মানব জীবনে গোনাহের কুপ্রভাব

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহর হুকুমের অমান্যতাই গোনাহ। গোনাহের প্রভাবে মানুষ জীবনে বিভিন্ন প্রকার বিপদাপদের শিকার হন। সৃষ্টির শুরুলগ্ন থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীতে মানুষ যত ধরনের আজাব-গজব, ধ্বংস-পতন, অনাচার-কদাচার, জানমালের ক্ষতিসহ শারীরিক এবং মানসিক বিপদাপদের সম্মুখীন হয়েছেন, সেগুলোর মূল কারণ ছিল মানুষের গোনাহ। অপরাধ। দুনিয়া আখেরাতের আজাব গজব থেকে পরিত্রাণ পেতে গোনাহমুক্ত জীবন গঠন করা আবশ্যক।

গোনাহ ধ্বংস ও অভিশপ্ততার কারণ : দুনিয়ার ইতিহাসে চোখ বুলালে দেখা যায়, আজ পর্যন্ত যারাই আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছেন কিংবা অভিশপ্ততার শিকার হয়েছেন। সব ঘটেছে গোনাহের কারণে। আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন? আদম হাওয়াকে জান্নাত থেকে বের হতে হয়েছিল কেন? কোনো জিনিসে ইবলিসকে ফেরেস্তাদের সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি থেকে আলাদা করে দিয়েছে? কী কারণে ইবলিস অভিশপ্ত হয়েছে? নূহ সম্প্রদায় মহা-প্লাবনে ডুবে মরল কেন? আ’দ জাতীর ওপর ধ্বংসাত্মক বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল কেন? ভেবে দেখেছেন! কীসের জন্য ফেরাউন সমগ্র জাতিসহ উত্তাল সাগরে ডুবে গিয়েছিল? কোন জিনিসে কারুনকে ধসিয়ে দিয়েছিল মাটিতে? একটু ভাবুন তো! দাউদের অনুসারীরা বানরে পরিণত হয়েছিল কেন? ভাবলে জানা যাবে এ সবের কারণ ছিল, আল্লাহর হুকুমের অবাধ্যতা। মানুষের পাপ। যেমনটা আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, সুতরাং তাদের প্রত্যেককেই আমি তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছিলাম (সুরা আনকাবুত : ৪০)।

গোনাহ মানবের কষ্ট ও অপদস্থতার বাহন : গোনাহ নামক বাহনের করে মানুষের কাছে কষ্ট ও অপদস্থতা আসে। পৃথিবীতে মানুষ যে কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপদস্থতার শিকার হয়, তার একমাত্র কারণ গোনাহ। নবীজি বলেছেন, আদম সন্তান কাঁটার আঘাতপ্রাপ্ত হয় না কিংবা হোঁচট খায় না, তবে সেটা হয় তার গোনাহের কারণে (তারিখণ্ডদেমাস্ক ২৪:১৯০)। গোনাহ এমন এক-ধ্বংসাত্মক বিষয়, যা কোনো দেশে দেখা দিলে সেই দেশকে ধ্বংস করে দেয়। অন্তরে প্রকাশ পেলে সেই অন্তরকে অন্ধ বানিয়ে দেয়। আর কোনো জাতীর মধ্যে প্রকাশ পেলে সেই জাতিকে লাঞ্ছনা ও অপদস্থতার জিঞ্জির পড়ায়। মনে রাখবেন, গোনাহ কেবল ধ্বংসই করতে পারে।

পারস্য বিজয়ের পর সাহাবি আবু দারদার ক্রন্দন : আব্দুর রহমান ইবনু জুবাইর বলেন, কাবরাস বিজয় সম্পন্ন হলে, সেখানের বন্দি বাসিন্দাদের আলাদা করা হচ্ছিল। যার কারণে তারা ক্রন্দন করছিলেন। আমি দেখতে পেলাম, সাহাবি আবু দারদা (রা.) অদূরে একাকি বসে ক্রন্দন করছেন। আমি তাকে বললাম, হে আবু দারদা! আপনি এমন একটি দিনে কাঁদছেন, যে দিন আল্লাহ ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্মানিত করেছেন। বিজয় দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনার কান্নার কারণ কী? আবু দারদা বললেন, যখন কোনো জাতি আল্লাহর আদেশের অমান্য করে, তখন আল্লাহ তাদের লাঞ্ছিত করেন। এক সময় এরা শক্তিশালী, শৌর্যবীর্যময়। এক জাতি ছিল। সমগ্র দুনিয়ায় ছিল তাদের রাজত্ব। আল্লাহর হুকুম ছেড়ে দেয়ার কারণে আজ তাদের এই অবস্থা। মনে রাখবে! এই লাঞ্ছনা আল্লাহর আদেশ অমান্য কারার ফল। শরিয়তের বিরুদ্ধাচারণের পরিণতি। গোনাহ এবং পাপের ফসল। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতির জন্যও একমাত্র দায়ি তাদের কৃত গোনাহ (মুলতাকাল-খুতাবা)।

গোনাহ ব্যক্তিকে রিজিক থেকে বঞ্চিত করে : গোনাহের কারণে মানুষ রিজিক ও অন্যান্য নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়। অভাব-অনটনের সম্মুখীন হয়। অসচ্ছলতার কষাঘাতগ্রস্ত হয়। কোরআনে এসেছে, ইয়াহুদিদের জুলুম এবং আল্লাহর পথ থেকে বাঁধা দেয়ার কারণে তাদের জন্য হালাল জিনিসকে হারাম করেছিলাম (সুরা নিসা : ১৬০)। অন্যত্র এসেছে, আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয়ই তার জীবন-যাপন (রিজিক) সংকুচিত করা হবে (সুরা ত্বহা:১২৪)। সাহাবি সাওবান (রা.) হতে বর্ণিত, নবীজি বলেছেন, ব্যক্তি স্বীয় গোনাহের কারণে রিজিক থেকে বঞ্চিত হয় (ইবনু মাজাহ : ৪০২৩)।

গোনাহের কারণে অন্তর কালিমাযুক্ত হয় : গোনাহের প্রভাবে মানুষের স্বচ্ছ-সফেদ অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। হৃদয় কালিমাযুক্ত হয় যায়। আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে। নবীজি বলেছেন, বান্দা যখন একটি গোনাহ করে তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো চিহ্ন পড়ে। আবার যখন সে গোনাহের কাজ পরিহার করে, ইস্তেগফার ও তাওবাহ করে তখন তার অন্তর দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এভাবে তার পুরো অন্তর কালো দাগে ঢেকে যায়। এটাই সেই মরিচা যার কথা আল্লাহ বলেছেন, কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনে জং-মরিচা ধরিয়েছে। (তিরমিজি : ৩৩৩৪)।

গোনাহের কারণে অন্তর অন্ধ হয়ে মারা যায় : গোনাহের প্রভাবে মানুষের অন্তরে অন্ধকার অনুভূত হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই গোনাহের কারণে চেহারায় আচ্ছন্নতা জেঁকে বসে এবং অন্তর অন্ধকার হয়। হাসান (রহ.) বলেছেন, গোনাহের আধিক্যতায় অন্তর অন্ধ হয়ে যায় এবং একটা পর্যায়ে তা মারা যায় (তাফসিরে ত্ববারি ২৪:২৮৭)। মৃত মানুষ যেমন কারো উপকার করতে পারে না। তেমনি মরা অন্তরে ভালো বিষয়ের উদ্রেগ হয় না।

নেক-আমলের প্রতি অনীহা জন্মায় : গোনাহের অন্যতম খারাপ প্রভাব হচ্ছে, এর কারণে ব্যক্তির ভালো কর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। সৎ কাজের প্রতি মন নিস্পৃহ হয়। ইবাদত ও আমলে স্বাদ পায় না। অসুস্থ ব্যক্তি খাবারে যেমন তৃপ্তি পায় না, তেমনি গোনাহ আসক্ত ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতে মজা ও স্বাদ অনূভব করেন না।

 

অন্যান্য গোনাহের ধারা চালু হয় : গোনাহের প্রভাব সমূহের অন্যতম প্রভাব হলো, একটি গোনাহ অন্য একটি গোনাহের দরজা খুলে দেয়। উন্মোচিত করে অবারিত পাপের রাস্তা। যা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তির জন্য কঠিন হয়ে যায়। যেমন যারা নামাজি তারা প্রস্রাব পায়খানা হতে সঠিকভাবে পরিস্কার হয়। পক্ষান্তরে যারা বেনামাজি তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রস্রাব করে ঢিলা-কুলুপ, টিস্যু ইত্যাদিও ব্যবহার করেন না। বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিদানে অভ্যস্ত ব্যক্তি নিজের স্ত্রী, কন্যাদের পর্দার ব্যাপারে অমনোযোগী হয়। এভাবে এক গোনাহ অপর গোনাহের দরজা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এভাবে দু’চোখ বন্ধ করে ভাবুন! বুঝতে পারবেন, কোন গোনাহের কারণে কোন গোনাহের দ্বার খুলে যাচ্ছে।

তওবা কবুলের সৌভাগ্য অর্জিত হয় না : আল্লাহর নিকটে তওবাহ কবুল করা মানুষের জীবনের পরম চাওয়া-পাওয়া। কিন্তু গোনাহের কারণে ব্যক্তির অন্তর এতটাই কঠিন হয়ে যায় যে, এর কারণে তওবার প্রয়োজনীয়তা অন্তরে অনূভব হয় না এবং মৃত্যু পূর্ববর্তী তওবা কবুলের সৌভাগ্য অর্জন হয় না।

লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর