সন্তানের প্রতি পিতার উপদেশ

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একজন সন্তান নিজ পিতা থেকে পাওয়া শিক্ষা, আদর্শ, নৈতিকতা এবং উপদেশাবলিকে সম্বল করে আগামীর কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার প্রয়াস পায়। পিতার হৃদয় উৎসারিত উপদেশ সন্তানের জীবনপথের পাথেয়। পিতার আদর্শিক শিক্ষার ওপর নির্ভর করে সন্তানের আলোকময় জীবন। পিতার উপদেশে সন্তানের কচি হৃদয়ে বপিত হয় আখলাকের বীজ। আদর্শ পিতা মাত্রই সন্তানকে সৎ উপদেশ প্রদানকারী যেমন উপদেশ দিয়েছিলেন লোকমান (আ.) স্বীয় পুত্রকে। যার বিবরণ আল্লাহ জগৎবাসীর জন্য কোরআনে বিধৃত করেছেন।

শিরকমুক্ত জীবন গঠন : সন্তানের সার্বিক কল্যাণকামী, সুস্থ বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি পিতা স্বীয় সন্তানের দুনিয়াবি কল্যাণের পাশাপাশী পরকালীন জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার ফিকির করেন। এজন্য সন্তানকে আল্লাহর পরিচয় শেখান। দেন আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষা। উৎসাহিত করেন শিরকমুক্ত জীবন যাপনে। লোকমান (আ.) স্বীয় ছেলেকে উপদেশের ছলে বলেছিলেন, হে ছেলে! আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক মহা-অন্যায় (সুরা লোকমান : ১৩)। কারণ, যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে তারা কখনো ক্ষমা পাবেন না। কোরআনে এসেছে, আল্লাহ তার সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না। তা ব্যতীত অন্য গোনাহ তিনি চাইলে ক্ষমা করবেন (সুরা নিসা : ১১৬)। আল্লাহর সাথে শিরককারী অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। সন্তানকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে শিরকমুক্ত জীবনের উপদেশ দেওয়া কল্যাণকামী পিতার প্রথম কাজ। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, আদম সন্তান আমাকে গালমন্দ করে অথচ তার উচিত নয় আমাকে গালমন্দ করা। আর আমাকে গালমন্দ করার অর্থ হলো, আমার জন্য সন্তান সাব্যস্ত করা। শিরক করা (বোখারি : ৪৪৮২)।

 

আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার জ্ঞানদান : পিতার উচিত সন্তানকে আল্লাহ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দেওয়া। আল্লাহ যে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেই বিশ্বাস সন্তানের মন-মননে বসিয়ে দেওয়া। আকাশ, জমিন, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি কিংবা আলো-আঁধারের, দূরে-কাছের, বৃহত্তম বা ক্ষুদ্রতম, কণা অনুকণা কোনো কিছুই তার জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে নয়। তার কাছে গোপন প্রকাশ্য সবই সমান। এ জাতীয় উপদেশ সন্তানকে দেওয়া পিতার অবশ্য কর্তব্য। লোকমান (আ.) সন্তানকে বলেছিলেন- হে ছেলে! কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আর তা যদি প্রস্তরগর্ভেও থাকে অথবা আকাশ কিংবা ভূ-গর্ভে থাকে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন (সুরা লোকমান : ১৬)। সন্তানকে সঠিক আকিদায় গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব পিতার ওপরই ন্যস্ত।

ফরজ নামাজ আদায়ের উপদেশ : পিতা সন্তানের দর্পণ। পিতার প্রতিবিম্ব সন্তানের জীবনে প্রতিফলিত হয়। আল্লাহ প্রদত্ত আবশ্যকীয় বিধানাবলী সম্পর্কে সন্তানকে উপদেশ-সংবলিত আদেশ করা উচিত। বিশেষত ফরজ নামাজ আদায়ের আদেশ করা। নবীজি বলেছেন, যখন সন্তানের বয়স সাত বছর হয়, তখন তাদের নামাজের জন্য আদেশ করো। আর ১০ বছর বয়সে নামাজ অনাদায়ে বেত্রাঘাত কর (আবু দাউদ : ৪৯৫)। নামাজ এমন একটি ইবাদত যা মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্যকারী। (আবু দাউদ : ৪৬৭৮)। প্রজ্ঞাবান লোকমান (আ.) স্বীয় ছেলেকে নামাজের আদেশ করে বলেছিলেন, হে বৎস! নামাজ কায়েম কর (সুরা লোকমান : ১৭) নামাজ আদায়ে সন্তান আন্তরিকভাবে শক্তিশালী ও পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহর সান্নিধ্য প্রাপ্ত হয়।

 

ভালো ও মন্দের পার্থক্য শেখানো : সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের ওপর অর্পিত গুরু-দায়িত্ব। কোরআনে এসেছে- তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতীর কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাঁধা দেবে (সুরা আলে-ইমরান : ১১০)। সন্তানকে ভালো-মন্দের শিক্ষাদান, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাঁধাদানের উপদেশ দেওয়া পিতার একান্ত কর্তব্য। লোকমান (আ.) ছেলেকে উপদেশের ছলে বলেছিলেন- হে বৎস, নামাজ কায়েম করো, সৎকাজে আদেশ দাও এবং মন্দ কাজে নিষেধ করো (সুরা লোকমান : ১৭)। এর মাধ্যমে সন্তান নিজের পাশাপাশি গোটা মাবনকুলকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টায় রত থাকবেন। মানবজাতির উন্নয়নে ব্রত হবেন।

বিপদে ধৈর্য ধারণের শিক্ষাদান : হাদিসে এসেছে, ধৈর্য সাফল্যের জিয়নকাঠি (আল-ফেরদাউস : ৩৮৪৪)। অন্যত্র নবীজি বলেছেন, ধৈর্য এক-ধরনের আলো (বোখারি : ২২৩)। যে আলোয় ব্যক্তি উভয় জগতের সফলতার দিশা পায়। ব্যক্তিগত কিংবা জাতীয় পর্যায়ে উন্নতি ও পরিশুদ্ধতা সাধনে ধৈর্যের বিকল্প নেই। যে কোনো বিষয়ে সফলতা পেতে সবরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কোরআনে এসেছে, আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জেহাদকারীদের এবং সবরকারীদের (সুরা মুহাম্মদ : ৩১)।

 

অহংকার-অবজ্ঞা না করা : ভদ্রতা, মানবিকতা, নিরহংকার এই সব গুণাবলি ব্যক্তিকে আত্মীকভাবে সুসজ্জিত করে। ব্যক্তিকে সম্মানের আসনে সমাসীন করে। পক্ষান্তরে অহংকার, অন্যের প্রতি অবজ্ঞা ব্যক্তিকে অপদস্ততা ও ধ্বংসের পথে পরিচালিত করে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, অহংকার আমার চাদর। যে ব্যক্তি তা নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে, আমি তাকে লাঞ্ছিত করব (মুসলিম : ২৬২০)। তাই, সন্তানকে নিরহংকার ও অবজ্ঞা পরিত্যাগে উপদেশ দেওয়া পিতার অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য। লোকমান (আ.) স্বীয় ছেলেকে বলেছিলেন, অহংকারবশে মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না (সুরা লোকমান : ১৮)।

মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা : ইসলাম মধ্যমপন্থি ধর্ম। সর্বক্ষেত্রে মধ্যমপন্থাকে সমর্থন করে। একজন আদর্শ পিতার দায়িত্ব হলো, সন্তানকে মধ্যমপন্থি হিসেবে গড়ে তোলা। কথা-বার্তা, চলাফেরায় মধ্যমপন্থা অবলম্বনের উপদেশ দেওয়া। যে কোনো বিষয়ে দ্রুততা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা রবের আদেশ। আল্লাহ বলেছেন, পদচারণায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো (সুরা লোকমান : ১৯)। নবীজি বলেছেন, দ্রুতগতিতে চলা মোমেনের সৌন্দর্য ও মর্যাদা হানিকর (মাআরেফুল কোরআন : ১০৫৭)। আবার অত্যধিক মন্থরগতি নারী ও অসুস্থ আত্মাভিমানী দাম্ভিক ব্যক্তির পরিচায়ক। সেটাও বর্জনীয়।

লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর