মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০২)

ক্ষুধার্ত কুকুরের পাশে বেদুইনের কান্না

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মরু বিয়াবানে একটি অসহায় কুকুর মারা যাচ্ছিল আর তার পাশে বসে বুক ভাসিয়ে কাঁদছিল এক বেদুইন। সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল এক ভিক্ষুক। ভিখারি বেদুইনকে জিজ্ঞাসা করল, কী হে! এভাবে কাঁদছেন কেন? বেদুইন বলল, আমার কুকুরটি ছিল সুবোধ, অনুগত। কিন্তু হঠাৎ পথ চলতে সে পড়ে গেছে। সে যে উঠতে পারছে না।

রূয সাইয়াদম বুদো শব পা’সেবা’ন

তীয চশমো সাইদগীরো দুযদ রা’ন

দিনে শিকারি, রাতে পাহারা দেয় আমার বাড়ি

তীক্ষè দৃষ্টি, চোর-তাড়ুয়া, শিকার ধরায় কুশলি। (৪৮০)

সে আমার জন্য দিনের বেলা শিকার ধরে, তাতে আমার জীবন-জীবিকা চলে। রাতে ঘর পাহারা দেয়। নিরাপত্তায় নিশ্চিন্তে ঘুমাই। তার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষœ প্রখর, শিকার ধরতে ক্ষিপ্র কুশলি আর রাতে চোর তাড়াতে উস্তাদ। ভিখারি শুনে বলে, দারুণ তো! কী হয়েছে তাহলে? আপনার কুকুরের রোগটা কীসের? - ক্ষুধার রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে যতই খায়, ক্ষুধা মিটে না, কাতরায়। ভিখারি উপদেশ দিল, সবর করা ছাড়া তো উপায় নেই। এমন কঠিন রোগে ধৈর্য ধরুন। আল্লাহ চাহেন তো রোগ সেরে যাবে। ধৈর্যশীলদের মর্যাদা আপনাকে দেবেন। ভিখারি বেদুইনকে জিজ্ঞাসা করে! আপনার গাটরির মধ্যে কী যেন দেখছি? বেদুইন বলে, আমার সফরের সামান; রুটি খাবার, এ এসব আরকি। গত রাতের বেঁচে যাওয়া খাবার। না খেলে তো শরীরটায় শক্তি পাই না। ভিক্ষুক বলল, আপনার কুকুর যে ক্ষুধায় কাতরায়, গাটরি থেকে গত রাতের বেঁচে যাওয়া খাবারটা বের করে কেন তাকে দিচ্ছেন না? বেদুইন বলল, কুকুরের প্রতি অত দরদ দেখাতে পারব না। আমি মুসাফির। পকেটে টাকা না থাকলে কেউ আমাকে খাবার দেবে না। কাজেই হাতে যা আছে খরচ করা যাবে না। তাহলে কাঁদছেন কেন- ভিক্ষুকের জিজ্ঞাসা। বেদুইনের জবাব, কান্নায় তো পয়সা লাগে না। চোখের পানি মাগনা জিনিস। কথায় বলে, বন্ধুর জন্য জান দেব তবে টাকা খরচের প্রশ্ন এলো বন্ধুত্ব শিকায় রাখ। চাচা! আগে তোর পরান বাঁচা। ভিখারি বলল, তুমি তো প্রেমের মিথ্যা দাবিদার। ভণ্ড প্রেমিক। তোমার চেহারা ধূলিমলিন হোক। তোমার চোখের পানির চেয়ে বাসি রুটির দাম বেশি! চোখের পানিকে মাগনা মনে করেছ। অথচ তা কলিজার রক্ত। দুঃখ দুশ্চিন্তায় কলিজার খুন পানি হয়ে জলীয় বাষ্পে পরিণত হয় আর তা উঠে যায় মাথায়। সেখান থেকে নামে দুই চোখ বেয়ে অশ্রু হয়ে। অথচ তুচ্ছ মাটি থেকে উৎপন্ন যে গম রুটিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই তুচ্ছ জিনিসের পরিবর্তে কলিজার রক্ত ঝরানো তোমার জন্য সহজ।

বেদুইন নিজের গোটা অস্তিত্বকে তুচ্ছ করেছে। কারণ, অস্তিত্বের অংশ চোখের অশ্রুকে তুচ্ছজ্ঞান করেছে। তার উপমা ইবলিস। কৃপণতা, কিপটামিতে সে নিজের ব্যক্তিত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। এ কারণে চোখের পানিকে তুচ্ছ করেছে। ইবলিসও ছিল তার মতো কিপটে বখিল। নিজের আমিত্বকে অতিক্রম করে সে আল্লাহর হুকুমে আদমের সামনে সিজদায় নত হয়নি। সত্যিই বখিলি বা কৃপণতা মানুষকে অত্যন্ত তুচ্ছ ও হীন করে। বখিলের ব্যক্তিত্ব চেতনা বলতে থাকে না। হাদিস শরিফে এজন্যই বলা হয়েছে, ‘বখিল আল্লাহ (এর রহমত) থেকে দূরে, মানুষ (এর মন) থেকে দূরে, জান্নাত থেকে দূরে এবং জাহান্নামের কাছে।’ কৃপণ কত প্রকার কী কী তার বিস্তর বিবরণ আছে চরিত্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত কিতাবসমূহে। এখানে মওলানা রুমির জীবনের একটি কাহিনী আনতে চাই তার জীবনী হতে। মওলানা রুমির এক মেয়ের নাম ছিল মালাকা খাতুন। মালাকার স্বামী ছিল যার পর নাই বখিল। যাকে বলে কাঞ্জুস, কিপটা। একবার মালাকা অতিষ্ঠ হয়ে পিতার কাছে এসে নালিশ দেয় স্বামীর বিরুদ্ধে। নানা অভিযোগে তার মনটা জর্জরিত। মওলানা রুমি আরেক বখিলের গল্প শোনালেন মেয়েকে। এক বখিল একদিন মসজিদে গিয়ে মনে পড়ে, বাড়িতে চেরাগটি না নিভিয়ে এসেছে। হায় হায়! কত তেল না পুড়ে যায়। তড়িঘড়ি দৌড় দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িতে পৌঁছে কাজের মেয়েটিকে ডাক দিয়ে বলে, ওহে! তুমি দরজাটা খুলবে না, তবে ওখানে চেরাগটা নিভিয়ে দাও। এমন কথা শুনে দাসী অবাক হয়ে জানতে চায়, কেন? দরজা কেন খুলব না? বখিল বলল, খুললে দরজাটা আরো একবার ঘষা খেয়ে ক্ষয় হয়ে যাবে। দাসী বলল, আপনি এতবেশি হিসাব করে চলেন? বলুন তো, মসজিদ থেকে কীভাবে এতদূর এলেন? আসতে আপনার জুতার তলা ক্ষয় হয়নি? কৃপণ বলল, আরে বল কী! আমি তো জুতা বগল দাবা করে খালি পায়ে হেঁটে এসেছি। এই কাহিনী শোনে মওলানার মেয়ে হেসে দেয় এবং মনে কিছুটা সান্ত¡না নিয়ে ফিরে যায়। (মানাকিবুল আরেফীন, ১খ. পৃ. ৩২৩) মওলানা রুমি বলছেন, আমি সেই মহান পুরুষের গোলাম, যে নিজের অস্তিত্বকে সস্তায় বিক্রি করে না। মহামহিম দয়ার আঁধার করুণাময় ছাড়া আর কারো কাছে না। আল্লাহই তো বলেছেন, তিনি কিনে নিয়েছেন মোমেনের জানমাল বেহেশতের বিনিময়ে।

আগের অধ্যায়ে মওলানা রুমির বক্তব্যের উপসংহার ছিল, আল্লাহর দান, আসমানি সওগাত পেতে হলে অন্তরকে পরিষ্কার, স্বচ্ছ নির্মল করতে হবে। অন্তরের অন্তস্তল থেকে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে হবে। নিজের ভেতর থেকে সম্পূর্ণ বদলে যেতে হবে। কোনো ধরনের রিয়া, লোক দেখানো প্রতারণা, বাইরের বেশভূষার দু’পয়সার দাম নেই আল্লাহর কাছে। বাইরের বেশভূষা, লোক দেখানোর প্রতারণা এই জগতে কাজে এলেও আল্লাহর দরবারে তা ধ্বংস ও অপমান লাঞ্ছনার কারণ হবে। আল্লাহর কাছে একমাত্র দাম সেই লোকের, যার ভেতর ও বাইর এক রকম সৎ, সুন্দর ও আল্লাহর জন্যে নিবেদিত। আল্লাহর কাছে এমন বান্দার দাম কতখানি কবিতার ছন্দে মওলানা বলেন,

চোন বেগিরয়াদ আসেমান গিরয়ান শওয়াদ

চোন বেনালদ চর্খ ইয়া রব খা’ন শওয়াদ

এমন বান্দা যখন কাঁদে আসমানে কান্নারোল পড়ে

রোনাজারিতে আকাশ কাঁদে ইয়া রব ধ্বনি তুলে। (৪৯১)

হাদিস শরিফে আছে, আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন লোকও আছে. তারা যদি কোনো ব্যাপারে আল্লাহর নামে কসম খায়. আল্লাহ অবশ্যই তার কসম পূরণ করেন। অর্থাৎ তার দাবি পূরণ করেন। মওলানা রুমি তাই বলেন, আমি সেই তামার গোলাম, যে ভাঙে না, মচকে না, মাথা নোয়ায় না কষ্টিপাথর ছাড়া কারো কাছে। তামা এখানে বান্দার রূপক আর কষ্টিপাথর মহান আল্লাহকে বোঝানোর রূপক। তোমার যদি কিছু চাই, ভাঙা অন্তর নিয়ে তারই কাছে হাত উঠাও। কারণ, আল্লাহর দয়া ও রহমত ভাঙা অন্তরওয়ালার কাছেই আছে। মুসা (আ.) একবার বলেন, প্রভু হে! তোমায় আমি কোথায় খুঁজে পাব? বললেন, আমার কারণে যাদের অন্তর ভেঙে গেছে তাদের কাছে। কাজেই একটা ভাঙা অন্তর জোগাড় করতে পার কি না সাধনা করো। আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণার পথ ছাড়। কারণ, আল্লাহ যখন তোমার প্রতারণার জন্য পাকড়াও করবেন তোমার হাত-পা কিছুই থাকবে না। পক্ষান্তরে মিথ্যা প্রতারণা, ভন্ডামি লোক দেখানো পসরা ছেড়ে যদি আল্লাহর হয়ে যেতে পার, সবকিছু আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতে পার, তাহলে তোমার জীবন শান্তি সুখে ভরে যাবে। আত্মিক, নৈতিক উন্নতির একেকটি ধাপ অতিক্রম করে অবিরাম এগিয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে সমর্পিত হওয়ার সেই পথ হলো, লোভ ও অহংকার বর্জন।

খাওয়া পরা, কামনা বাসনার লোভের উদাহরণ হাঁস। হাঁস খালে-বিলে, পনিতে শুকনায় সারাদিন ঠোঁট উঁচিয়ে চষে বেড়ায়। আর পদ ও ক্ষমতার লোভের উপমা ময়ূর। ময়ূর নিজের পালক পেখম পুচ্ছের রূপ দেখে আত্মপ্রতারণায় ভোগে। কখনো নিজের কুৎসিত পাটি দেখে আত্মচেতনায় জাগ্রত হয় না। ভোগের লোভের চেয়েও মারাত্মক হলো পদ ও ক্ষমতার লোভ। হাঁসরূপী লোভের ক্ষতি যদি এক গুণ হয়, ময়ূররূপী ক্ষমতার মোহের ক্ষতি পঞ্চাশ গুণ। কামনার লোভ সাপ হলে ক্ষমতার লোভ আজদাহা। দেখ আদমের ভুলটি হয়েছিল খাওয়া আর কামনার লোভে। আর ইবলিসের ভুল ছিল অহংকার ও ক্ষমতার লোভে। উভয়ের পরিণতি দেখ,

লাজরম উ যূদ এস্তেগফার কর্দ

ওয়ান লাঈন আয তওবা এস্তেকবা’র কর্দ

অবশেষে আদম ক্ষমা চান আল্লাহর দরবারে

আর ইবলিস তাওবা করে না, দম্ভ অহংকারে। (৫২)

আদম আলাইহিস সালাম নিজের দোষ স্বীকার করে আল্লাহর দরবারে তওবা করেন, ক্ষমা চান, ইস্তেগফার করেন। তাতে তিনি ক্ষমা পেয়ে যান। কিন্তু আত্মসম্মান পদের পূজারী ইবলিস আল্লাহর হুকুমে আদমকে সেজদা করতে অহংকার দেখায়। পরিণামে সে চির অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত, ৪৭৭-৫২২) ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI