ভারতবর্ষের শীর্ষ আলেম শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী

মাহমুদ হাসান ফাহিম

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জন্ম ও বংশ পরিচয় : মুসনাদুল হিন্দ হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) শাওয়াল ১১১৪ হিজরি মোতাবেক ১৭০২ খ্রি. বুধবার সূর্যোদয়ের সময় বর্তমান ভারতের মুজাফফর নগর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শাহ আব্দুর রহীম ও মাতা ফখরুন্নিসা রহ.। উপনাম আবু মুহাম্মদ। তিনি পিতার বংশের দিক থেকে হজরত ওমর ফারুক (রা.) আর তার মায়ের বংশ হজরত মূসা কাযিম (রহ.) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে।

শিক্ষা দীক্ষা : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে যান এবং সাত বছর বয়সে পবিত্র কোরআনের হিফজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর ফারসি ও আরবি ভাষার কিতাবাদি শুরু করে কাফিয়া শেষ করেন। দশ বছর বয়সে শরহে মোল্লা জামি আরম্ভ করেন। আর পনের বছর বয়সে প্রচলিত নেসাবের ফেকাহ, উসূলেফেকাহ, মানতিক, কালাম, সুলুক, হাকায়িক, তিব্ব, ফালসাফা, ইলমে মা’আনি, জ্যামিতি এবং অঙ্কশাস্ত্রের কিতাবাদি সমাপ্ত করে ফারেগ হন। তার ফারেগ হওয়ার খুশিতে পিতা বড় ধরনের দাওয়াত ও যিয়াফতের আয়োজন করেন। এতে সর্বস্তরের জনতা শরিক হন।

হাদিস ও তাফসির শিক্ষা : পনের বছর বয়সে তিনি হাদিস ও তাফসির শিক্ষা আরম্ভ করেন এবং পিতার কাছে, মিশকাত শরিফ, বায়যাবি শরিফ, মাদারিকুত তানযীলসহ হাদিসের বেশ কয়েকটি কিতাব পড়েন।

দারস ও তাদরিস : কর্মজীবনে হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) দারস ও তাদরিসে আত্মনিয়োগ করেন এবং পিতার মৃত্যুর পর ১২ বছর পর্যন্ত মাদ্রাসায়ে রহিমিয়ায় ইলমে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দেন।

বিবাহ ও সন্তানাদি : শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) এর বয়স যখন চৌদ্দ তখন মামা ও শায়খ উবায়দুল্লাহ পুলতী (রহ.) এর সুযোগ্য মেয়েকে জীবন সঙ্গিণী হিসাবে গ্রহণ করেন। এই ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এই স্ত্রীর ঘরে তার চার ছেলের জন্ম হয়। (১) সিরাজুল হিন্দ শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) (২) শাহ রফীউদ্দীন দেহলভী (রহ.) (৩) শাহ আবদুল কাদির দেহলভী (রহ.) এবং (৪) শাহ আবদুল গনী দেহলভী (রহ.)।

বায়আত ও খেলাফত : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) পনের বছর বয়সে নকশবন্দিয়া তরিকায় পিতার হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং সতের বছর বয়সে ইজাযত ও খেলাফত লাভে ধন্য হন।

যিয়ারতে হারামাইন : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) ত্রিশ বছর বয়সে পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা যান এবং একই সফরে দুই দুইবার হজ আদায় করেন।

উচ্চশিক্ষা লাভ : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) পবিত্র হারামাইনে মোট চৌদ্দ মাস অবস্থান করেন। এ সময় তিনি উলামায়ে হারামাইন থেকে ইলমি ইন্তিফা হাসিল করেন। বিশেষকরে শায়খ আবু তাহির মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম কুরদি মাদানি (রহ.) শায়খ ওফদুল্লাহ মালিকি মক্কি (রহ.) এবং শায়খ তাজুদ্দীন হানাফি মক্কি (রহ.) প্রমুখের কাছ থেকে সিহাহ সিত্তাসহ হাদিসের বিভিন্ন কিতাবের দারস গ্রহণপূর্বক ইজাযত লাভ করেন। অবশেষে ১১৪৫ হিজরিতে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

ইলমে কেরাআত শিক্ষা : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) চল্লিশ বছর বয়সে পুরো কোরআনে কারীম কারী মুহাম্মদ ফাযিল সিন্ধি (রহ.) এর কাছে ইমাম হাফসের রেওয়ায়েতে শিক্ষা করেন।

সমাজ সংস্কার : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) হজ থেকে দেশে ফিরে দারস ও তাদরিসের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণে ভূমিকা রাখেন। তার সংস্কারমূলক কর্মসূচির মধ্যে ছিল-(১) শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার ও প্রচলিত নেসাব পরিবর্তন (২) সুন্নাত-বিদআতের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ। (৩) ইসলামের নামে শিয়াদের ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস খণ্ডন (৪) মানব প্রকৃতির সঙ্গে ইসলামি বিধি-বিধানের সঙ্গতি-সামঞ্জস্যশীলতাকে যৌক্তিক ও প্রামাণিক রূপে উপস্থাপন। (৫) ভণ্ড পীর-মুরীদদের মনগড়া কথাবার্তার অসারতা প্রমাণ। (৬) ধর্মীয় বিভিন্ন দল-উপদলকে একতাবদ্ধকরণ। (৭) পবিত্র কোরআনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে মাতৃভাষা ফারসিতে আল-কোরআনের অনুবাদ। (৮) হাদিসে রাসুলের প্রচার-প্রসার ইত্যাদি। মোটকথা তিনি দারস ও তাদরিস, ওয়াজ-নসিহত ও লেখনীর মাধ্যমে যে অবদান রাখেন তা কেয়ামত পর্যন্ত বিলুপ্ত হওয়ার নয়।

রচনাবলি : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রাহ.) হাদিস, তাফসির, উসুলে তাফসির, তাসাউফ ও আসরারে শরিয়ত ইত্যাদি বিষয়ে ছোট-বড় অনেক কিতাবাদি রচনা করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’টির নাম নিম্নে প্রদত্ত হলো- ফতহুর রহমান ফি তরজমাতিল কোরআন, আল ফাউযুল কাবীর ফী উসুলিত তাফসির, মুছফ্ফা, মুছাওওয়া শরহু মুআত্বা, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ইযালাতুল খাফা ইত্যাদি।

ইন্তেকাল : হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) আজীবন দেশ, জাতি ও দ্বীন ইসলামের বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে ২৯ মুহাররম ১১৭৬ হি. মোতাবেক ২০ আগস্ট ১৭৬৩ খ্রি. রোজ শনিবার জোহরের সময় ইন্তেকাল করেন। পিতার মাজারের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।

লেখক: শিক্ষক, বাইতুল আকরাম মসজিদ ও মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, টঙ্গী গাজীপুর