বরিশালের অলিয়ে কামিল

মাওলানা মির্জা মুহাম্মদ এনায়েতুর রহমান বেগ (রহ.)

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অসংখ্য মাদ্রাসা মসজিদ খানকা প্রতিষ্ঠা করে কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা প্রচারে যাদের মহান অবদান রয়েছে, তাদের মধ্যে জনাব আলহাজ হজরত মাওলানা মির্জা মুহাম্মদ এনায়েতুর রহমান বেগ আল কাদেরী (রহ.) অন্যতম। ১৯৩৯ সনের এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ মুতাবেক ১৩৪৬ সালের পহেলা বৈশাখ সোমবার সুবহে সাদিকের পবিত্র সময়ে বরিশালে তাঁর জন্ম হয়। তার পিতা বিখ্যাত পীর আলহাজ হজরত মাওলনা ইয়াছিন বেগ আল কাদেরী (রহ.) ছিলেন একজন ওলিয়ে কামিল ও বুজুর্গ ব্যক্তি। তাই পারিবারিকভাবে সম্ভ্রান্ত আলিম বংশের সন্তান হিসেবে ধর্মীয় পরিবেশেই বড় হতে থাকেন মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ।

বরিশাল শহরের আমানতগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল জামিয়া ইসলামিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন। এ মাদ্রাসা হতেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন তিনি। প্রকৃত জ্ঞানী সর্বদাই জ্ঞানের অতৃপ্তিতে ভোগেন। কোরআন-হাদিস ও ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেও মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ অতৃপ্ততার যাতনা অনুভব করেন। জ্ঞান স্পৃহা তাকে বেকারার করে তোলে। তাই তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘বাংলার দেওবন্দ’ হিসেবে খ্যাত ‘দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’ মাদ্রাসায় ইলম শিক্ষার জন্য ছুটে যান। দেওবন্দ থেকে বড় বড় শায়খরা এখানে প্রায়ই তাশরিফ আনতেন বিধায় তাদের সাহচর্য লাভের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর প্রবল। তিনি সকলকে মুগ্ধ করে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিসসহ উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বরিশালে ফিরে এসে বরিশাল চর কাউয়া কামিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। সেখানে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং মাদ্রাসার উন্নয়ন সাধন করেন। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। শরিয়তের ইলম শিক্ষা সমাপ্ত করে ইলমে মারিফত শিক্ষা গ্রহণে তিনি আত্মনিয়োগ করেন, স্বীয় পিতা কামিল ওলি হজরত মাওলানা ইয়াছিন আল কাদেরী (রহ.) এর হাতে বয়াত গ্রহণ করে মারিফতের শিক্ষা ও অনুশীলন শুরু করেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি চারি তরিকায় পূর্ণ কামালিয়াত হাসিল করেন। এরপর স্বীয় পিতার নির্দেশে দীন প্রচারে মনোনিবেশ করেন। অতি অল্প সময়েই সর্বগুণে গুণান্বিত আবেদ, আলেম, ইসলাম প্রচারক হিসেবে তার নাম দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ১৯৬৩ সনের নভেম্বর মাসে বিশ্ব বিখ্যাত পীর, কামিল ওলি কুতুবে যামান হজরত মাওলানা শাহ আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) এর প্রথমা কন্যার সাথে মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ সাহেবের শাদি মোবারক সুসম্পন্ন হয়। এ ঘটনায় বেগ সাহেবের জীবনে বহুমুখী চেতনার বিকাশ ঘটে। একদিকে স্বীয় পিতার দীক্ষা অন্যদিকে যুগশ্রেষ্ঠ ওলি শ্বশুরের নেক ফয়েজে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চ মার্গে পৌঁছে যান। উভয় দিক থেকে তিনি খিলাফতপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় দ্বীনি শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি জনসাধারণকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও শিক্ষাদান করতে থাকেন। ১৯৭০ সনে তার মহান পিতা ইন্তেকাল করেন। এতদিন তিনি চরকাউয়া কামিল মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। পিতার ইন্তিকালের পর ১৯৭২ সনে তিনি বরিশাল মাহমুদিয়া মাদ্রাসার সহ-অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। একই সনে তিনি মাদ্রাসার কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দুটি পদে অধিষ্ঠিত থেকে কোরআন ও হাদিসের খেদমত করেছেন। তৈরি করেছেন ইসলামের অসংখ্য খাদেম, মুবাল্লিগ, হাফেজ, আলিম ও কারি। তিনি (১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৭৮ এবং ১৯৮৭ ইং সনে) মোট চারবার পবিত্র হজ পালন করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি মিশর, ইরাক, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফর করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ১৯৭৫ সনে বাগদাদে বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর মাযার শরিফে তিনি দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইরাকের তৎকালীন পীর ও বড়পীর ছাহেবের মাযার মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব হজরত ইউসুফ জিলানি (রহ.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর কর্তৃক খিলাফতপ্রাপ্ত হন। মাদ্রাসায় শিক্ষা দানের পাশাপাশি তিনি দেশের বহু অঞ্চলে ব্যাপক সফর করে মৃত্যু পর্যন্ত ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপৃত থাকেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি বহু মাদ্রাসা, মসজিদ, মক্তব, খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ সাহেব দ্বীনের প্রচারের জন্য অনেক গ্রন্থও রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে কোরবানি কী ও কেন, ঈদ মোবারক, রমজানুল মোবারক, শবেকদর, মাহে মুহাররম ও শবেবরাত প্রভৃতি অন্যতম। ১৯৮৮ সনের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি তার স্ত্রীর উন্নত চিকিৎসার জন্য লঞ্চযোগে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। গভীর রাতে লঞ্চে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পথিমধ্যে রাতেই লঞ্চ থামিয়ে তাঁকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। কিন্তু তিনি শেষ রাতে আবারও অসুস্থ্ হয়ে পড়েন এবং ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮ মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ঢাকায় ইন্তেকার করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার মৃত্যু সংবাদে বাংলাদেশের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ওই দিন দুপুরে ঢাকা গাউসুল আজম মসজিদ কমপ্লেক্সে গোসল করিয়ে বাদ আসর ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাজার হাজার আলিম ওলামা পীর মাশায়েখের উপস্থিতিতে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তৎকালীন খতিব হজরত মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.)। একই লঞ্চে আবার ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে মরহুমকে নিয়ে রওয়ানা করা হয়। আনুমানিক রাত একটার সময় যখন তাকে নিয়ে লঞ্চ বরিশাল টার্মিনালে পৌঁছায়, সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায়। এত অসংখ্য শোকাভিভূত মানুষ সেখানে একত্রিত হয়েছিল যে, লঞ্চ চালক লঞ্চ তীরে ভেড়াতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কারণ এত মানুষ মরহুমের কফিন বহনের জন্য লঞ্চে উঠে আসলে লঞ্চও ডুবে যেতে পারে। অবশেষে তাকে তাঁর নিজ বাসভবন আমানতগঞ্জ মাওলানা মির্জা ইয়াছিন মঞ্জিলে নিয়ে আসা হয়। এরপর তার কফিন সর্বসাধারণের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তার কর্মস্থল মাহমুদিয়া মাদ্রাসা ও জামে এবাদুল্লাহ মসজিদে কিছু সময় রাখা হয়। এরপর বরিশালে দ্বিতীয় জানাযা বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিখ্যাত পীর কুতুবুল আকতাব শাহ আবু জাফর মুহাম্মদ ছালেহ (রহ.) জানাজায় ইমামতি করেন। তাতে দলমত নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। জানাজার নামাজে চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সাহেবসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন দরবারের পীর সাহেব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রীবর্গ, একাধিক সংসদ সদস্য, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বরিশালের কেন্দ্রীয় হেমায়েত উদ্দীন ঈদগাহ ময়দানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় একইসাথে পাশের ব্লেস পার্ক ময়দানে নিয়ে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আমানতগঞ্জ থেকে ঈদগাহ ময়দান পর্যন্ত রাস্তার চারপাশে অসংখ্য মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সমবেত হয়েছিল। এমনকি ভিন্ন ধর্মের মানুষরাও রাস্তার ?দুপাশ থেকে তার কফিনে গোলাপজল ও ফুল ছিটিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন। তারাও সবাই গভীর শোকে শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর বরিশালের কেন্দ্রীয় মুসলিম গোরস্থানে তার মরহুম পিতার পাশে তাকে শায়িত করা হয়।

মরহুম মাওলানা মির্জা এনায়েতুর রহমান বেগ আল কাদেরী (র.) ১৯৭০ সন থেকে বরিশাল জামে এবাদুল্লাহ মসজিদের পেশ ইমাম ও খতিব হিসেবে মৃত্যুদিন পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ১৯৭০ সালে তার মহান পিতার ইন্তেকালের সাথে সাথে মসজিদ কমিটির মুতাওয়াল্লি ও ?মুসল্লিদের সর্বসম্মতিক্রমে তিনি তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি আর্তপীড়িতদের সেবা ও সমাজসেবামূলক অনেক কার্যক্রমে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।