে মহিমান্বিত করবে এমন শিক্ষা ও আদর্শের নাই কদর। দুনিয়াকে লুটেপুটে খাওয়ার উন্মাদনায় তারা চোখ থেকেও অন্ধ। সত্য সুন্দরের বাহক আল্লাহর অলিদের দেখার সাধ্য তাদের নেই। আসল কারণ আল্লাহ তাদের দিলের ওপর মোহর মেরে দিয়েছেন। এ কারণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখে; কিন্তু আগুনের উৎস সূর্যকে দেখে না।

যাররেয়ী রা বীনদ ও খোরশীদ নেই

লে কে আযলুতফোকরম নোমীদ নেই

দেখে অণু স্ফুলিঙ্গ অথচ সূর্য দেখার শক্তি নেই

তবুও তার দয়া রহমত হতে নিরাশ হতে নেই।

দাকুকির বিস্মিত জিজ্ঞাসা, হে আল্লাহ! এ কেমন দৃশ্য! মানবজাতি কাফেলার পর কাফেলা আসে আর যায়। ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত তারা। অথচ তাদের চলার পথে থোকা থোকা পাকা ফল ঝুলে আছে, সেদিকে ফিরে তাকায় না। দুনিয়াবি ধারণা কল্পনার ধূ ধূ ময়দানে অনাহারে পিপাসায় হাহাকার করে। অথচ যে আবেহায়াত ইহ-পরকালকে সৌভাগ্যমণ্ডিত করবে তার কাছে আসে না। আশ্চর্য? তারা কি তাহলে জাদুগ্রস্ত! আল্লাহর প্রিয়বান্দা মহাপুরুষদের প্রতীক ফলে ফুলে ভরা এসব গাছ থেকে সত্য সুন্দরের উপহার নেয়ার সৌভাগ্য যে তাদের হচ্ছে না! অথচ গাছেরা তাদের ডাক দিয়ে যায় :

গোফতে হারবর্গোশে কোফায় অন গুচুন

দম বেদম ইয়া লাইতা কওমি য়া-লামুন

গাছের শাখের প্রতিটি পাতা ও কিশলয় ডাকে

প্রতিনিঃশ্বাসে ‘হায় যদি বুঝত আমার কওম’ বলে।

সূরা ইয়াসীনে বর্ণিত আল্লাহর পথে আহ্বানকারী হাবিব নাজ্জার এর মৃত্যুকালীন ফরিয়াদ ছিল, ‘হায় আমার কওম যদি জানত কী কারণে আমি ক্ষমা পেয়েছি এবং দোযখের শাস্তি হতে আমার নাজাত নসিব হয়েছে?’

মওলানা রুমি বলেন, পৃথিবীতে মানবসমাজে অজ্ঞাত পরিচয় আল্লাহর অলিরা এভাবেই বান্দাদের ডাকে, এসো আল্লাহর পথে মাগফেরাত ও রহমতে জীবনকে ধন্য করার সাধনায়। এক পর্যায়ে আল্লাহর আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠে বলে, আমি তাদের এত নেয়ামত দিয়েছি এরপরও তারা আমাকে চেনে না, আমার কাছে আসতে চায় না; এমনকি আমার পথে আহ্বানকারীদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে, নির্যাতন করে, আমি তাদের দিলের ওপর মোহর মেরে দিলাম। এরা গোমরাহিতে দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে। তাদের কোনো আশ্রয়স্থল নেই।

এর ফল হয়েছে, যখন তাদের কেউ দরদি কণ্ঠে ডাকে, ওহে তোমরা এদিক হয়ে যাও। এসব গাছের ফলফুল নিয়ে জীবনকে সাজাও, তারা অবজ্ঞায় জবাব দেয়, কী বল, কতক মিসকিনের কাছে আমরা যাব। এদের কপালটাই মন্দ। ধার্মিকতার দোহাই দেয়। দুনিয়ার উন্নতি অগ্রগতি চেনে না। লাভক্ষতি বুঝে না। ধার্মিক বটে, তবে আহমক। বোকাণ্ডনির্বোধ।

আহ্বানকারী তখন অবাক হয়ে যায়। ভাবে, জীবনজাগানো হেদায়তের পথে ডাকার পরও তারা কীভাবে এমন জওয়াব দেয়? আল্লাহর অলিদের সাহচর্যে এসে ইসলামের সৌন্দর্য চর্চার এমন সুযোগ কীভাবে হাতছাড়া করতে পারছে? এদের দেখলে তো মনে হয় না জ্ঞানবুদ্ধিতে ঘাটতি আছে। বিচক্ষণতায় কলাকৌশলে দুনিয়াটা জয় করতে চায়। দুনিয়ার লাভক্ষতি সব বুঝে, অথচ জীবনের আাসল মুনাফার হিসাব বুঝে না। গোমরাহীর চাদরমুড়ে পড়ে থাকে। দ্বীনের পথে আসে না। দ্বীনদারদের সাহচর্য পেতে উৎসাহী হয় না।

প্রভু হে! আমি যে বলছি, ওরা জ্ঞানীবুদ্ধিমান হলেও আসলে পাগল। আমার অনুমান কি সঠিক, নাকি আমি নিজেই পাগল? শয়তান বুঝি আমার ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে। আমি কী ঘুমের মাঝে এসব কথা বলছি? হাতে চোখমলা দিয়ে দেখছি, নাহ, আমি তো ঘুমের ঘোরে বা স্বপ্ন দেখছি না। আমি জাগ্রত। আল্লাহর অলিদের সাজানো বাগানে আমি পায়চারীরত। ইসলামের সৌন্দর্য, জ্ঞানের ফুলমূল আহার করে আমি পরিতৃপ্ত।

দাকুকির সন্দেহ-সংশয়ের অবসান হয় না। আহ! কেন এমন হবে, আল্লাহর পয়গাম্বররা হেদায়তের এমন বাগান সাজানোর পরও কেন তারা জীবন জাগার ফলমূল থেকে বঞ্চিত হবে? সত্যের দিকে মানুষ আকৃৃষ্ট হবে না, কোথায় যাবে? তাদের এই গোড়ামির পরিণামইবা কী হবে? আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের এই মনোবেদনা এত তীব্র দুঃখভরা যে স্বয়ং নবীরাসূলরাও সময়সময় নিরাশ হয়ে পড়েছেন।

হাত্তা ইযা মাসতাইআসাররুস্লুবগূ

তা বে যন্নু আন্নাহুম কাদ কুযযিবূ

এমনকি রাসূলরা পর্যন্ত যখন নিরাশ হয়ে পড়বে

লোকেরা বলবে আমাদের সঙ্গে মিথ্যা বলা হয়েছে।

মওলানা এখানে কোরআন মাজিদের একটি আয়াতের তাফসির বিশ্লেষণ করেছেন। পত্রিকার পাতায় জটিল বিশ্লেষণে যাওয়ার অবকাশ নেই। আয়াতখানির ভাষ্য :

‘অবশেষে যখন রাসূলরা নিরাশ হলো এবং লোকেরা (কাফেররা) ভাবল যে, রাসূলরাকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তখন তাদের কাছে সাহায্য এলো। এভাবে আমি যাকে ইচ্ছা করি সে উদ্ধার পায়। অপরাধী সম্প্রদায় হতে আমার শাস্তি রদ করা যায় না।’ (সুরা ইউসুফ : ১১০)।

এবার দাকুকির কাছে গিয়ে জানব তার মনে আর কোনো বিস্মিত জিজ্ঞাসা আছে কি না।

হ্যাঁ, আল্লাহর পথে যারা অবিচল তাদের বিরুদ্ধে দুনিয়াদাররা এমন এমন চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে, তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়, যা স্বয়ং নবীরাসূলদের মধ্যেও হতাশা নিরাশার ছায়া বিস্তার করে আর তাদের সাথী মোমিনরাও সন্দেহের মধ্যে পড়ে যায় যে, নাফরমানদের শাস্তির ব্যাপারে বুঝি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

কাফের নাফরমানরাও বলে, নবীরাসূল, আল্লাহর অলিরা যেসব নেয়ামতের ওয়াদা দেন, তা তো আমরা চোখে দেখি না। তাদের কাছে এলে জীবন ধন্য হবে, সৌভাগ্যের বসন্তবায়ু প্রবাহিত হবে এসব কই কোথায়? মওলানা রুমি বলেন, এই জিজ্ঞাসা আবু লাহাবেরও ছিল। গোমরাহিতে নিমজ্জিত থাকার কারণে আল্লাহর নবীর চরিত্রের সৌন্দর্য, মানবীয় গুণে সজ্জিত হওয়ার জীবন দর্শনের মহিমা সে বুঝতে পারেনি।

ভাবনার জগতে অনেক সময় চলে গেল। এবার সাতটি গাছে সবুজের সমারোহের কাছে আমাদের নিয়ে চল। দাকুকি বলেন, গাছগুলোর চক্ষুশীতল করা সবুজের কোমলতায় আমি ভাগ্যবান। আমি তাদের ছায়ায় আশ্রয় নিতে আরো এগিয়ে গেলাম। দেখি, সাতটি গাছ এখন একটি গাছে রূপান্তরিত হলো। বুঝলাম এখন বহুত্ব হতে একত্বে উপনীত হয়েছি। কিন্তু আমার বিস্ময় সীমা ছাড়িয়ে গেল, যখন দেখলাম,

হাফতমী শুদ ফর্দ মী শুদ হার দমী

মন ছে সানগশতম আয হায়রত হামী

প্রতি মুহূর্তে সাত গাছ হয়ে যায় এক পরক্ষণে

সেইএকটিই হয়ে যায় সাত, বিহ্বল-বিস্ময়ে।

আমার বিস্ময়ের সীমা নেই এখন। আমি হতবিহ্বল। বহুত্ব হতে একত্ব, আবার একত্ব হতে বহুত্বের এমন প্রদর্শনী আমার জীবনে প্রথম।

বাদ আযঅ”ন দীদম দেরাখতান দর নামায

সাফকশীদে চোনজামাআত কর্দে সাজ

এরপর দেখি গাছেরা দাঁড়িয়ে গেছে নামাজে

কাতারবদ্ধ প্রস্তুতি বুঝি এখনি জামাত হবে। (২০৪৮)

য়্যক দেরাখত আয পীশমানন্দে ইমাম

দীগরান আন্দরপসে উ দর কেয়াম

সম্মুখের একটি গাছ এগিয়ে গেল ইমামের মতো

অন্যরা পশ্চাতে সারিবদ্ধ দাঁড়াল মুক্তাদি সম।

দাকুকির বিস্ময় শেষ হয় না যখন দেখে, সাতটি গাছ রুকুতে নত হচ্ছে আবার সিজদায় লুটিয়ে পড়ছে। তার ধারণা ছিল, নামাজ শুধু মানুষের জন্য। মানুষই দাঁড়াবে, রুকুতে যাবে আবার সিজদায় লুটিয়ে পড়বে আল্লাহর সমীপে। পরক্ষণে মনে পড়ে গেল কোরআনের একটি আয়াতের বাণী: ওয়াননাজমু ওয়াশশাজারু ইয়াসজুদান; ‘তৃণলতা ও বৃক্ষরাজি তারই সিজদায় রত।’ (সুরা আররহমান : ৬)।

ইন দেরাখতান রা ন যানু ন মিয়ান

ইন ছে তরতীবে নামাযআস্ত অন চুনান

এসব গাছের না আছে হাঁটু না আছে কোমর তবু

নামাজের তরতিবে করে কিয়ামণ্ডসিজদা ও রুকু।

হ্যাঁ, তৃণলতা, বৃক্ষরাজি আল্লাহর সমীপে নামাজ পড়ে। যাদের আধ্যাত্মিক দিব্যদৃষ্টি আছে তারা তা অবলোকন করে। গাছ তরুলতা আল্লাহর সমীপে রুকু করে আবার সিজদয় লুটিয়ে পড়ে। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এসব। দাকুকির বিস্ময় শেষ হলো, যখন আল্লাহর পক্ষ হতে তার দিলে ইলহাম এলো।

আমদ ইলহামে খোদা কাইবাফরুয

মী আজব দারী যে কারেমাহানুয

আল্লাহর তরফে ইলহাম আসে হে আলোকিত

আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য নিয়ে তুমি এখনো বিস্মিত?

(মসনবি শরিফ ৩য় খণ্ড. বয়েত-২০০৩-২০৩৫) মসনবি শরিফের উপর ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর নিয়মিত আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন - CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত