ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুরা ফাতেহার ফজিলত

শাহাদাত হোসাইন
সুরা ফাতেহার ফজিলত

আল কোরআন মহামহিম স্রষ্টার মহামান্বিত গ্রন্থ। যাতে বিধৃত হয়েছে মানুষের সফলতার মূলমন্ত্র। যার অনুসরণ ব্যক্তিকে পৌঁছাতে পারে কামিয়াবির শীর্ষ চূড়ায়। আর অনুকরণহীনতায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে ব্যর্থতার আস্তাকুঁড়ে। সেই মহাগ্রন্থের মহান সুরার নাম সুরাতুল ফাতেহা। যা কোরআনের প্রারম্ভে লিখিত। যা দিয়ে নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সূচনা হয়। এই সুরার যত ফজিলতের কথা কোরআন হাদিসে এসেছে, অন্য কোনো সুরার ব্যাপারে তেমনটা আসেনি। আসুন, সুরা ফাতেহার ফজিলত সম্পর্কে জেনে নেই।

সুরা ফাতেহা এমন এক-মহান সুরা যার মধ্যে সমগ্র কোরআনের সারমর্ম বিধৃত হয়েছে। সাহাবি সাঈদ ইবনে মুয়াল্লা (রা.) বলেন, একদিন নবীজি আমাকে বললেন, মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বেই আমি কি তোমাকে এমন একটি সুরা শিখাব, যা কোরআনের সর্বাধিক মহান সুরা? অতঃপর নবীজি আমার হাত ধরলেন। এরপর যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাকে মসজিদ থেকে প্রস্থানের পূর্বে কোরআনের সর্বাধিক মহান সুরা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। নবীজি বললেন, হ্যাঁ। আর তা হলো, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন (বোখারি : ৪৪৭৪)।

সুরায়ে ফাতেহা কোরআনের সর্বোত্তম সুরা। সাহাবি আনাস (রা.) বলেন, নবীজি এক-স্থানে বসা ছিলেন। হঠাৎ সেখান থেকে নিচে নামলেন। তার দেখাদেখি সাহাবিরাও নিচে নামলেন। আমি তার দিকে তাকালে তিনি বললেন, আমি কি তোমাকে কোরআনের সর্বোত্তম সুরা স¤পর্কে জানিয়ে দেব? তারপর তিনি বললেন, সেটি হলো, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন (আমালুল-ইয়াওমণ্ডওয়াল-লাইলাতি:৭২৩)। সাহাবি আবু জার (রা.) বলেন, আমি রাতের আঁধারে মদিনার কোনো এক গলিতে নবীজির সাথে ছিলাম। সে সময় একজন ব্যক্তি সুরা ফাতেহা দ্বারা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছিলেন। তা শ্রবণে নবীজি সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং শেষ হওয়া পর্যন্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে তা শুনলেন। সমাপান্তে তিনি বললেন, পুরো কোরআনে এর সমতুল্য কোনো সুরা নেই। (মুজামুল-আওসাত : ২৮৬৬)। সুরায়ে ফাতেহা নিজেই নিজের তুল্য। তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল এমনকি কোরআনেও তার সমতুল্য কোনো সুরা নেই। সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল এমনকি কোরআনেও আল্লাহতায়ালা সুরা ফাতেহার মতো কোনো সুরা অবতীর্ণ করেননি (নাসাঈ : ৯১৪)।

সুরা ফাতেহা আরশে-আজিমের ধন-ভান্ডার : সাহাবি আনাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে, নবীজি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে এমন এক বস্তু দিয়েছেন, যার দ্বারা তিনি আমার ওপর গর্ববোধ করেন। তিনি বলেছেন, আমি তোমাকে ফাতেহাতুল কিতাব দিয়েছি। যা আমার আরশে-আজিমের ধন-ভান্ডার। আমি তা তোমার এবং আমার মাঝে দুইভাগে বিভক্ত করেছি (ফাজায়েলুল- কোরআন : ১১৮)।

সুরা ফাতেহা এবং রবের মধ্যে কোনো পর্দা নেই : আলি ইবনে আবি তালেব (রা.) বলেন, নবীজি বলেছেন, সুরায়ে ফাতেহা, আয়াতুল কুরসি, শাহিদাল্লাহু আন্নাহু লা-ইলাহা ইল্লাহু এবং কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল-মুলক এই সমস্ত আয়াত আরশে-আজিমে ঝুলন্ত আছে। এগুলোর মাঝে এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই (আল-বয়ান ফি-আদ্দি-আয়াল কোরআন : ২৮)।

আল্লাহকে একান্তভাবে আহ্বানের সুরা : ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, সুরা ফাতেহা আল্লাহতায়ালাকে একান্তভাবে আহ্বান করার সুরা। সেই জন্য নামাজকে এই সুরার সাথে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কেননা, নামাজি ব্যক্তি তার রবকে একান্তভাবে ডাকেন। আর বান্দা স্বীয় রবকে সর্বোত্তম কালাম দ্বারাই আহ্বান করে থাকেন। আর তা বান্দা এবং আল্লাহর মাঝে দু’ভাগে বিভক্ত (তাফসিরু সুরাতিল ফাতিহা লি-ইবনে রজব : ৪০)।

সুরা ফাতেহা পূর্ণ কোরআনের ভাবার্থকে সমন্বয়কারী : ইবনে আবি হাতেম উল্লেখ করেন, আল্লাহতায়ালা ৪০৪টি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। এই সমস্ত কিতাবের ভাবার্থকে তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল এবং কোরআনসহ চার কিতাবে একত্রিত করেছেন। আবার এই চারটি কিতাবের সারমর্মকে কোরআনে একত্রিত করেছেন। আর কোরআনের স¤পূর্ণ ভাবার্থকে সুরা ফাতেহায় একত্রিত করেছেন। আবার সুরা ফাতেহার ইলমণ্ডজ্ঞানকে ইয়্যাকাণ্ডনা’বুদু ওয়া-ইয়্যাকাণ্ডনাস্তাইন আয়াতে সন্নিহিত করে দিয়েছেন (তাফসিরু সুরাতিল ফাতিহা লি-ইবনে রজব:৪১)।

সুরা ফাতেহা পাঠ চার কিতাব পাঠের সমতুল্য : সুরা ফাতেহার গুরুত্ব ও ফজিলত এতটাই বেশি যে, এই সুরার পাঠকে আসমানি বড় চারগ্রন্থ পাঠের সমতুল্য বলা হয়েছে। সাহাবি আবু উবায়দা (রা.) বলেন, নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাতিহাতুল কিতাব পাঠ করল, কেমন যেন সে তাওরাত, জাবুর, ইঞ্জিল এবং কোরআন পাঠ করল (ফাজায়েলুল-কোরআন:১১৭)।

সুরা ফাতেহা সর্বোরোগের মহৌষধ : সুরা ফাতেহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সর্বরোগের মহৌষধ। এটি অন্তরের রোগের চিকিৎসায় যেমন কার্যকারী তেমনি শারীরিক রোগ হতেও পরিত্রাণ দানকারী। নবীজি বলেছেন, ফাতেহাতুল কিতাব মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের মহৌষধ। যেমনটা কোরআনে এসেছে, হে লোকসকল! তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে উপদেশ ও অন্তরসমূহে যা আছে তার আরোগ্য এবং মোমেনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত (সুরা ইউনুস: ৫৭)।

মানুষ এবং জিন শয়তান থেকে রক্ষাকারী : সুরা ফাতেহার আমল মানুষকে জাদুটোনা থেকে মুক্তি দেয়। মানুষ এবং জিন শয়তান থেকে হেফাজত করে। নবীজি বলেছেন, বান্দা যদি তার পার্শ্বকে স্বীয় বিছানায় রেখে বিসমিল্লাহ এবং সুরা ফাতেহা পাঠ করে, তাহলে জিন শয়তান এবং মানুষ শয়তানের খারাবিসহ অন্যান্য অনিষ্ট বিষয় থেকে নিরাপত্তা লাভ করবে (আল-মুজামুল আওসাত: ৪৫৯৪)।

পূর্ববর্তী কোনো নবীকে এমন সুরা দেয়া হয়নি : দুনিয়ার শুরু লগ্ন থেকে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যত নবী এসেছেন, তাদের কাউকে এমন মর্যাদাপূর্ণ সুরা দেয়া হয়নি। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, একদিন জিবরাইল (আ.) নবীজির পাশে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায়, ওপরের দিকে একটি আওয়াজ শুনে তিনি মাথা ওপরের দিকে উত্তোলন করলেন। অতঃপর বললেন, আসমানের এই দরজাটি আজকে খোলা হয়েছ, যা এর আগে কখনো খোলা হয়নি। সেখান দিয়ে কিছু ফেরেস্তারা অবতরণ করলে তিনি বললেন, এই ফেরেস্তারা আজকেই প্রথম দুনিয়াতে অবতরণ করেছেন। ইতোপূর্বে তারা কখনোই দুনিয়াতে আসেননি। (হে নবী) আপনি দু’টি নুরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যা কেবল আপনাকে দেয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে কোনো নবী-রাসুলকে তা দেয়া হয়নি। তা হচ্ছে, সুরা ফাতেহা এবং সুরা বাকারার শেষাংশ (মুসলিম : ২৫৪)।

লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত