ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২০৬)

গাধার খোঁয়াড়ে হরিণের দুর্গতি

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
গাধার খোঁয়াড়ে হরিণের দুর্গতি

এক শিকারি ফাঁদে ফেলে একটি হরিণ ধরে কৌশলে। বাড়ি এনে হরিণটি বেঁধে রাখে গরু-গাধার খোঁয়াড়ে। যেন কোনো কয়েদি এনে রাখা হয়েছে থানার জেলহাজতে। মুক্ত বনের দূরন্ত হরিণ নিজেকে আস্তাবলে বন্দিদশায় দেখে শুরু করে এদিক ওদিক ছুটাছুটি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের চাদর নামলে শিকারি এক গাদা খড় দিয়ে যায় খোঁয়াড়ে। ক্ষুধার্ত গরু-গাধারা খড়ের গাদায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ যেন মিঠাই মন্ডার ভান্ড নিয়ে পরস্পর কাড়াকাড়ি।

এর মাঝে হরিণের অবস্থা বেহাল বেগতিক। কারণ এখানে তার আনন্দ করার কিছু নেই। গাধা-গরুর খাবারের খোঁয়াড়ে সে বন্দি। কেউ যদি নিজের দুশমনের সঙ্গে কোথাও থাকতে বাধ্য হয়, তার মানসিক যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর হয়। যার সাথে মন-মানসিকতা, চরিত্র ও আচার ব্যবহারে মিল নেই, তার সঙ্গে অবস্থান মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও যন্ত্রনাদায়ক।

হজরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন আল্লাহর নবী ও দুনিয়ার বাদশাহ। তার বিশাল বাহিনী গঠিত ছিল মানব দানব নিয়ে। একবার দূরের সফরে যাত্রাবিরতিতে হাজিরা ডাকার সময় দেখেন, তার সেনাবাহিনীর পক্ষীব্রিগেডের হুদহুদ পাখি গরহাজির। রাগতস্বরে বললেন, বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিতির পক্ষে উপযুক্ত কারণ দর্শাতে না পারলে হুদহুদের গর্দান নেব কিংবা আমি নিজ হাতে তাকে কঠিন শাস্তি দেব। (এমন শাস্তি, যা ধারণা কল্পনার বাইরে)। (সুরা নামাল, আয়াত-২০, ২১)।

রহস্যজ্ঞানী মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, একটুখানি হুদহুদকে কঠিন শাস্তি দেয়ার অর্থ কী হতে পারে। সেই শাস্তি হত, হুদহুদকে তার সমজাতের পাখীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে খাঁচায় বন্দি করে রাখা। কিনমশং হুদহুদ সাবার রাণী বিলকিসের সংবাদ আনায় বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

ব্যস্ত আপনজন ও সমজাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেয়ে কঠিন শাস্তি কল্পনা করা যায় না। তত্ত্বজ্ঞানী মওলানা এবার বলেন, হে মানুষ! তোমার মধ্যে যে ‘তুমি’ সেই তুমিও দেহের খাঁচায় বড় অসহায় বন্দি অবস্থায় আছ। তোমার রুহের এই অচিন পাখিকে বেঁধে রাখা হয়েছে ভিন্ন জাতের পাখির খাঁচায়।

মানুষ সাধারণ প্রাণীর মতো নিছক প্রাণ নিয়ে গড়া প্রাণী নয়। প্রাণের ঊর্ধ্বে আরেক সত্তা নিয়ে গঠিত তোমার অস্তিত্ব। সেই সত্তার নাম রুহ, বাংলায় আত্মা। তোমার আত্মা বন্দি হয়েছে দেহের খোঁয়াড়ে। এই খোঁয়াড় কাক-প্যাঁচাদের আখড়া। কাক-প্যাঁচা বলতে তোমার জৈবিক স্বভাব ও দেহগত চাহিদা। আর তোমার আত্মার তুলনা ‘শিকারি বাজপাখি’। আত্মার বাজপাখি বন্দি হয়েছে দেহের খোঁয়াড়ে, কাক-চিল, হুতুম প্যাঁচার পিঁজরায়। জৈবিক চাহিদার টানাপড়নের বন্দিশালায় সে এখন দুর্গতি দুর্দশায় কাতরায়। হ্যাঁ, এখানে যারা আত্মার অধিকারী, ঊর্ধ্বজগতের হাকিকতের শরাব পানে তারা মাতোয়ারা, সারাক্ষণ অসীমের ধ্যানে মগ্ন। আর যারা জৈবিক স্বভাব ও চাহিদার দাবি পূরণে দুনিয়ার খোঁয়াড়ে মজে আছে, তারা দুনিয়ার ভোগবিলাসিতায় ব্যস্ত ও মত্ত।

ফিরে আসি কাহিনীর ধারাবাহিকতায়। হরিণ বন্দি হয়েছে গরু-গাধার আস্তাবলে। ডাঙ্গায় তুলে আনা মাছের মতো খোঁয়ড়ে সে তড়পায়। এক মুহূর্তও তার শান্তি নেই। অসহায় হরিণকে নিয়ে এক গাধা অন্য গাধাদের সঙ্গে হাসাহাসি করে, তোরা দেখ রে, এই বেটা কি না বনের শার্দুল। হাবভাবে কত ঠাট। চুপ করো তো। আরেক গাধা ঢেঁকুর তুলে বলে, দেখ না তার উথাল-পাথাল। মনে হয় কোনো মণিরত্ন তার হাতের মুঠোয়। এত সস্তায় বিকাতে পারে না তো! তাই তার এই দুর্গতি। আরেক গাধা বলে, চলনে বলনে যে ঠমক চমক। বল গিয়ে কোনো সিংহাসনে বসুক। এই খোঁয়াড়ে কেন? পেট পুরে খেয়ে অলস জাবর-কাটা এক গাধা হরিণকে ডেকে বলে, এসো, শরিক হও আমাদের সঙ্গে খাবারে।

হরিণ মাথা নেড়ে বলে- না। আমার মোটেও খাবারের রুচি নেই। আমি ব্যথায় কাতর। গাধা বলে, জানি, ভণিতা করছ। অথবা এই খাবারে তোমার মান-ইজ্জত যাবে বলে ভয় করছ। হরিণ মনে মনে বলে, হে গাধা! এই খাবার তো তোর আহার। এই খাবার খেয়েই তোর শরীর থাকবে নাদুস নুদুস। তুমি খাও। এগুলো তোমার খাবার। এই আস্তাবলে বন্দি হওয়ার আগে আমি ছিলাম অন্য চারণভূমিতে। সেই চারণভূমি প্রেম, প্রেমাসক্তি ও সান্নিধ্যের। স্বচ্ছ পানির ধারে, নির্মল বায়ুর প্রবাহে শান্তির বাগান ছিল আমার বিচরণক্ষেত্র। তকদীরের ফায়সালা যদিও আমাকে এই দুর্দশায় নিক্ষেপ করেছে, আগের দিনের সেই উন্নত রুচি ও স্বভাব কি আমার অস্তিত্ব হতে মুছে গেছে? কাজেই আমি নফসের কামনা বাসনার অন্ধকূপে কাতরাব, দুনিয়ার ভোগের রাজ্যে সাতার দেব- তা হবে না।

গর গেদা’ গশতম গেদা’ রো কেই শওয়াম

ওয়ার লেবা’সম কুহনে গর্দদ মন নো আম

ভিখারি যদিও কপালের ফেরে স্বভাব তো ভিখারি নয়

লেবাস পুরনো হতে পারে, আমার অস্তিত্ব নিত্যনব।

এ জগতে আল্লাহর প্রেমিক, দুনিয়াপূজারীকে মনের ভাষায় বলে, দুনিয়ার ধন-সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছি, তাই মনে হতে পারে আমি গরিব ভিখারী। কিনমশং মনে ও স্বভাবে আমি ফকির নই। হাদিস শরিফে আছে, যে লোক মনের দিক থেকে ধনী সেই প্রকৃত ধনী। আমার দেহ জীর্ণশীর্ণ ঠিক; কিনমশং আমার হৃদয় প্রশস্ত, বিশাল। আমার এ অবস্থার কারণ, আমি তো হালাল খাবার, বৈধসম্পদ ভোগ করতেও সতর্কতা দেখিয়েছি। সন্দেহজনক কোনো সম্পদ বা হারামের কাছে যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।

গাধা হরিণকে বলে, গালভরা বুলিতে তো টেক্স লাগে না। এখানে তুমি অচেনা-অজানা। তোমার ভেতরে কী আছে কেউ জানে না। কাজেই তোমার বকোয়াসে কেউ বাধা দেয় না। হরিণ বলে, আমার মধ্যে কী আছে আমার কস্তরি নাভিই তার সাক্ষী। যে সুগন্ধির কাছে আম্বর ও চন্দন হার মানে সেই কস্তরি নাভি আমার সঙ্গে আছে। কিনমশং বিষ্ঠার গন্ধে অন্ধ গাধার নাসিকা আমার খুশবু পেতে ব্যর্থ হলে করার কী আছে?

গাধা নিজের পেশাব আর অন্য গাধার পেশাব শুঁকে শুঁকে পথ চলে। তার নাসিকাই তো নষ্ট। আমি কীভাবে মৃগয়া নাভীর সুরভি তুলে ধরব তার কাছে। হারাম হালালের বাছবিচার নেই তাই দুনিয়াপূজারীর রুচিই নষ্ট। এমন লোকের কাছে প্রকৃত জ্ঞানের, আত্মার জগতের সুরভিত পাত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে কীভাবে?

বাহরে ইন গোফত অ’ন নবীয়্যে মুস্তাজীব

রমযে আল ইসলামু ফিদ দুনিয়া গরিব

এ কারণেই ব্যক্ত করেছেন জগতপ্রিয় নবীজি

ইসলাম দুনিয়ায় অচেনা আগনমশংক- এই রহস্য।

‘ইসলাম সে তো পরশ মানিক কে পেয়েছে তারে খুঁজি।’ এই জগতে ইসলামের স্বরূপ অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। ভিন জাতের ফেরেশতারাও ইসলাম, নবীজি ও কোরআনের পরিচয় পেল। অথচ নবীজির আত্মীয় আপনজনদের অনেকেই ইসলাম ও নবীজির স্বরূপ চিনতে ব্যর্থ হলো। তারা বাহ্যদর্শী, দুনিয়াপূজারী তাই নবীজিকে মনে করেছে, তিনিও সাধারণ মানুষ। এ কারণে তার হাকিকত ও স্বরূপ এর সুবাস থেকে তারা বঞ্চিত।

গরুর নকশা করা চামড়ার ভেতরে বাঘ ঢুকেছে। দূর থেকে দেখে লোকেরা মনে করে আস্ত গরু।

কিনমশং চামড়ার ভেতরে যে ব্যঘ্র বিরাজ করে, কয়জনে বুঝতে পারে। তুমি যদি তার হাকিকত বুঝতে চাও, তার প্রকৃত পরিচয় জানতে আগ্রহী হও, তোমার দেহের ওপর জড়ানো গরুর চামড়া, পশুত্বের স্বভাব, দুনিয়াপূজার মাতলামী ছেড়ে বের হয়ে এসো। মনে রেখ, গরু-গাধার স্বভাব তোমাকে ছাড়তেই হবে। তোমার ভেতরে যে ‘তুমি’ বিরাজ করছে সে তুমির পরিচয় তোমাকে জানতেই হবে।

তুমি ইসলামের বাঘ, বাঘের সাহস তোমার শিরায় শিরায়। ওহে সিংহ শার্দুল! গরুর স্বভাব, কাপুরুষতা, দুনিয়ার তুচ্ছ জিনিসের জন্য প্রাণপাত করার মাদকতা তুমি ত্যাগ কর। জনমশং জানোয়ারের খাসলত-আচরণ অতিক্রম কর। যদি নিজে না পার, এমন কারো সন্নিধ্যে যাও যিনি এই পথে সিংহশার্দুল। যিনি সিংহশার্দুলের মতো দুনিয়াকে বর্জন করে চলেছেন। যিনি আল্লাহর প্রেমে আত্মহারা। যার কাজে ও চিন্তায় কেবলই আল্লাহর দ্বীনের মগ্নতা।

গাও বাশী শীর গর্দী নযদে উ

গর তো বা’ গাওয়ী খোশী শীরী মাজু

গরু হলে তোমায় বদলে দেবেন সিংহ শার্দুলে

গরু থাকতে চাও, আস্ফালন করো না সিংহের।

ধরে নিলাম তুমি গরুর স্বভাব ছাড়তে পারছ না, দুনিয়াপূজা তোমাকে ছাড়ছে না। প্রকৃত জীবন সম্পর্কে মূর্খতার অবসান হচ্ছে না, সেই আল্লাহওয়ালার সুহবতে গেলে তার হেদায়াতের আলোতে তোমাকে এমনভাবে উদ্ভাসিত করবেন, যার ফলে তোমার অন্তর সিংহশার্দুলে পরিণত হবে। দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতাকে তুচ্ছজ্ঞানে বর্জন করতে পারবে। আর যদি গরুর স্বভাব নিয়ে দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতায় মজে থাকাতে চাও কখনো বলবে না যে, আমি ঈমান ও ইসলামের সৈনিক, সিংহের মতো সাহসী আমার পদক্ষেপ। কারণ, তুমি নিজেকে বদলাতে উদ্যোগী না হলে তোমার কপাল বদলাবে না। কাজেই আগে নিজেকে বদলানোর সাধনা করো।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-৮৩৩-৯৩১)। (ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়াপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন- ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত