মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০০)

কথায় ও কাজে ঈমানের সাক্ষ্য দাও

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এক বেদুইন কাফের মদিনায় এসে নবীজি (সা.)-এর মেহমান হয়। পেটুক নাক ডুবিয়ে খেয়ে রাতে বিছানাপত্র নষ্ট করে পালিয়ে যায়। কতদূর গিয়ে মনে পড়ে, তাবিজরূপে তার ব্যবহৃত মূর্তিটি রাতের বিছানায় ফেলে এসেছে। চুপিসারে মূর্তিটি আনতে গিয়ে দেখে অবাক কাণ্ড। স্বয়ং নবীজি পরিষ্কার করছেন বেদুইনের মলমূত্রের বিছানা। বেদুইন চিৎকার দিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে। ঘটনার ধারাবাহিকতায় নবীজির হাতে বায়আত নিয়ে সে মুসলমান হয়ে যায়। এই ঘটনা আমরা সবিস্তারে বর্ণনা করেছি আগের লেখায়। মওলানা রুমির কাছে ঘটনা, গল্প বা কাহিনির বর্ণনা মূখ্য নয়; তিনি আমাদের নিয়ে যেতে চান সৃষ্টিজগতের অপার রহস্যের অন্তরালে। বেদুইনের ঈমান মূলত সেই প্রতিশ্রুতির নবায়ন, যা সৃষ্টির আদিতে মানুষ আল্লাহর সঙ্গে করেছিল। ঘটনার জেরে বেদুইনের স্বীকারোক্তির ভাষায় মওলানা রুমি (রহ.) বলেন,

পৃথিবীর আদালত পাড়ায় আমরা এসেছি ‘আলাস্তু’ মামলার সাক্ষ্য দিতে। সৃষ্টির সূচনায় প্রাণের জগতে মহান স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা সব মানুষের রুহকে একত্র করে জিজ্ঞাসা করেন, আলাস্তু বিরাব্বিকুম ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? ‘কালু বালা’ সবাই বলল হ্যাঁ, অবশ্যই’। (সুরা আরাফ: আয়াত-১৭২) কাজেই পৃথিবী নামক গ্রহে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য, সেদিনের ‘আলাস্তু’র সত্যতা প্রমাণ করা। সাক্ষ্য দিতে হবে কথা ও কাজ দিয়ে। বাস্তব কথা ও কাজে প্রমাণ করতে হবে, সেই প্রতিশ্রুতির নিরিখে আমরা কি সৎপথে চলছি, নাকি পথ ছেড়ে কুফরি ও শিরকে হাবুডুবু খাচ্ছি।

সেদিনের প্রতিশ্রুতির সারকথা আল্লাহর ওপর ঈমান। দুনিয়ার পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে হবে আমাদের কথা ও আচরণ সেই ঈমানের পক্ষে না বিপক্ষে। ঈমান কাকে বলে, ঈমনের স্বরূপ কি তা নিয়ে কালাম শাস্ত্রবিদদের বাহাস দীর্ঘ। কারো মতে ঈমান হল অন্তরের বিশ্বাস। কথা ও আচরণ সে বিশ্বাসের পক্ষে সাক্ষ্য। কেউ বলেছেন, শুধু বুকের ভাষা নয়, মুখের স্বীকৃতির নামই ঈমান। কারো মতে অন্তরে বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি ও আচরণে সত্যায়নের সমষ্টি হলো ঈমান। মওলানা রুমির চিন্তা এসব তর্ক বাহাসের ঊর্ধ্বে। তার ভাষায় মুখের কথা ও বাস্তব আচরণ, অন্তরের ঈমানের সাক্ষ্য ও দলিল।

তিনি বলেন, তুমি কতকাল আদালত পাড়ায় উ™£ান্ত ঘোরাঘুরি করবে? তুমি এখানে কুপ্রবৃত্তির কামনা বাসনায় কারারুদ্ধ, দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতার মত্ততায় নিশিদিন বন্দি জীবন কাটাচ্ছ, তা থেকে মুক্তির পথ হলো তোমার অন্তরে লুকায়িত ঈমানের সাক্ষ্য দেয়া, মুখের কথা ও বাস্তব কর্মের মাধ্যমে ঈমানের সত্যতা প্রমাণ করা। তোমাকে এই সাক্ষ্য দেয়ার জন্যই এখানে পাঠানো হয়েছে। তুমি বোঝার চেষ্টা করো,

ইন নামাজ ও রোজে ও হজ্ব ও জিহাদ

হাম গওয়াহী দা’দন আস্ত আজ ইতিকাদ

এই নামাজ, রোজা, হজ্ব আর জিহাদ

উদ্দেশ্য, প্রমাণ করা অন্তরের বিশ্বাস।

যে ব্যক্তি জাকাত দেয়, কোরবানি করে, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে চলে, সে মূলত তার অন্তরের কথারই সাক্ষ্য দেয়। যে লোক যেয়াফতের আয়োজন করে, লোকদের দাওয়াত করে খাওয়ায়, সে মেহমানের কাছে অন্তরে লুকানো একটি কথা ব্যক্ত করতে চায়। তা হলো, তোমার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা আছে। হাদীয়া, উপহার সামগ্রি দেয়ার পেছনেও উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষের প্রতি সহৃদয়তা প্রমাণ করা।

কেউ যখন নিজের সম্পদ বিলায়, তা নিষ্ঠার সঙ্গে হোক বা লোক দেখানো প্রবণতায় হোক, তখন তার উদ্দেশ্য হয়, মনের গোপন অভিপ্রায় প্রকাশ করা। অর্থাৎ আমি জাকাত দেই, রোজা রাখি, তার মানে, আমার মধ্যে তাকওয়া আছে, দানশীলতার রত্ন লুকিয়ে আছে, তার প্রমাণ।

রোজা অবস্থাগত ভাষায় বলে, যে রোজাদার দিনের বেলা হালাল খাদ্য পানীয় গ্রহণ থেকেও বিরত রয়েছে, উপবাসের কষ্ট সয়েছে; নিশ্চয়ই হারাম উপার্জনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না।

জাকাত বলে, যে নিজের সম্পদ নিস্বার্থভাবে আল্লাহর রাস্তায় বিলাচ্ছে, জাকাত দিচ্ছে, সে অন্য লোকের সম্পদ আত্মসাৎ করবে, হারাম খাবে, তা হতে পারে না।

অতএব, তোমাকে নানামুখী তৎপরতায়, কথায় ও আচরণে তোমার অন্তরের ঈমান তথা সৃষ্টির আদিতে কৃত প্রতিশ্রুতির পক্ষে সাক্ষ্য হাজির করতে হবে। এর জন্যই তোমাকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, অনেকে হয়ত ইবাদত করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। অর্থ ব্যয়ের পেছনেও স্বার্থচিন্তা লুকিয়ে থাকে। মওলানা রুমির দৃষ্টিতে এরা ভন্ড-তাপস, বক-ধার্মিক। এদের চরিত্র উন্মোচন করে তিনি বলেন,

গর বে তাররারী কুনাদ পস দো গওয়া’হ

জারহ শুদ দর মাহকামায় আদলে ইলা’হ

যদি করে প্রতারণার বশে, এ দুই সাক্ষী তাতে

রদ হয়ে যাবে আল্লাহর ইনসাফের আদালতে।

কেউ যদি প্রতারণার বশে ইবাদত করে, লোক দেখানোর ভন্ডামী যদি মনে লুকিয়ে রাখে, তাহলে আল্লাহর ন্যায় বিচারের আদালতে তার উভয় সাক্ষী অর্থাৎ তার কথা ও আচরণ দুটোই প্রত্যাখ্যাত হবে, সাক্ষ্য রদ, মিথ্যা বলে গণ্য হবে। এমন তাপসের উদাহরণ, শিকারি। শিকারি ফাঁদ পেতে দানা ছড়ায়। মনে করো না যে, দয়ামায়ার বশে, দানশীলতার চেতনায় সে খাবার ছড়িয়ে রাখছে। সে আসলে পাখি শিকারের ফাঁদ পেতেছে। এমন রোজাদারের উপমা, বিড়াল। বিড়াল চুপটি মেরে ভাব দেখায়, ঘুমিয়ে আছে অসহায়। শিকার ধরার এটি তার কৌশল। এসব বক ধার্মিকের প্রতারণার কারণে খাঁটি ঈমানদার ইবাদতকারী, দানশীল ব্যক্তিরাও বদনামের শিকার হয়।

একটি সূক্ষ্ম প্রশ্ন হল, যাদের ইবাদতে বা দান খয়রাতে লোক দেখানোর মিশ্রণ থাকে, তাদের অবস্থা কি হবে? যারা লোক দেখানোর খাতিরেও সত্যের পক্ষে থাকে না, তাদের চেয়ে কি এরা খারাপ? হতে পারে, এক ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য নেক আমল ইবাদত শুরু করল, দান খায়রাত দিল; কিন্তু কোনো ঘটনার কারণে তার লোক দেখানো প্রবণতা, ইখলাস ও নিষ্ঠায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। এ ব্যাপারে মওলানা রুমির ভাষ্য অন্য রকম,

ফযলে হক বা’ ইনকে উ কয মী তনদ

আ’কেবত যিন জুমলা পাকশ মী কুনাদ

বক্রচিন্তায় সে যদিও তার আমল সাজায় পরিশেষে

আল্লাহর রহমতের ছোঁয়া এসে সবকিছু সাফ করে দেয়।

আল্লাহর অফুরন্ত দয়া এসে এমন লোক দেখানো ইবাদত ও আমলকেও ছেয়ে ফেলে। আমলকারীকে বক্রতা থেকে উদ্ধার করে সৎপথে নিয়ে আসে। হাদিস শরিফে আছে, আল্লাহর রহমত আল্লাহর গযবের উপর প্রবল। আল্লাহর ক্রোধের শক্তির চেয়ে রহমতের শক্তি প্রবল। আল্লাহর কুদরত এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনাকে আমার তোমার সংকীর্ণ চিন্তার ছকে হিসাব করলে ভুল হবে। মওলানা রুমির জবানীতে-

সাবক বুর্দে রহমতশ ওয়াআন গদর রা’

দা’দে নূরী কে নবা’শদ বদর রা’

আল্লাহর ক্রোধের ওপর তার রহমত প্রবল হেতু

রিয়াকারকে দেন পূর্ণিমার চেয়ে উজ্জ্বল আলো।

চেষ্টা ও সাধনার বরকতে লোক দেখানো আমলকারীর মধ্যে ঈমানের নূর এমনভাবে চমকে উঠে, যার সামনে চতুর্দশী পূর্ণিমা চাঁদও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। আল্লাহ এমন কাজটি কেন করেন, তার রহস্যও ব্যক্ত করেছেন মওলানা রুমি। আল্লাহর অন্যতম গুণবাচক নাম গাফফার। এর শাব্দিক অর্থ যিনি ভালো করে ঢেকে দেন। বান্দার দোষখাতা আচ্ছাদন করেন বলেই তো তিনি ক্ষমাশীল। গাফফার গুণ প্রকাশ করার জন্য গোনাহগারের ওপর রহমতের আচ্ছাদন ঢেকে দেন। বিষয়টি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামার মতো। বৃষ্টি কেন নামে। পানি দিয়ে অপবিত্রকে পবিত্র করা আর মৃত প্রকৃতিতে জীবন সঞ্চার করার জন্যই বৃষ্টি। আল্লাহর রহমতও বৃৃষ্টির মতো। আমাদের মাঝে যদি অপবিত্রতা না থাকত, তাহলে কি পানির প্রয়োজন পড়ত।

বৃষ্টি নেমে অপবিত্র জিনিষের ছোঁয়ায় নিজেও অপবিত্র হয়ে যায়। কিন্তু আবার জলীয় বাষ্প হয়ে আকাশে উঠে মেঘের ছাউনিতে বৃষ্টি পবিত্র হয়ে যায়। তুমিও নিজেকে ঊর্ধ্বে নিয়ে পরিশোধিত করো নামাজির মতো। নামাজি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে চলে যায় উর্ধ্বলোক সফরে। মানুষ সফরে গেলে সেখানকার মূল্যবান জিনিষটি নিয়ে আসে আপনজনদের জন্য হাদিয়া স্বরূপ। নামাযীও রূহানী সফর থেকে সওগাত নিয়ে আসে আর নামাজ শেষে প্রথমে ডান দিকে, পরে বাম দিকে বিতরণ করে সেই সওগাত, চিরশাশ্বত শান্তির পয়গাম আসসালাম।

জান সফর রফত ও বদন আন্দর কিয়াম

ওয়াক্তে রাজআত যিন সবব গুয়াদ সালাম

প্রাণ যায় সফরে দেহ ঠাঁই দাঁড়িয়ে নামাজে

ফিরার সময় বলে আসসালাম এই কারণে।

নামাজের এই মাহাত্ম্যের পরিচয় মিলে অপর হাদিসে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সরাসরি আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে বর্ণনা করেন, নামাজীদের সঙ্গে আমার তিনটি অবস্থা আছে। একটি হলো, মুসল্লি যতক্ষণ নামাজরত থাকে, ততক্ষণ তার মাথার তালুর ওপর আকাশের দিগন্ত হতে রহমত নাজিল হতে থাকে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- তাকে ফেরেশতারা তাদের ডানা দিয়ে ঢেকে রাখেন। আর তৃতীয় হচ্ছে- আমি তার সঙ্গে একান্তভাবে আলাপ করি। সে যখনই বলে ইয়া রব! আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি, লাব্বাইকা, আমি হাজির বন্দা। অতঃপর নবী করীম (সা.) বলেন, মুসল্লি যদি জানত, সে কার সঙ্গে একান্তে আলাপ করছে, তা হলে সে অন্যদিকে দৃষ্টি দিত না। (তফসিরে কাশফুল আসরার)।

মওলানা উপদেশ দিয়ে বলেন, তুমি সৃষ্টির সেরা মানুষ। সকল সৃষ্টজীবের চেয়ে তুমি উত্তম। তোমার চোখ যেমন সারাক্ষণ নূরের দরিয়ায় হাবুডুবু খায়, তুমিও আল্লাহর নূরকে তোমার আহার্যে পরিণত কর। তবেই ফেরেশতাদের সঙ্গে হবে তোমার সঙ্গলাভ। ফেরেশতার মতো শুদ্ধ, সুন্দর পবিত্র হতে চাও? ফেরেশতাদের মতো আল্লাহর তসবিহ পাঠ ও ইবাদতকে নিজের আহারে পরিণত কর। তবেই তোমার মুক্তি নসিব হবে কামনা বাসনার বন্দিত্ব হতে।

আমরা তার (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত, ১৬৮-২৯৭)

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন - CHAYAPATH PROKASHONI