সুফিসাধক আশরাফ আলি থানভি (রহ.)

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আশরাফ আলি থানভি উপমহাদেশের বহুল পরিচিত ও চর্চিত একটি নাম। ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক সাধক মানুষের কাছে তিনি বরিত ও অনুসৃত। আশরাফ আলি থানভি নিকট অতীতে পাক-ভারতের এ অঞ্চলের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী একজন সুফি আলেম। তিনি সুফি-সাধক হলেও মানব জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তার সরব পদাচরণ ছিল। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি। তার প্রেরণায়ই হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে ধর্মেরভিত্তিতে আলাদা দুটো রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল।

আশরাফ আলি থানভি (রহ.) ১৯ আগস্ট ১৮৬৩ সন মোতাবেক ৫ রবিউস সানি ১২৮০ হিজরিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের শামলি জেলার থানা ভবনে জন্ম গ্রহণ করেন। সে দিকে সম্পৃক্ত করে তাকে থানভি বলা হয়। কোরআনের হেফজসহ উর্দু, ফারসি ও আরবি সাহিত্যের প্রাথমিক লেখাপড়া থানা ভবনে শেষ করে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে।

সুফিবাদের সবক গ্রহণ : দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র থাকাবস্থায় সুফিবাদের পাঠ নেন মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহি (রহ.) থেকে। মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহির নিকট বায়আত গ্রহণের এক বছর পর তিনি হজ পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। সেখানে হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মাক্কির সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি তার কাছে বায়আত গ্রহণের মাধ্যমে তার শিষ্যত্ব হাসিল করেন। হজ থেকে ফিরে তিনি নিয়মিত সুফিবাদের অজিফা আদায়ে মনোযোগী হন।

আলোময় কর্মজীবন : লেখাপড়া শেষে কর্মজীবনের শুরুতেই ১৩০০ হিজরি সনে তিনি কানপুরের ফয়জে আম মাদ্রাসায় ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হন। এরপর কানপুর শহরের জামেউল উলুম মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস হিসেবে নিযুক্ত হন। দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত থাকেন। সে সময়ে হাজার হাজার ছাত্র তার জ্ঞানের মহাসাগর থেকে ইলম অর্জনে ধন্য হন। সময়ের হেফাজতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। এক মুহূর্তও হেলায়-খেলায় নষ্ট করতেন না। সেখানে থাকাবস্থায় ছাত্রদের লেখাপড়ার পাশাপাশি গ্রন্থ রচনায় নিমগ্ন থাকতেন। সহস্রাধিক তার লিখিত গ্রন্থ রয়েছে। নব-যুবক হওয়া সত্ত্বেও কানপুরের জনসাধারণ তাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। তার কথা শুনতেন। তার কাছ থেকে তাসাউফের সবক নিতেন।

আশরাফ আলি থানভির তাসাউফ চর্চা : মাওলানা আশরাফ আলি থানভি স্বীয় পির ও মুরশিদ হাজি এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মাক্কির নির্দেশক্রমে ১৩১৫ হিজরি সনে কানপুর ছেড়ে আবার থানা ভবনে ফিরে আসেন। সেখানে খানকায়ে এমদাদিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় শিক্ষকতার মতো মহান পেশা ছেড়ে এবার তিনি স্বীয় পিরের কথা মতো তাসাউফের কাজে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এখানে এসে তিনি মানুষের আত্মার ডাক্তার বনে যান। হাজার হাজার মানুষ তার কাছ থেকে আত্মশুদ্ধি ও তাসাউফের সবক নেয়। মানুষের অন্তর-আত্মাকে পাপ পঙ্কিলতার কলুষতামুক্ত করতে, মানুষের মননকে আসমানি আলোয় উদ্ভাসিত করতে, পুরোদস্তুর সুফিবাদের প্রাজ্ঞ শিক্ষক হয়ে ওঠেন তিনি। হাকিমুল উম্মত তথা উম্মতের আধ্যাত্মিক ডাক্তার হিসেবে জগৎময় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। পাক-ভারতে তার শিষ্যদের মধ্যে প্রচুর আলেম ও তলাবা রয়েছে। যারা এ ধারায় সম্পৃক্ত থেকে আধ্যাত্মিক সাধনা অব্যাহত রেখেছে।

রচনা ও দাওয়াত : আশরাফ আলি থানভির ইলম ও ইসলামি প্রজ্ঞা ছিল অত্যন্ত গভীর ও বিস্তৃত। তার লিখিত গ্রন্থের পাতায় পাতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আশরাফ আলি থানভির রচনাকৃত গ্রন্থের সংখ্যা সহস্রাধিক। তবে প্রকাশিত ছোট বড় গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০। বেহেশতি জেওর নামে তার একটি গ্রন্থ আছে, যার চাহিদা এতটাই বেশি, দুনিয়াব্যাপী প্রতি বছর হাজার হাজার কপি ছাপা হয়। তার লিখিত কোরআন তরজমা অত্যন্ত সাহিত্যসমৃদ্ধ, প্রাঞ্জল ও জ্ঞানউদ্দীপক। বয়ানুল কোরআন তার রচনাকৃত এক অনন্য তাফসির। গোটা দুনিয়ার হাজার হাজার মানুষ বিশেষত পাক-ভারত-বাংলাদেশের মানুষ তার কাছ থেকে আধ্যাত্মিক তরবিয়ত গ্রহণ করেছেন। মৃত্যুর পরও তার অগণিত গ্রন্থাবলির মাধ্যমে এখনও অসংখ্য মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।

আত্মশুদ্ধির মজলিস : খানকায় তাসাউফ ও আধ্যাতিকতা শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি পাক-ভারত-বাংলাদেশের মাঠে ময়দানে সর্বসাধারণের উদ্দেশে ওয়াজ-নসিহত করেতন। ‘খুতুবাতে হাকিমুল উম্মত’ তার সেসব বয়ানের সংকলন। তার এ খুতবা সংকলনগুলো খুবই প্রভাববিস্তারক। প্রতিটি খুতবা তার পাঠকের হৃদয়ে রেখাপাত করে। ভাবায় জগৎ ও পরকাল সম্পর্কে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ খুতবাগুলো তার পাঠককে দুনিয়া ও আখেরাত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঐশী শক্তি সঞ্চয়ে সহায়তা করে। যাকে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতারই অংশ বলা চলে। মোটকথা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ইলম, হিকমত, মারেফত ও আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ ছিল তার ব্যক্তিত্ব। তাসাউফ ও তরিকতের এই ঝর্ণাধারা থেকে অর্ধ শতাব্দীকাল পর্যন্ত পাক-ভারত-বাংলাদেশের মানুষ ব্যাকুল হৃদয়ের তৃষ্ণা নিবারণ করে চলেছেন।

ইন্তেকাল : পথহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশাদানকারী এ মহান পুরুষ ১৬ রজব ১৩৬২ হিজরি সন মোতাবেক ১৯৪৩ সনে থানা ভবনে ইন্তেকাল করেন। হাফেজ জামেন শহীদের কবরের পাশে তাকে কবরস্থ করা হয়।

লেখক : খতিব, বায়তুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর