ইসলামে জিনার শাস্তি

মুফতি দিদার শফিক

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জিনা কী? জিনা কাকে বলে? ইসলামের দৃষ্টিতে কখন যৌনক্রিয়াকে জিনা হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে? এটা আগে ইসলামি বিধিবিধানের আলোকে জানতে হবে। ইসলামি পরিভাষায় জিনা হলো, ‘ইসলামি বিধিবিধান কার্যকর করা হয়- এমন ইসলামি রাষ্ট্রে স্বেচ্ছায় জীবিত নারীর যোনিপথে হারাম সহবাস করাকে জিনা বলে। তবে স্ত্রী, স্ত্রীসদৃশ এবং স্ত্রী সন্দেহে কোনো নারীর সঙ্গে অথবা বাঁদি, বাঁদিসদৃশ কিংবা কারও অধিকার আছে এমন বাঁদির সঙ্গে যৌনকর্ম হলে সেটি জিনার আওতায় পড়বে না। (বাদায়েউস সানায়ে খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা-৩৩-৩৪, কামুছুল ফিকহি বং ৪, পৃষ্ঠা-১০৪)। আল্লামা জুরজানি আত-তারীফাত গ্রন্থে জিনার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, স্ত্রী হওয়ার সন্দেহমুক্ত ও বাঁদি হওয়ার মালিকানামুক্ত কোনো নারীর যোনি পথে সহবাস করাকে জিনা বলে। আলোচ্য দুটি সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম- স্ত্রী বা বাঁদির সঙ্গে অথবা স্ত্রী বা বাঁদি মনে করে কারও সঙ্গে যৌনকর্ম সংঘটিত হলে সেটি জিনা হিসেবে গণ্য হবে না। (এখানে মনে রাখতে হবে বাঁদি বলতে ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় যাদের বাঁদি বলা হয়, তাদের বুঝানো হয়েছে, আমাদের দেশের কাজে মেয়ে বাঁদি নয়, এরা স্বাধীন মহিলা, এদের সঙ্গে যৌনকর্ম করলে জিনা হিসেবে গণ্য হবে)। এছাড়া অন্যসব পর নারীর সঙ্গে নারীর ইচ্ছায় যৌনকর্ম সংঘটিত হলে সেটি জিনা হিসেবে গণ্য হবে। বলা হয়, দেশীয় আইনে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী স্বেচ্ছায় যৌনকর্ম করলে সেটা অপরাধ নয়। এ কথা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় নারী-পুরুষ অবৈধ প্রক্রিয়ায় যৌন সম্পর্ক করলেই সেটা জিনা হিসেবে গণ্য হবে। তবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে কিছু শর্ত প্রযোজ্য।

জিনার শাস্তি : নারীকে জোরপূর্বক যৌনকর্মে বাধ্য করা হলে নারীর ওপর, প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুর বিধান কার্যকর হবে না। [কামুছুল ফিকহি খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-১০৫] তবে যৌনকর্মে বাধ্যকারী পুরুষের ওপর জিনার শাস্তি জনসম্মুখে প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। এ শাস্তি বিবাহিত নারী-পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। যদি উভয়ে স্বেচ্ছায় যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, তাহলে এ বিধান। আর জিনাকারী অবিবাহিত হলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শাস্তি হলো একশত বেত্রাঘাত। আর অবিবাহিত হলে জিনাকারী পুরুষের শাস্তি হিসেবে কাজী তথা বিচারক চাইলে ১ বছরের জন্য জিনাকারীকে দেশান্তরিত করতে পারেন। দেশান্তরিত করার শাস্তি কার্যকর করা বা না করা কাজীর ইচ্ছাধীন। এটাই ওলামায়ে আহনাফের সিদ্ধান্ত। [মাআরিফুল কোরআন গ--৬, পৃষ্ঠা ৫২-৫৭ (উর্দু)]

ধর্ষণের সংজ্ঞায় বেঁচে যায় পাপী, বেড়ে যায় পাপ : বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সম্মতিতে কোন পুরুষ যৌন সঙ্গম করলে সেটা ধর্ষণ হবে না। ধর্ষণ হবে না মানে আইনগতভাবে এটা অপরাধ নয়। নারী ও পুরুষের সম্মতিতে যৌন সঙ্গমের আইনগত অনুমোদন রয়েছে একথা বুঝায়। ভীতিপ্রদর্শন করে যৌনকর্মে নারীকে বাধ্য করলে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী পুরুষ লোকটি ধর্ষক হবে। ইসলাম ও বলে পুরুষ জিনাকারী হবে শর্তসাপেক্ষে। আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় একটি শর্ত এমন আছে- প্রতারণামূলকভাবে তার (নারীর) সম্মতি আদায় করলে অর্থাৎ নারীর সাথে প্রতারণা করে নারীর সম্মতি আদায় করে তার সাথে উভয়ে সম্মতিক্রমে যৌনকর্ম করলে সেটা ধর্ষণ হবে।

এখানে দুটো বড় ফাঁক রয়েছে। ১. কেউ প্রতারিত হতে হলে আগে স্বেচ্ছায় তাকে কোনো কাজ করতে হয় বা প্রলুদ্ধ হতে হয়। প্রলুব্ধ হয়েই মানুষ সাধারণত প্রতারিত হয়। প্রলুদ্ধ হওয়ার মধ্যে অবশ্যই সম্মতি থাকে। এ সম্মতিকে প্রতারণামূলকভাবে শব্দ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ফলে বাহ্যত মনে হয় প্রতারিত হওয়াটা নারীর সম্মতি ছাড়া হয়। অথচ বাস্তবতা এর উল্টো। ২. অবৈধ লিভ টুগেদারের পথ খোলা রেখে একান্ত নিরোপায় অবস্থায় নারীর পক্ষে আইনি ভাষায় শাসানো হয়েছে মাত্র।

বিষয়টি একটু ক্লিয়ার করে বলা যায়,বর্তমান ইয়াং জেরারেশন চুটিয়ে প্রেম করছে। বয় ফ্রেন্ড গার্ল ফ্রেন্ড ছাড়া তাদের সময় কাটে না। কাউকে ভালো লেগেছে বগলদাবা করে তার সঙ্গে ছুটে বেড়াচ্ছে। ডেটিং হচ্ছে। মিট করছে পার্কে। রেস্টুরেন্টে। সময়-সুযোগ হলে এক ছাদের নিচে লিভ টুগেদারও হচ্ছে। উপভোগ করছে যৌবনকে। বিয়ের আগেই প্রেমিকের কাছে প্রেমিকা তার ভরা যৌবনের সব সঁপে দেয় ঘর বাঁধার আশায়, অগাধ বিশ্বাসে। প্রেমিকা যৌবনের তাড়নায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পর বা পরিবার মেয়েকে পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ দিলে, তখন প্রেমিকা সাধারণত প্রেমিককে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। ছেলেটি বিয়ে করতে অস্বীকার করলেই এর নাম হয় প্রতারণামূলকভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। সারকথা হলো, ১৬ বছরের অধিক বয়সের নারীকে তার সম্মতিতে যৌবন ভোগ করার রাষ্ট্রীয় আইনগত অধিকার দিয়ে এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব বাধার পূর্ব পর্যন্ত ‘স্বেচ্ছায় দেহদানকে’ প্রতারণা বা অপরাধ না বলা আইনে ধর্ষণ সংজ্ঞার বড় একটি ত্রুটি বা অপূর্ণাঙ্গতা।

এ সংজ্ঞাকে যদি উদাহরণের মাধ্যমে প্রকাশ করি, তাহলে এমন বলা যায় বিচারক মহাশয় বিড়ালের নাকের ডগায় শুঁটকি বেঁধে দিয়ে বিড়ালকে জোর নির্দেশ দিচ্ছেন- সাবধান! শুঁটকি কিন্তু খাসনে! বিড়ালের পক্ষে এ আদেশ মানা যেমন সম্ভব না, ঠিক তেমনি ধর্ষণের এ সংজ্ঞার মাধ্যমেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব না। সরকার যদি দেশে শান্তি চায়, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ রোধ করতে চায়, তাহলে ধর্ষণের স্থলে জিনার সংজ্ঞাকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ ও আন্দোলনে জনতা জেগে উঠায় সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে আইন পাস করেছে। এজন্য হাসিনা সরকারকে ধন্যবাদ। তবে পাশাপাশি জিনা-ব্যভিচারের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। জন সম্মুখে জিনা ও ধর্ষণের শান্তি কার্যকর করতে হবে। তাহলে গোটা জাতির মধ্যে ভয়ে কম্পন সৃষ্টি হবে। অপরাধপ্রবণতা, ধর্ষণের হার চোখের পলকে শূন্যের কোঠায় চলে আসবে। এর অন্যথা হলে আইন শুধু কাগুজে আইন থাকবে এর কোন ফল পাওয়া যাবে না। একটি আলোচিত ঘটনা থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়, আমরা দেখেছি প্রেমিক দিহান কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রেমিকা আনুশকার মৃত্যুতে সারা দেশে হৈ চৈ পড়ে যায়। পেপার-পত্রিকায় প্রকাশ, আইনি ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধী ধর্ষককে বাঁচানোর জন্য তার বয়স কমানো এবং ধর্ষিতের বয়স বাড়ানোর এক জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। দিহান-আনুশকা কেন্দ্রিক ধর্ষণ ঘটনায় পেপার-পত্রিকার সংবাদ, প্রতিবেদনই প্রমাণ করে দেশীয় আইনে ধর্ষণের বিচার যথাযথভাবে পাওয়া যাবে না। কারণ ধর্ষণের সংজ্ঞায়-ই ধর্ষক বেঁচে যাওয়ার যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর রয়েছে।

প্রেম-পরকীয়া বন্ধ হলে ধর্ষণ কমে যাবে : ধর্ষণ প্রেম-পরকীয়ার কাঁধে চড়ে সমাজে আসে। ১৬ বছরের বেশি বয়স হলে দেশীয় আইনও এ প্রেম-পরকীয়াকে মৌন সমর্থন করে। ফলে সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনা অশ্বগতিতে বেড়ে চলেছে। ধর্ষণের লাগাম টেনে ধরতে হলে প্রেম-পরকীয়াকে আগে বন্ধ করতে হবে। পর নারীর সঙ্গে নির্জনে পর পুরুষের দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করতে হবে। কেন না, হাদিসে পরনারীর সঙ্গে তার মাহরম ছাড়া নির্জনে পরপুরুষ সাক্ষাৎ করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসুল (সা.) কে বক্তব্য দেয়াকালে বলতে শুনেছি, কিছুতেই যেন কোনো পুরুষ কোনো মহিলার সঙ্গে নির্জনে সাক্ষাৎ না করে। তবে নারীর সঙ্গে কোনো মাহরাম (পুরুষ) থাকলে ভিন্ন কথা এবং মাহরাম ছাড়া কোনো মহিলা যেন সফর না করে। [বোখারি : ৩০০৬, মুসলিম : ৩২৭২, মুসনাদে ইমাম আহমদ : ১৯৩৪, দরুল হাদিস]

লেখক : মুহাদ্দিস ও মিডিয়াকর্মী