মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪/১৯৯)

সুখী জীবন লাভের রহস্য

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কথায় বলে স্বভাবের দোষ। কারণ দোষগুলো লুকিয়ে থাকে মানব স্বভাবের গহিনে। সন্তর্পণে সামনে এসে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি, মনুষ্যত্ববোধের পায়ে জিঞ্জির-বেড়ি পরিয়ে দেয়। আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির পথ রুখে দাঁড়ায় নাছোড় বান্দা হয়ে। চারটি স্বভাব তো খুবই মারাত্মক। লোভ, যৌন কামনা, প্রতিপত্তির মোহ ও বিলাসী কল্পনা। মানব স্বভাবের এসব দোষ চিহ্নিত করেছেন চরিত্র বিজ্ঞানীরা নানাভাবে। মসনবি শরিফে মওলানা রুমিও বিশ্লেষণ করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের একটি ঘটনাকে উপজীব্য করেছেন, তিনি কোরআন মাজিদ হতে চয়ন করে।

ইবরাহিম (আ.) একবার কোথাও যাচ্ছিলেন, পথের ধারে দেখলেন একটি মরা লাশ পচে-গলে পড়ে আছে পানির গর্তে। হিংস্র প্রাণী আর শকুনরা লাশটি নিয়ে টানাটানি করছে। ইবরাহিম (আ.)-এর চিন্তায় এলো, মরা লাশাটি তো খন্ডখন্ড হয়ে বিভিন্ন প্রাণীর পেটে চলে যাচ্ছে, কীভাবে সে অখণ্ড দেহ নিয়ে হাশরের দিন পুনরুজ্জীবন লাভ করবে? যতই চিন্তা করেন মন প্রবোধ পায়, জবাব খুঁজে পান না। অবশেষে ফরিয়াদ জানান আল্লাহর দরবারে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে-

‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম বলল, হে আমার প্রতিপালক! কীভাবে তুমি মৃতকে জীবিত করবে আমাকে দেখাও। আল্লাহ বললেন, তবে কি তুমি বিশ্বাস কর না? ইবরাহিম বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করি, তবে (দেখতে চাইছি) আমার মনে যেন সান্ত¡না লাভ করতে পারি। আল্লাহ বললেন, তাহলে তুমি চারটি পাখি ধরো, তারপর এগুলোকে তোমার পোষ্য বানিয়ে নাও। তারপর সেগুলো (জবাইয়ের পর) এক এক অংশ এক এক পাহাড়ের ওপর রেখে এসো। অতঃপর সেগুলোকে ডাক দাও, (দেখবে যে) ওরা দ্রুত দৌড়ে তোমার নিকট চলে আসবে। আর জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, অতিশয় প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা বাকারা : আয়াত-২৬০)। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ পালন করলেন। বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে তিনি বুঝে নিলেন, মৃত্যুর পর হাশরের দিন পুনরুজ্জীবন লাভের ব্যাপারটিও এভাবেই ঘটবে।

সেই চার পাখি কোন কোন জাতের ছিল এবং মানব চরিত্রের কোন কোন স্বভাবের সাথে ওদের মিল ছিল, তা নিয়ে মুফাসসির ও তত্ত্বজ্ঞানীরা নানা বিশ্লেষণ করেছেন। কারো মতে, এই চার পাখি ছিল, কাক, ময়ুর, শকুন ও মোরগ। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, এই চার পাখি ছিল কাক, মোরগ, ময়ুর আর কবুতর। তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেছেন, কাক হলো লোভের প্রতীক। মোরগ যৌনকামনার প্রতীক, শকুন দীর্ঘায়ুর বাসনা আর ময়ুর আত্মপূজার পরিচয়বাহক। তারা বলেছেন, সফল, সুন্দর, চিরন্তন জীবন লাভ করতে হলে মানুষকে মনের এই চার পাখি জবাই করতে হবে। লোভ, যৌনতা, দীর্ঘায়ুর বাসনা ও বিলাসী কল্পনা দমন করতে হবে। মওলানা রুমিবিষয়টিকে মনোজ্ঞ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, যা যে কোনো চিন্তাশীল মানুষের মন ও জীবন ছুঁয়ে যায়। মওলানার ভাষায়-

চার পাখির প্রতিটি কাকের মতো জ্ঞানী লোকদের জ্ঞানবুদ্ধি, বিবেচনাবোধের চোখ তুলে নেয়। কাক কোনো লাশের ওপর বসে প্রথমে লাশের চোখটা খুলে নেয়। মানব স্বভাবের এই চারটি দোষও মানুষকে অন্ধ করে জীবনের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে।

যারা মানুষের হেদায়তের দায়িত্ব পালন করেন তাদের উদ্দেশ্যে মওলানা বলেন, ইবরাহিম (আ.) এর পাখি জবাইর মতো মানব চরিত্রের এই চারটি স্বভাবকে বধ কর, তবেই মানুষের প্রকৃত মুক্তির পথ উন্মোচিত হবে। কারণ এসব স্বভাব মানুষের দ্বীন, ঈমান হরণ করে, মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে। এই বধ করার অর্থ সম্পূর্ণ ধ্বংস করা নয়; বরং একান্ত বাধ্যগত, নিয়ন্ত্রিত ও ও বশীভূত করা। কারণ জীবন চলার পথে এগুলোরও প্রয়োজন আছে বাহনরূপে। তাই কৃচ্ছ্রতার কষাঘাতে দলন-দমন চালানোর পর এগুলোকে কাজে লাগাতে হবে নতুনভাবে।

বা’যশা’ন যিন্দা কুন আয নূয়ী দিগার

কে নবা’শদ বাদ আয আ’ন যীশা’ন যরর

তারপর এগুলো জিন্দা কর, পুনরায় নতুনরূপে

এরপর যেন কদাচ তোমার ক্ষতি না করতে পারে।

তোমার স্বভাবের সুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়ে তোলো। এসব বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্য ও হাসানাত দিয়ে যত দোষ সাইয়েআত আছে সেগুলোকে চরিত্র সুষমায় রূপান্তরিত কর। ধন-সম্পদের যে লোভ তোমার মনে, তা জ্ঞানার্জনের লোভে বদলে দাও। দুনিয়াকে ভোগ করার কামনার স্থলে আধ্যাত্মিক উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় মনকে তৈরি করো। যৌনতার গলায় লাগাম পরিয়ে বৈধ সম্পর্কের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত করো। মওলানা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, চারটি আত্মিক পাখি মানুষের অন্তরের সামনে ডাকাত সেজে রয়েছে। এগুলোকে প্রতিহত করো, দেখবে চিরন্তন জীবন উপভোগ করার পথ তোমার সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

বাত হেরাচ আস্তো খুরূস আন শাহওয়াত আস্ত

জা’হ চোন তাউস ও যা’গ উমনিয়্যত আস্ত

হাঁস তো লোভের প্রতীক, মোরগ যৌনতার কামনা

খ্যাতি-ক্ষমতার লিপ্সা ময়ূর, কাক বিলাসী কল্পনা।

লোভের কাছে বন্দি কাকের জীবন। পাক-নাপাক চায় না, যা পায় কুড়িয়ে খায়। হাঁসের অবস্থাও তাই। ঠোঁটখানা উঁচিয়ে শুধু চষে বেড়ায়। পানিতে বা ডাঙ্গায় শুধুই খাবার খোঁজে। এক মুহূর্তও বিরাম নাই তার কণ্ঠনালীর। আল্লাহর হুকুম, ‘তোমরা খাও আর পান করো’ সেটিই বুঝি সে বুঝে। লোভী ব্যক্তির অবস্থাও তাই। সে চোরের মতো গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকে এদিক সেদিক হাতড়ায়। যা কিছু পায় কুড়িয়ে পালায়। বাছ-বিচার করার ফুরসত তার নাই, কখন গৃহস্থ জেগে উঠে, অন্য চোর এসে ভাগ না বসায় সেই আতঙ্ক তাড়া করে। শহরে একজন শাসক আছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেন, সে আস্থা তার নাই। এমন চিন্তায় যারা লালিত তারা যেভাবে পায়, যত পায়, ততই কুড়ায়, হারামণ্ডহালালের বালাই নাই। দুনিয়াকে ভোগ করা, সম্পদের পেছনে জীবন উজাড় করা তাদের জীবনের সাধনা।

লে কে মু‘মিন যে‘তেমা’দে অ’ন হায়া’ত

মী কুনদ গা’রত বে মাহল ও বা’ আনা’ত

তবে যারা মুমিন পরজীবনে আস্থা রাখে

তারাও ভোগ করে, তবে শান্তি ও সম্ভ্রমে।

কাক স্বভাবের লোভী ও কামুকের মোকাবিলায় মু’মিন বান্দার অবস্থা হলো, সে পরকালীন জীবনের প্রতি আস্থাশীল। এই আস্থা ও বিশ্বাস তার জীবনে দিয়েছে পরম শান্তি ও সম্ভ্রমের উপহার। দুনিয়ার চাওয়া পাওয়া নিয়ে তার মনে অস্থিরতা নেই। দুনিয়ার সহায় সম্পদ সেও ভোগ করে, তবে তার চলনে বলনে সম্ভ্রম, ভদ্রতা, ব্যক্তিত্বের ছাপ থাকে। সে বিশ্বাস করে, আমার ভাগ্যে যা লেখা আছে, তা আমার হাতে আসবেই। কারো ভাগ্য কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে- সে তা বিশ্বাস করে না। কেন না, মহামহিম শাসকের ন্যায়বিচারের প্রতি তার পূর্ণ আস্থা। ফলে তার জীবনে বিরাজে পরম শান্তি, তার ব্যক্তিত্বে উদ্ভাসিত আস্থা ও সম্ভ্রমের দীপ্তি। তকদীরের নির্ধারিত হিসসা সে পাবেই, এ বিশ্বাস আছে বলেই কোনো কিছু হারানোর পরও হাহুতাশ করে না, হতাশায় ভোগে না। তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো,

বস তাআন্নি দা’রদ ও সবরো শাকীব

চশম সীর ও মুসের আস্তো পা’ক জীব

ধীরস্থির, শান্ত-স্বভাব, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা সহনশীল

নিলোর্ভ, কারো মুখাপেক্ষী নয়, পুতঃচরিত্র দানশীল।

মু’মিনের চাল-চলন বাস্তব জীবন দেখলেই বোঝা যাবে, এসব গুণ তার চরিত্র ও স্বভাবে উদ্ভাসিত। মহামহিম শাসকের নিয়ন্ত্রণে সে বিশ্বাসী, তাই তার চরিত্র পুতঃপবিত্র। আল্লাহর ওপর গভীর আস্থায়, তার কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার আশায় সে নিজের সম্পদ বিলায়। নিজের প্রয়োজনের ওপর অন্যের প্রয়োজনকে অধিক গুরুত্ব দেয়।

মওলানা রুমি আরো বলেন, মানব চরিত্রের ধীরস্থিরতা শান্তস্বভাব ও সম্ভ্রম, মূলত দয়াময় আল্লাহর রহমতের ঝলক। আরশ হতে সেই ঝলক মু’মিনের কলবে পতিত হয়। পক্ষান্তরে তাড়াহুড়া, জীবনে সব হারালাম, হায় হায় কী হবে আমার- এমন চিন্তার পেরেশানি শয়তানের প্রক্ষেপ; তাতে বেঈমান প্ররোচিত হয়, ছটফট করে অস্থিরতায়।

যাঁকে শয়তা’নশ বেতরসা’নদ যে ফকর

বা’রগীরে সবর রা’ বুকশাদ বে আকর

তাকে তাকে শয়তান ভয় দেখায় দারিদ্র্যের

ধৈর্যের অশ্ব বধ করে, করে তোলে অস্থির।

শয়তান দারিদ্র্যের ভয় দেখায়। বলে, যত পার যেভাবে পার তড়িঘড়ি কর, নগদ যা পাও হাত পেতে নাও। ভালো-মন্দ, বাছ-বিচাররের দরকার নেই। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে-

‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদের তার ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত-২৬৮)। যার অন্তর ঈমানের আলোয় আলোকিত নয়, তার জীবন চালিত হয় শয়তানের প্ররোচনায়। তাই তার জীবনে চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। যত পায় আরো চাই, শুধুই খাই খাই। হাদিস শরিফে এ কথাই বলা হয়েছে-

লা’ জরম কা’ফের খোরদ দর হাফ্ত বতন

দীন ও দিল বা’রীক ও লা’গর যফতে বতন

অগত্যা কাফের খায় সাত আঁতে উদর পুরে

অন্তর মরা,ক্ষীণকায় ধর্ম,তবে পেট উপচে পড়ে।

মওলানা রুমি (রা.) হাদিস শরিফের একটি শিক্ষাকে এখানে উপজীব্য করেছেন। বলেছেন, মুসলমানের জীবন ভোগের নয়, ত্যাগের। ইবনে উমর (রহ.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, কাফের আহার করে সাত আঁতে, আর মুমনি আহার করে এক আঁতে। (মুসলিম, হাদিস নং ২০৬০)। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত, ৩৪৩১-৩৫৪৩)

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI