ঢাকা ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আল-কোরআনে তওবা ও ইস্তেগফারের ফজিলত

মুহাম্মাদ আব্দুল হাকীম
আল-কোরআনে তওবা ও ইস্তেগফারের ফজিলত

মানুষকে আল্লাহতায়ালা তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষ শয়তানের প্ররোচণায় পড়ে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে বসে, সেই ভুল শোধরানোর জন্য যে পথটি খোলা রেখেছেন তা হলো তওবা। বান্দা ভুল করবে এটা স্বাভাবিক। তবে ভুল করলেও পরক্ষণে আত্মসচেতন হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে আসুক, এটিই আল্লাহ পাক চান ও ভালোবাসেন। তওবা ও ইস্তেগফার মুমিনকে সর্বদা গোনাহমুক্ত জীবনের প্রতি অনুপ্রাণিত করে। মুমিনকে নিয়ে যায় ঈমান ও আমলের উন্নতি ও মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে।

তাই তওবা ও ইস্তেগফার মুমিনের জীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। তাকওয়াপূর্ণ ও গোনাহমুক্ত জীবন লাভ করতে যা একান্ত জরুরি। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজীদে মুত্তাকীদের গুণাবলির বর্ণনা দিয়ে বলেন-

‘এবং তারা সেই সব লোক, যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলে নিজেদের গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আর আল্লাহ ছাড়া কেইবা আছে, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে। আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না।’ -সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৩৫।

তওবা ও ইস্তেগফার নবীদের সুন্নত : নবী-রাসূলরা নিজেরা যেমন আপন রবের কাছে তওবা ও ইস্তেগফার করেছেন, উম্মতকেও তওবা ও ইস্তেগফার করতে আদেশ করেছেন। তওবা-ইস্তেগফার শিক্ষা দিয়েছেন। তবে নবী-রাসূলদের তওবা-ইস্তেগফার ও উম্মতের তওবা ইস্তেগফারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কারণ নবী-রাসূলগণ মাসুম ও নিষ্পাপ, তাদের জীবন সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। তাদের আল্লাহ গোনাহ থেকে রক্ষা করেছেন। সে হিসেবে তাদের অনুসারী উম্মত মাসুম ও নিষ্পাপ নয়। তাই নবীগণের তওবা ও ইস্তেগফার হয়ে থাকে উম্মতের শিক্ষা ও তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। আর উম্মতের তওবা ও ইস্তেগফার তো কখনো নিজেদের গোনাহের ক্ষমার জন্য, আবার কখনো নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য হয়ে থাকে।

নবীগণের তওবা ও ইস্তেগফার : নবীগণও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে তওবা ও ইস্তেগফার করেছেন। তাদের তওবা ও ইস্তিগফারের ঘটনা ও ভাষা কোরআন মাজীদে বিবৃত হয়েছে। আমরা এখানে কোরআন মাজীদ থেকে কয়েকজন নবীর তওবা ও ইস্তেগফারের বর্ণনা তুলে ধরছি।

হযরত আদম (আ.)-এর জবানীতে তওবা ও ইস্তেগফার : ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। - সূরা আ‘রাফ, আয়াত-২১।

হযরত নূহ (আ.) তওবা ও ইস্তেগফার করেন এভাবে-

‘হে আমার রব! আপনি আমাকে আমার পিতা-মাতাকে এবং আমার ঘরে যারা ঈমানের সঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং মুমিন নর-নারীদের ক্ষমা করুন। আপনি যালেমদের ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন।’ -সূরা নূহ, আয়াত-২২।

হযরত মূসা (আ.)-এর বক্তব্যে তওবা ও ইস্তেগফার : ‘হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমি আমার প্রতি জুলুম করেছি। তাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তাই তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি বড় ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু।‘ -সূরা কাসাস, আয়াত-২৪।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর যবানীতে তওবা ও ইস্তেগফার : ‘হযরত আগার ইবনে ইয়াসার আলমুযানী (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। কেন না, আমি দিনে একশত বার তওবা করি।’ -সহীহ মুসলিম, হাদিস-২৭০২।

এখানে এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নবী ও রাসূলগণ আল্লাহতায়ালার নির্বাচিত বান্দা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাদের গোটা জীবন আল্লাহতায়ালার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। তাই তারা যাবতীয় গুনাহ থেকে দূরে থেকে জীবন যাপন করেন। তাদের থেকে কখনও সগীরা বা কবীরা গোনাহ সংঘটিত হয়নি। আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সর্ববাদী আকীদা হলো, নবী ও রাসূলগণ মাসুম ও নিষ্পাপ। তাই আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের মুখে তওবা ও ইস্তেগফার উচ্চারিত হওয়ার অর্থ কখনোই এ নয় যে, তারা তাদের গুনাহের জন্য বা নবুওতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য তারা তওবা ও ইস্তেগফার করে থাকেন; বরং তারা তো তওবা ও ইস্তেগফার করেন আল্লাহতায়ালার কাছে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বা তাদের থেকে অধিক উত্তম কাজের তুলনায় কম উত্তম কাজ সংঘটিত হওয়ার কারণে এবং সঙ্গে সঙ্গে উম্মতকে তওবা ও ইস্তেগফার শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

হযরত সালেহ (আ.) কতৃর্ক তাঁর উম্মতকে তওবা ও ইস্তেগফার শিক্ষাদান :

‘আমি ছামুদ জাতির কাছে সালেহকে প্রেরণ করেছি। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায় তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের তাতে বসবাস করিয়েছেন। তাই তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। অতঃপর তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করো। নিশ্চয়ই আমার রব অতি নিকটে এবং দুআ কবুলকারী।’ -সূরা হুদ, আয়াত-৬১।

এভাবে সকল নবী উম্মতকে আল্লাহর দরবারে নিজেদের ভুলত্রুটি ও গুনাহের জন্য তওবা ও ইস্তেগফার করার আদেশ করেছেন এবং নিজেদের জীবনকে শিরকের গুনাহ থেকে শুরু করে সকল গুনাহ থেকে পবিত্র করার জন্য তওবা ও ইস্তেগফার শিক্ষা দিয়েছেন। তাই দ্বীন ও শরীয়তে তওবা ও ইস্তেগফারের গুরুত্ব অপরিসীম।

তওবা ও ইস্তেগফার মুমিনকে আল্লাহতায়ালার ক্ষমা ও দয়া লাভে সাহায্য করে

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

‘আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু।’ -সূরা বাকারা, আয়াত-১৯৯।

তিনি আরো বলেন-

‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। অতঃপর তাঁর কাছে ফিরে আস। নিশ্চয়ই আমার রব অতি দয়ালু ও অধিক মমতাময়।’-সূরা হুদ, আয়াত-৯০।

তওবা ও ইস্তেগফারকারীদের প্রতি আল্লাহ শাস্তি প্রেরণ করেন না

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন-

‘আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় কিছুতেই আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না। আর তারা ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায়ও তাদের শাস্তি দেবেন না।’ -সূরা আনফাল, আয়াত-৩৩।

এমনকি তওবা-ইস্তেগফারের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জাতির উপর শাস্তি আসার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও সে শাস্তিকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে হযরত ইউনুস (আ.)-এর কওমের ঘটনা উল্লেখযোগ্য, যা আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজীদে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

‘কেন কোনো জনপদ (বাসীরা) ঈমান আনয়নকারী হলো না? তাহলে তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসত। তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতিক্রম। তারা যখন ঈমান আনল, তখন আমি পার্থিব জীবনে তাদের উপর থেকে লাঞ্ছনার আযাব তুলে নিলাম এবং তাদের একটা সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করতে দিলাম।’ -সূরা ইউনুস, আয়াত-৯৮।

হযরত ইউনুস (আ.) তাঁর কওমকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং তাদের বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা তার দাওয়াতে সাড়া দিল না। বরং তাদের অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনে ডুবে থাকল। তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আসার প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে দিলেন। হযরত ইউনুস (আ.) যেহেতু বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের উপর তো এখন শাস্তি আসা অবধারিত, তাই তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। তারা হযরত ইউনুস (আ.)কে যখন খুঁজে পেল না, তখন তারা বুঝতে পারল যে, এখন তো আমাদের উপর শাস্তি এসেই যাবে। তাই তারা তওবা-ইস্তেগফার করতে লাগল। তাদের এ অবস্থা দেখে আল্লাহতায়ালা আর শাস্তি প্রেরণ করলেন না। এভাবে তারা তওবা ও ইস্তেগফারের ফলে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে গেল।

তওবা ও ইস্তেগফার মুমিনের পার্থিব নিআমত, শক্তি সামর্থ্য ও যাবতীয় সমৃদ্ধি লাভে সাহায্য করে

কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-

‘আমি বললাম, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তাহলে তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। আর তিনি তোমাদের সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দেবেন। তিনি তোমাদের জন্য বিভিন্ন উদ্যান ও নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন।’ -সূরা নূহ, আয়াত-১০-১২।

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর কাছে তওবা করো। তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। তোমাদের শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দেবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না।’ -সূরা হুদ, আয়াত-৫২।

এভাবে কোরআন মাজীদ তওবা ও ইস্তেগফারের অনেক ফায়দা ও উপকারের কথা তুলে ধরেছে। তাই আল্লাহতায়ালার ক্ষমা, দয়া এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সব দিক থেকে তার সাহায্য লাভ করার জন্য তওবা ও ইস্তেগফারের বিকল্প নেই।

তওবা ও ইস্তেগফারের উপকারিতায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-

‘যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে, আল্লাহতায়ালা তার সকল সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দেন, তার সব পেরেশানী দূর করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।’ -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৫১৮।

মোটকথা, তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে একজন মুমিনের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সর্বাঙ্গীণ সুন্দর ও সফল হয়। এর মাধ্যমে একজন মুমিন লাভ করে উভয় জাহানের সমৃদ্ধি।

সর্বোপরি তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহতায়ালার নিকটতম বান্দায় পরিণত হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত