খাওয়া-দাওয়ার নিয়মকানুন

শরিফ আহমাদ

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহর একটি বড় নেয়ামত খাদ্য। সুস্থ সবল শরীরে আল্লাহর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে সুষম খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন। কোরআনে পবিত্র ও হালাল খাদ্য গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, হে মোমিনগণ! আহার করো আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর শোকর করো, যদি তোমরা তারই ইবাদত করে থাক। (সুরা বাকারা : ১৭২)। পানাহারের আরেকটি মূলনীতি হলো- প্রয়োজন মতো খাওয়া কিন্তু অপচয় না করা। বর্ণিত হয়েছে, তোমরা খাও, ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ : ৩১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) খানার সুন্নাত তরিকা ও আদব-কায়দা শিক্ষা দিয়েছে।? এর ফলে খানা নিছক ভোজন রসিকতার জন্য নয় বরং একটি ইবাদতে রূপান্তরিত হয়েছে। এটা প্রতিদান ও বিনিময়ের একটি উপলক্ষে পরিণত হয়েছে।

খাওয়ার আগে হাত ধোয়া সুন্নাত : খাওয়ার আগে উভয় হাত কবজি পর্যন্ত ধৌত করা সুন্নাত। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা রোগ জীবাণু থেকে বাঁচার বড় একটি মাধ্যম। সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি তাওরাতে পড়েছি, খাদ্যের বরকত হলো এর পরে অজু করা। নবী কারিম (সা.) এর নিকট আমি এ কথা আলোচনা করলাম এবং তাওরাতে যা পড়েছি এর উল্লেখ করলাম। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, খাবারের বরকত হলো এর আগে ও পরে অজু করা। (তিরমিজি : ১৮৪৬, আবু দাউদ : ৩৭১৯)।

খাওয়ার তিনটি সুন্নাত : এক. খাওয়া-দাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নাত। পূর্ণ বাক্যটিও বলা যায়। দুই. ডান হাতে খাওয়া সুন্নাত। এটা মুসলিমদের একটি বৈশিষ্ট্য। তিন. সম্মিলিত খাবার খাওয়ার সময় প্রত্যেকে যার যার সম্মুখ থেকে খাওয়া সুন্নাত। উমর ইবনে আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ছোট ছেলে হিসাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে ছিলাম। খাবার বাসনে আমার হাত ছুটাছুটি করত। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, হে বৎস! বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে আহার কর এবং তোমার কাছের থেকে খাও। এরপর থেকে আমি সব সময় এ পদ্ধতিতেই আহার করতাম। যার যার কাছ থেকে আহার করা। আনাস (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, তোমরা বিসমিল্লাহ বলবে এবং প্রত্যেকে তার কাছ থেকে আহার করবে। (বোখারি : ৪৯৮৪)।

দোয়া না পড়ার ক্ষতি : খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়তে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্র বিসমিল্লাহি আউয়ালাহু ওয়াখিরাহু পড়তে হয়। (আবু দাউদ : ৩৭২৫) দোয়া না পড়ে খাওয়া শুরু করলে শয়তান খাদ্যে শরিক হয়। খাবারের বরকত নষ্ট হয়ে যায়। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী কারিম (সা.) কে এরূপ বলতে শোনেন যে, যখন কোন ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশ করে এবং ভেতরে প্রবেশের সময় ও খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলে, তখন শয়তান বলে, এখানে তোমাদের জন্য রাতে থাকার কোনো স্থান নেই, আর খানাও নেই। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশের সময় বিসমিল্লাহ বলে না, তখন শয়তান বলে, তোমরা রাতে থাকার স্থান পেয়েছ। এরপর সে ব্যক্তি খাবার সময় যখন বিসমিল্লাহ বলে না, তখন শয়তান (তার সাথীদের) বলে, তোমরা রাতে থাকার স্থান এবং খাবার পেয়ে গেছ। (আবু দাউদ : ৩৭২৩)।

দস্তরখানের সঠিক ব্যবহার : দস্তরখানের সঠিক পরিচয় অনেকের কাছে এখনো অজানা। তাই এটার ব্যবহার নিয়ে বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হয়। মূলত খাবার যে বস্তুর উপর রেখে খাওয়া হয় তাকেই দস্তরখান বলা হয়। অর্থাৎ যে প্লেট বা পাত্রের মধ্যে খাবার রেখে খাওয়া হয়, সেটাই প্রকৃত দস্তরখান। এই দস্তরখান ব্যবহারের গুরুত্ব আছে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন নবী কারিম (সা.) কখনও সুকুরজা অর্থাৎ ছোট ছোট পাত্রে আহার করেছেন, তার জন্য কোনো সময় নরম রুটি তৈরি করা হয়েছে কিংবা তিনি কখনো টেবিলের উপর খাবার খেয়েছেন বলে আমি জানি না। কাতাদাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তাহলে তারা কীসের উপর আহার করতেন। তিনি বললেন, দস্তরখানের উপর। (বোখারি : ৪৯৯৪)। সমাজে কাপড় বা প্লাস্টিকের তৈরি প্রচলিত দস্তরখানা ব্যবহার সুন্নাত না হলেও উত্তম একটি কাজ। এর উপর পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খাওয়া যায়। এতে বরকত হাসিল হয়। অবশিষ্ট খাবারা এবং দস্তরখান উঠানোর সময় এই দোয়া পাঠ করতে হয়। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারিম (সা.)-এর দস্তরখান তুলে নেয়া হলো। তিনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহি হামদান কাছিরান তাইয়্যিবান মুবারাকান ফীহি গইরা মাকফ্যিয়িন ওয়ালা মুআদ্দায়িন ওয়ালা মুসতাগনা আনহু রব্বানা। (বোখারি : ৫০৬৩)।

খাওয়ার সর্বোত্তম বৈঠক : খাওয়ার সর্বোত্তম বৈঠক পদ্ধতি হলো এমনভাবে বসা যেন খাবারের সম্মান রক্ষা হয়। বিনয় প্রকাশ পায়। কোনোভাবেই অহংকার এবং খাবারের প্রতি অবজ্ঞা যেন প্রদর্শিত না হয়। সুতরাং খাবার খাওয়ার সময় তিন পদ্ধতিতে বসা যায়। এক. উভয় হাঁটু উঠিয়ে এবং পদ যুগলে ভর করে। (মুসলিম : ৫১৫৯) দুই. এক হাঁটু উঠিয়ে এবং অপর হাঁটু বিছিয়ে। (শরহুস সুন্নাহ: ৩৫৭৭) তিন. উভয় হাঁটু বিছিয়ে অর্থাৎ নামাজে বসার ন্যায় বসে সামান্য সম্মুখ পানে ঝুঁকে আহার করা। (আবু দাউদ : ৩৭৩১) ওজরের কারণে অন্যভাবে বসা অথবা একটু আরাম করে বসার ইচ্ছায় চার জানু হয়ে বসার মধ্যে কোনো গুনাহ নেই।

চেয়ার টেবিলে খাওয়ার বিধান : প্রয়োজনে চেয়ার টেবিলে বসে খাবার খাওয়া জায়েজ আছে। তবে মাটিতে বসে খাওয়া সুন্নাতের অধিকতর নিকটবর্তী। তাই যতদূর সম্ভব মাটিতে বসে খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত। জাস্টিস মুফতি তাকি উসমানী হাফি : লিখেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই কারণে মাটিতে বসে খেতেন। এক. তখনকার যুগে জীবন যাপন সহজ সরল ও সাধারণ ছিল। চেয়ার টেবিলের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এই কারণে নিচে বসতেন। দুই. নিচে বসে খাওয়ার মধ্যে অনেক বিনয় প্রকাশ পায় এবং খাবারের প্রতি সম্মানও হয়। এই জন্য নিচে বসে খেতেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো খিওয়ান (টেবিল জাতীয় উঁচু স্থানে) এর উপর খাবার রেখে আহার করেননি এবং ছোট ছোট বাটিতেও আহার করেননি। আর তার জন্য কখনো পাতলা রুটি তৈরি করা হয়নি। ইউনুস বলেন, আমি কাতাদা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, তা হলে তারা কীসের উপর আহার করতেন? তিনি বললেন, দস্তরখানের উপর। (বোখারি : ৫০২১)।

খাওয়ার সময় কথা বলা : অনেকের ধারণা খাওয়ার সময় কথা বলা জায়েজ নেই। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি কথা?। আহার করার সময় প্রয়োজনীয় কথা বলা যায়। এটা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমল থেকে প্রমাণিত হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, আহারের মাঝে কোনো গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা না হওয়া চাই। সাধারণ কথা হলে ক্ষতি নেই। কেননা, খাবারেরও হক আছে। তাই একেবারে চুপচাপ না থেকে টুকটাক কথা বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আলাপের ঝড় তোলা কাম্য নয়।

আঙুল চেটে খাওয়া সুন্নাত : খাবার শেষে আঙুল চেটে খাওয়া সুন্নাত। কিন্তু আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অনেকে এটাকে এড়িয়ে যেতে চায়। ভাবে এটা অভদ্র ও অমার্জিত কাজ। স্মরণ রাখা উচিত যাবতীয় ভদ্রতা ও সভ্যতার চাবিকাঠি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ও সুন্নাত। তিনি যেটাকে ভদ্রতা বলেছেন সেটাই ভদ্রতা। কে কী বলল, সেটা দেখার বিষয় নয়। রাসুল (সা.) প্রথমে মধ্যমা তারপরে তর্জনী এবং সবশেষ বৃদ্ধাঙ্গুলি চেটে খেতেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো খাবার খেতেন তখন তার আঙুল তিনটি চেটে নিতেন এবং তিনি বলেছেন, যদি তোমাদের কারো লুকমা পড়ে যায়, তবে সে যেন তা থেকে ময়লা দূর করে এর খাদ্যটুকু খেয়ে ফেলে, শয়তানের জন্য যেন তা রেখে না দেয়। আর তিনি আমাদের বাসন মুছে খেতে আদেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন। কেননা, তোমরা জান না, তোমাদের খাদ্যের কোনো অংশে বরকত আছে। (মুসলিম : ৫১৩৪)।