মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০১)

কাকের জীবন ছাড় আল্লাহর হয়ে যাও

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মৃত্যুর পর হাড্ডিমাংস পচে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় মানুষের। সেই মানুষকে আল্লাহ কীভাবে আবার জীবন দান করবেন? হযরত ইবরাহীম (্আ.)-এর মনের এই কৌতূহল মিটানোর জন্যে আল্লাহ পাক চারটি পাখি জবাইর নির্দেশ দেন। সূরা বাকারার ২৬০ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত। পাখি চারটি ছিল কাক, মোরগ, ময়ুর আর কবুতর। এই চার পাখি বাছাই করার রহস্য ব্যক্ত করে মওলানা রুমি বলেন, পাখি চারটি মানব চরিত্রের একেকটি স্বভাবের প্রতীক।

মওলানা রুমির (র.) ভাষায়, কাক তার কাণ্ডকাণ্ডরব ও কর্কশ চিৎকারে লাগাতার বলে যায়, আমি এই দুনিয়ায় দীর্ঘ জীবন চাই। কাক দুনিয়াপূজারী কামনার দাস মানুষের প্রতীক। কাকের দুটি প্রিয় জিনিস দীর্ঘ জীবন আর পঁচা নাপাকী ভক্ষণ। আল্লামা জাহেয ‘হায়াতুল হায়ওয়ান’ গ্রন্থে বলেন, কাক হল সবচে নিকৃষ্ট প্রাণী। মরাপচা আর নাপাকিই তার পছন্দ। তার স্বভাবে সম্ভ্রমবোধ ও স্বাধীনচেতা কোনো গুণ নেই। কাক স্বভাবের দুনিয়াদারদের অবস্থাও হলো, তাদের বাইর যেমন কালো, ভেতরও অন্ধকার। দেহের ভেতরে নূরের আলো জ্বালানোর কোনো চিন্তা তাদের নেই। এদের অবস্থা ইবলিসের মতো। ইবলিস তার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইল না। চাইল কেয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ জীবন।

গোফত আনযিরনী ইলা’ ইয়াউমিল জযা’

কাশকি গুফতি কে তুবনা’ রব্বানা’

বলল, অবকাশ দাও আমাকে কেয়ামত অবধি

হায় যদি বলত, প্রভুহে! তওবা করেছি আমি।

সৃষ্টির শুরুতে আল্লাহর নির্দেশে আদম (আ.) কে সিজদা না করে ইবলিস মারাত্মক ভুল করে। উচিত ছিল সেই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে সে ক্ষমা চাইবে। তা না করে অহংকারে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত আদম সন্তানকে দেখে নেয়ার অবকাশ চাইল আল্লাহর কাছে। (দ্র. সূরা সাদ, আয়াত-৭৯; সূরা আরাফ, আয়াত-১৪ ও সূরা হিজর, আয়াত-৩৬)।

মওলানা রুমি বলেন, দুনিয়াপূজারিরাও ইবলিসের মতো আল্লাহকে ভুলে কেবল দুনিয়ার সুযোগ সুবিধা, ভোগবিলাসিতা চায়। আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার চিন্তা তাদের নেই। অথচ আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কহীন, তওবাবিহীন জীবন জীবন নয়। এমন জীবন মরণের চেয়েও অধম। এর নাম কোনো মতে বেঁচে থাকার জান-কান্দানী ছাড়া আর কিছু নয়। পক্ষান্তরে মরণের স্বরূপ কি? মরণ তো হলো, আপন প্রেমাস্পদ পরম বন্ধুর ভালোবাসার বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।

আমার হাতের মোবাইল সেটে পাওয়ার আছে; কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে নেটওয়ার্ক নাই। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না, কথা হয় না আপনজনের সঙ্গে। নিশ্চয়ই এই সেট নষ্ট। দুনিয়াতে অনেক মানুষ আছে, এখানকার আলো বাতাসে খাওয়াপরায়, ঘুমের ঘোরে জীবন কাটায়। কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নাই। জীবন থেকেও তারা মৃত। কারণ, তাদের কলবে উর্ধ্বজগতের নেটওয়ার্কের কানেকশন নাই।

উমরো মর্গ ইন হারদো বা হক খোশ বুয়াদ

বী খোদা’ আ’বে হায়াত আ’তাশ বুয়াদ

জীবন মরণ উভয় আনন্দময় আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত হলে

আল্লাহকে ছেড়ে জীবনামৃত আবে হায়াতও অনলে জ্বলে।

আবে হায়াত পান করলে চিরন্তন জীবন লাভ করা যায়। কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই, যে আল্লাহর পথে নাই, তার জন্য আবে হায়াতও জীবন ধ্বংসকারী হয়ে যায়। চিরন্তন জীবন লাভের রহস্যটি এই আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে নিপুণভাবে।

“হে নবী! আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত।” (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)।

মওলানার কাছে প্রশ্ন, হযরত মওলানা! আল্লাহবিহীন জীবন যদি দুর্ভাগ্য ও আজাব গজবে আকীর্ণ হয়, ইবলিস কেন এতবড় জ্ঞানী হয়েও আল্লাহর কাছ থেকে দীর্ঘ জীবন চেয়ে নিল? মওলানা জবাব দেন, ইবলিসের এই দাবি, এই চেয়ে নেয়াও ছিল আল্লাহর অভিশাপের বহির্প্রকাশ। কেন না, ইবলিস আল্লাহর দরবারে তওবা, ইস্তিগফার করা বা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য চাওয়ার পরিবর্তে দুনিয়াতে দীর্ঘ জীবন চেয়েছে। এ জন্যেই সে আল্লাহর চরম অসন্তুষ্টির শিকার হয়েছে।

এখানে মূলনীতি হলো, আল্লাহর কাছে আল্লাহ ছাড়া আর কিছু প্রার্থনা করা মারাত্মক ভুল। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রার্থনা, আল্লাহর পথে চলার তাওফিক কামনা ছাড়া অন্যকিছু চাওয়া মানে গোনাহ পাপ অন্যায়ে নিমজ্জিত জীবন দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রার্থনা। এর অর্থ দাঁড়ায়: হে আল্লাহ! আমাকে দীর্ঘ জীবন দাও, যাতে তোমার কাছ থেকে আরো দূরে সরে যাই। আরো অবকাশ দাও, যাতে পাপ পঙ্কিলতায় আরো বেশি নিমজ্জিত হই। এমন লোকই আল্লাহর অভিশাপের শিকার হয়। পক্ষান্তরে,

উমরে খোশ দর কুরব জান পরওয়ার্দন আস্ত

উমরে যা’গ আয বাহরে সেরগীন খোরদান আস্ত

মধুময় জীবন সে তো তার সান্নিধ্যে জীবন যাপন

পঁচা দুর্গন্ধে পড়ে থাকা, বিষ্ঠা খাওয়া কাকের জীবন।

সুন্দর মধুময় জীবন তো আল্লাহর রহমতের ছায়ায় জীবন যাপন। হারাম হালাল, ন্যায় অন্যায়ের বাছ-বিচারহীন ভোগের জীবন মানে কাকের জীবন। কাক বলে, প্রভুহে! আমার দীর্ঘ জীবন চাই, নাপাকি খেয়ে বাঁচতে চাই। ময়লা আবর্জনা, দুর্গন্ধের মধ্যেই আমি জীবনের সাধ পাই। আসলে ময়লা-স্তূপ পড়ে থাকাতে ওদের মুখটাই নাপাক। তাই বলতে পারে না, মুখ দিয়ে আসে না, প্রভুহে! আমি তোমার কাছে ফিরে যেতে চাই। সৎ সুন্দর জীবন চাই, নিকৃষ্ট স্বভাব ও আচরণ থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই।

মওলানার চেতনা এখন দুনিয়ার কাকদের প্রসঙ্গ ছেড়ে উড়াল দিল ঊর্ধ্বলোকে। তিনি এখন সরাসরি কথা বলতে চান মহামহিমের সঙ্গে। প্রভুহে! তুমিই তো কালো মাটিকে স্বর্ণে রূপান্তর করেছ। এই মাটি দিয়েই তুমি মানব পিতা আদমকে বানিয়েছ। তোমার কাজ তো সৃষ্টিসত্তার আমূল পরিবর্তন আর সৃষ্টিরাজির প্রতি অবারিত দান এহসান। আমি বান্দা আগাগোড়া ভুলে, দাও আমায় পরিত্রাণ।

সাহও নিসয়া’ন রা’ মুবাদ্দাল কুন বে এলম

মন হামা খেলমম মোরা’ কুন সবরো হেলম

আমার ভুল ও বিস্মৃতিকে বদলে দাও প্রভুহে জ্ঞানে

ক্রোধে অন্ধ অন্তরে মোর ধৈর্য সহনশীলতা দাও ঢেলে।

তুমিই তো লবনাক্ত মাটিকে রুটিতে রূপান্তর কর। মাটি থেকে গম, গম থেকে রুটি উৎপন্ন করো। প্রাণহীন রুটিকে আবার মানুষের প্রাণবর্ধক কর। তোমার চিন্তায় বিহ্বল প্রাণকে তুমিই তোমার পথ দেখাও। তোমার পথের সন্ধানী ছিলেন যিনি, তাকে তুমি নবুয়াতের মুকুট পরিয়েছ। মাটির সৃষ্টি মানুষকে তুমি আসমানে সম্মানিত করেছ। তোমার তারকারাজির আলোকসম্পাতে পৃথিবী উদ্ভাসিত, আলোকিত।

প্রভুহে! তোমাকে ছেড়ে যে দুনিয়াকে ভোগ করার পথ বেছে নেবে, বিস্মৃতি ও মূর্খতার মৃত্যু সবার আগে তাকেই গ্রাস করবে। মানুষ অন্তর্দৃষ্টিতে তাকালে দেখবে, এখানকার সবকিছু নিত্য বদলাচ্ছে। নূরের তাজাল্লিতে সৃষ্টি নৈপুণ্যের নানা কারুকাজ অহরহ সম্পাদিত হচ্ছে। স্বয়ং মানুষের দেহের কাঠামোও বদলে যাচ্ছে মনের অজান্তে। হে মানুষ! তুমি মাটি, পানি, বাতাস ও আগুনের সমন্বয়ে গড়া। নানা পথপরিক্রমায় বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তোমার এখানে আসা। তোমার মূল উপাদান মিশ্রিত ছিল জড় জগতে। তখন পানি, মাটি, বাতাস ও আগুনে একাকার ছিলে। সেখান থেকে রূপ বদলে এসেছিলে উদ্ভিদ জগতে। উদ্ভিদ থেকে আহার যোগে এসেছিলে বাবার ঔরষে। তারপর নাপাক শুক্র সূত্রে মায়ের গর্ভে। কমবেশি ১০ মাস পর পৃথিবীর মাটিতে নেমে শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে তুমি এখন পরিণত বয়সে।

চিন্তা করো, এসব পরিবর্তন যদি না আসত, তোমার জীবনে কি এই উন্নতি ও পূর্ণতা আসত? প্রতিটি পরিবর্তনে তোমার আগের অস্তিত্ব নেই। নতুন অবয়বে তুমি আগের চেয়ে উন্নত, পূর্ণতাপ্রাপ্ত। তোমার জীবন পথের পট-পরিবর্তনের মূল নিয়ন্তা আল্লাহ। মাঝখানে দৃশ্যমান কার্যকারণ ও অনুঘটক থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এসব কার্যকারণ নিয়ে ব্যস্ত হলে আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্যের হাকিকত দর্শনে তুমি ব্যর্থ হবে। তুমি এ তথ্যটি বোঝার চেষ্টা কর যে, অস্তিত্বের একটা অবস্থাকে ফানা ও বিনাশ করার কারণে পরবর্তী বাকা বা স্থায়িত্ব পেয়েছ।

দর ফানাহা’ ইন বাকা’ রা’ দীদেয়ী

বর বাকা’য়ে জেসম চোন চপসীদেয়ী

বিলীন বিনাশ ফানায় যেহেতু পেয়েছ স্থায়িত্ব

কেন দেহের স্থায়িত্ব নিয়ে এভাবে লেপ্টে আছ?

তোমার বর্তমান অস্তিত্ব বিভিন্ন ফানা ও বিনাশের ফলশ্রুতি। এখন কেন পরিবর্তন চাও না? কেন উন্নতির পূর্ণতার পানে পাড়ি দাও না? দুনিয়া পূজারীদের অন্তর অন্ধকার আর ভোগের রাজ্যে বেসামাল হওয়ার কারণ, তাদের ভেতর বাহির একসমান। বাইরে যেমন খাওয়া-পরা, নিদ্রা ছাড়া আর কিছু বুঝে না। ভেতরেও আলোর সন্ধান চায় না, তাই পায় না।

দুই জাতের পাখির উপমা নাও। মুরগি গৃহপালিত পাখি, সে উড়ে না। উড়ার স্বাদও তার নাই। কিন্তু আকাশের পাখি পিঞ্জরে আবদ্ধ হলে উড়াল দিতে তড়পায়। যারা দুনিয়ার নালা নর্দমায় পড়ে আছে, তাদের অবস্থা নর্দমার কীট বা গৃহপালিত মুরগির মতো। নিজের দুর্ভাগ্যের হুঁশজ্ঞানও তাদের নাই। কিন্তু নেককার লোকদের অবস্থা পিঞ্জরে আবদ্ধ উড়ন্ত পাখির মতো। কোনো গুনাহে ভুলে পতিত হলে সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় জড়োসড়ো হয়, তওবা করে, সব শক্তি বিনিয়োগ করে উড়াল দিতে চায় আকাশের নিলীমায়। দুনিয়াপূজার দুর্ভাগ্যে পতিতদের একটি চিত্র পাওয়া যায় হাদীসের ভাষায়। নবীজি (সা.) বলেন, তিন শ্রেণির মানুষের প্রতি তোমাদের করুণা হওয়া উচিত; সমাজের এমন সম্মানিত ব্যক্তি যে মান-ইজ্জত হারিয়ে রিক্ত; এমন ধনী যে ধন-সম্পদ হারিয়ে কপর্দকশূন্য আর এমন আলেম বা জ্ঞানী-গুণী যে মূর্খলোকদের খেলনার পাত্রে পরিণত।

ওহে কাক স্বভাবের মানুষ! ময়লার ভাগাড়ে পড়ে থেকো না। গা ঝাড়া দাও। উঠো, আল্লাহর হাতে বিবর্তনের জন্যে প্রাণ বাজি রেখে চেষ্টা করো। তাকে বল, আমি তোমার ইবাদত করি, তার মানে তোমার দিকে এগিয়ে যেতে চাই। তোমার রহমত চাই, তোমাকে পেতে চাই। অতীতের গোনাহ-খাতা ছেড়ে আমি শুদ্ধ জীবন চাই, একান্ত তোমার হয়ে যেতে চাই। আমার এই তওবা, এই ফিরে আসা গ্রহণ কর। মাহে রমজানকে আমার জন্য মোবারক কর।

(মওলানা রুমির মসনবি শরীফ, ৫খ. বয়েত-৭৬৫-৮৩২)

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI