বাংলার বরিত সুফি দরবেশ
মাহমুদ হাসান ফাহিম
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামের সাথে আমাদের সম্পর্ক সুপ্রাচীন। বাংলার পরতে পরতে মিশে আছে ইসলাম। ইসলাম তার জন্মলগ্নেই এই ভূমিতে এসে জায়গা করে নিয়েছে। প্রিয়নবীর সাহাবাদের হাত ধরেই ইসলামের আগমন। তবে যুগে যুগে সুফি-সাধকরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছেন এই বাংলায়। তাদের কয়েকজনের পরিচয় ও অবদান তুলে ধরা হলো:
শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) : নাম আব্দুল কুদ্দুস। ‘শাহ’, ‘মখদুম’, ‘রূপোশ’ ইত্যাদি তার উপাধি। তিনি শাহ মখদুম রূপোশ নামেই খ্যাত। ৬১৫ হিজরি মোতাবেক ১২১৬ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বাগদাদ শহরে এক বিখ্যাত সুফি পরিবারে তার জন্ম। দাদা বড়পির হজরত আব্দুল কাদির জিলানী। পিতা সায়্যিদ আযাল্লাহ শাহ। বাল্যকাল কাটে বাগদাদে। জ্ঞানচর্চার হাতে-খড়ি হয় পিতার কাছে। শিশু বয়সেই ভর্তি হন কাদেরিয়া মাদ্রাসায়। তীক্ষè মেধার কারণে অল্প বয়সেই কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ, সুফিতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন।
তাতারীদের বাগদাদ আক্রমণের আগেই তার পিতা সপরিবারে সিন্ধুতে হিজরত করেন। সেখানে থাকাকালীন ইসলামের উচ্চতর বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এক পর্যায়ে কাদেরীয়া তরিকার সিদ্ধ পুরুষে পরিণত হন। সে সময় তাকে ‘মখদুম’ খেতাব দিয়ে ভূষিত করা হয়। সিন্ধুর পর দিল্লিতে বসবাস করেন কয়েক বছর। ৬০ ঊর্ধ্ব বয়সে ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার তিন ভাই এবং শতাধিক অনুসারী নিয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আগমন করেন। তিন-তিনবার যুদ্ধ করেছেন। প্রথমে বোখরা খানের সাথে তিনি গৌড়ে বসবাস শুরু করেন। তারপর নোয়াখালী সোনাইমুড়ীর শ্যামপুর গ্রামে ধর্ম প্রচারের কাজ করেন। কাঞ্চনপুরে একটি খানকাও নির্মাণ করেন। এখানে দুই বছর থাকার পর গৌড়ে ফিরে আসেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। তার অনেক ভক্ত অনুরাগী তৈরি হয়। তার অনুপম চরিত্র, আর ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আসে। মূলত তার হাতেই বরেন্দ্র এবং গৌড় অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। হিজরি ৭১৩ সালের ২৭ রজব মোতাবেক ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। বর্তমান রাজশাহীর দরগাপাড়ায় তাকে সমাহিত করা হয়।
খানজাহান আলি (রহ.) : খানজাহান আলি (রহ.) ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আকবর খাঁ এবং মাতা আম্বিয়া বিবি। তার উপাধি হলো, ‘উলুঘ খান’ ও ‘খান-ই-আযম’। বলা হয় যে তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন তুর্কির বাসিন্দা। লেখাপড়ার বিসমিল্লাহ হয় তার পিতার কাছে। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লির বিখ্যাত অলিয়ে কামেল শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.)-এর কাছে। লেখাপড়ার জীবনে তিনি কোরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।
১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্প সময়েই পদোন্নতি হয়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান। ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান গভর্নর নিযুক্ত হন।
শাসকরূপে জীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে ধর্ম প্রচার ও জনসেবাই ছিল তার প্রধান কাজ। স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতাবান মহাপুরুষ। দুস্থ মানুষের মুখে অন্ন, পানির কষ্ট নিবারণের জন্য অসংখ্য দীঘি খনন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, হাট-বাজার স্থাপন ও মানুষের ধর্মীয় উপাসনার জন্য উপাসানালয় নির্মাণ করে প্রকৃত শাসকের পরিচয় দিয়েছেন।
তিনি বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে বর্তমান বাগেরহাটে ইসলাম প্রচার করেন এবং সেখানে তিনি জনকল্যাণে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরিশালের কিছু অংশ নিয়ে ‘খলিফাতাবাদ’ নামে একটি রাজ্য গড়ে তোলেন। এই রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল বর্তমান বাগেরহাট জেলার ষাটগুম্বুজ মসজিদ। এ মসজিদ থেকেই খলিফাবাদ রাজ্য পরিচালনা করা হতো।
মাজারের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরি ২৬ জিলহজ মোতাবেক ২৫ অক্টোবর ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময় তার বয়স ছিল ৯০ বছর।
শাহজালাল (রহ.) : উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ শাহ জালাল। উপনাম মুজাররদ। ২৫ মে ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে ইয়ামানের এক দরবেশ পরিবারে জন্ম। তার পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ।
শাহজালাল মুজাররদ তার মামা ও গুরু সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে শিক্ষারত ছিলেন। ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখার পর মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে এ কথা জানালে তিনি তাকে ভারতবর্ষে আসার পরামর্শ দেন। মক্কা হতে একাণ্ডএকাই যাত্রা করেন ভারতের উদ্দেশে। আসার পথে সমরকন্দ, রোম, ইরান, গুজরাট, আজমীর, দাক্ষিণাত্য ও মধ্যপ্রদেশ হয়ে দিল্লি পৌঁছেন। পথে অনেকেই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার সঙ্গী হন। দিল্লি পৌঁছার পর তাদের সংখ্যা হয় ২৪০ জন। এখানে থাকাকালীন খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।
এরপর ইসলাম প্রচারের লক্ষে তার ভক্ত অনুরক্তসহ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে আগমন করেন। সিলেট অঞ্চলে মূলত তার মাধ্যমেই ইসলামের ব্যাপক প্রচার ঘটে। জালেম শাসক গৌর গোবিন্দের পতনের মাধ্যমে সিলেট বিজয় হয়। এরপর শাহ জালালের সঙ্গী-অনুসারী, পির-দরবেশ এবং তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। শাহজালালের সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার মৃত্যুর তারিখ নিয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়, তবে ঐতিহাসিক ইবনে বাতুতার মতে, তিনি ৭৪৬ হিজরি মোতাবেক ১৫ মার্চ ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর তাকে সিলেটেই সমাহিত করা হয়।
শাহ সুলতান রুমি (রহ.) : জানা যায়, শাহ সুলতান রুমি তার শিক্ষক সৈয়দ শাহ সুরখুল আন্তিয়া এবং দশজন শিষ্যের সাথে ১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৪৪৫ হিজরিতে বাংলায় আসেন। সময়টা ছিল মুসলিম সেনাপতি বখতিয়ার খলজির আগমনের এক শতাব্দী আগে এবং শাহ জালালের সিলেট বিজয়ের ২৫০ বছর আগে।
শাহ রুমি ও তার সঙ্গীরা বর্তমান নেত্রকোণায় বসতি স্থাপন করেন। এখানে তখন কোনো মুসলমান ছিল না। তাদের দাওয়াতে সে অঞ্চলের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাজার কাছে এ সংবাদ পৌঁছালে, শাহ রুমিকে রাজ দরবারে ডেকে পরীক্ষায় সম্মুখীন করা হয়। ঈমানি পরীক্ষায় বিজয়ী হলেন তিনি। এতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে রাজা বাধ্য হয়ে তাকে মদনপুর ও পার্শ্ববর্তী কিছু গ্রাম নিষ্কর দান করেন।
জানা যায়, যখন শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার সদলবলে রাজা পরশুরামের রাজধানী মহাস্থানগড়ে ইসলামের দাওয়াত দেন। পরশুরাম ইসলামের কথা শুনে ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। বগুড়ায় মুসলমানদের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে শাহ সুলতান রুমি দল নিয়ে বগুড়ায় যাত্রা করেন। যুদ্ধে পরশুরামের বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করেন। ফলে বগুড়া মুসলমানদের হাতে আসে। কিছুদিন সেখানে থাকার পর সঙ্গীদের নিয়ে পূর্ব বঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় টাঙ্গাইলের মধুপুর এবং জামালপুর জেলার দুর্মোট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করন। তারপর ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব তীরে বোকাইনগর পরগনায় আসেন। সেখানকার সামন্ত শাসক বোকাই কোচ ইসলাম কবুল করার পর খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকের মধ্যভাগে ৪০ জন সঙ্গীসহ সামন্ত রাজ মদন মোহন কোচের পরগনা মদনপুরে আগমন করেন। বাকি জীবন এই অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং এখানেই তার সমাধি।
শাহ সুলতান বলখী (রহ.) : শাহ সুলতান বলখী। তার আরেক নাম মাহিসাওয়ার বলখী। পিতা শাহ আলি আসগর। তিনি আফগানিস্তানের বলখ রাজ্যের সম্রাট। পিতার মৃত্যুর পর তাকেই সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্য ছেড়ে দরবেশি জীবন বেছে নেন। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে তিনি বাংলাদেশে সন্দীপ অঞ্চলে আসেন।
তারপর সেখান থেকে মহাস্তানগড়ে যাত্রা করেন। যা বর্তমান বগুড়ার পূর্ব নাম। এখানে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন।
রাজা পরশুরামের সেনাপ্রধান, মন্ত্রী এবং কিছু সাধারণ মানুষ ইসলাম কবুল করে মুসলমান হন। দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এভাবে পুন্ড্রবর্ধনের মানুষ হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করতে দেখে পরশুরাম ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। ফলে পরশুরামের সাথে শাহ সুলতান বলখীর বিরোধ সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ শুরু হয় দুইদলের মাঝে। এ যুদ্ধে রাজা পরশুরাম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তার মৃত্যু হয়। ইতিহাসবিদ প্রভাষ চন্দ্র সেন রচিত ‘বগুড়ার ইতিহাস’ (১৯১২ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ১০৪৩ মোতাবেক ৪৩৯ হিজরিতে রাজা নরসিংহ বা পরশুরামকে আফগানিস্তান থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক সুফী শাহ সুলতান বলখী যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। শাহ সুলতান বলখী কীভাবে এবং কখন ইন্তেকাল করেন বা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।