বছর কয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানী ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন ড. আহমদ তামীমদারী। তিনি ইরানের একজন নামকরা মসনবি গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের জন্য এসেছিলেন বাংলাদেশে তার সাথে বন্ধুত্ব অনেক গাঢ় হয়েছিল মওলানা রুমি ও মসনবি সূত্রে । একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মসনবিতে মওলানা রুমি (রহ.) এমন দু’একটি গল্পের অবতারণা করেছেন, যেগুলোকে আমরা অশ্লীল বলে থাকি। কারণ কী? তিনি জবাব দিলেন, মওলানাকে পথ চলতে কখনো নালা নর্দমায় পা দিতে হয়েছে। পরক্ষণেই তিনি লাফ দিয়ে উঠে গেছেন এবং পাঠকদের নিয়ে গেছেন উর্ধ্বজগতের নীলিমায়। তিনি নর্দমায় পড়ে থাকেননি। নৈতিক শিক্ষার সুন্দর আসর সাজিয়ে পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত মানুষকে সতর্ক করেছেন জীবনের ভবিষ্যৎ ও পরিণামের চেতনায় উজ্জীবিত করে।
সে ধরনের একটি গল্প এখন আমাদের সামনে। এই গল্পের কাঠামো ধারণ করার ক্ষমতা পত্রিকার ছোট্ট পরিসরের নেই। তাতে অসুস্থ মনের লোকেরা আক্রান্ত হতে পারে। তাই গল্পের কাঠামো মূল মসনবির জন্য উহ্য রেখে আমরা এর শিক্ষাগুলো তুলে ধরতে চাই। বর্ণনা নিরস মনে হলেও আশাকরি অন্তর্নিহিত শিক্ষাগুলোকে ধারণ করার পথ আমরা খুঁজে পাব। মওলানা বলেন,
মেইলে শাহওয়াত কার কুনাদ দেল রা’ ও কূর
তা’ নামা’য়াদ খার চো য়ুসুফ না’র নূর
কামনার তাড়না অন্তরকে করে বধির, অন্ধ-আতুড়
গাধাকে দেখায় ইউসুফরূপে আগুন হয়ে যায় নুর।
মানুষকে যখন যৌনকামনার তাড়না পেয়ে বসে তখন গাধার মতো বিশ্রী প্রাণীও তার কাছে অনিন্দ্য সুন্দর ইউসুফ (আ.)-এর মতো প্রতীয়মান হয়। নিজের মধ্যে আগুন জ্বলে; অথচ মনে করে, আমি জ্যোতির বলয়ে আছি। অনেক লোক আছে, যারা আগুন খুঁজে বেড়ায়, আগুনের পেছনে ছুটে; অথচ মনে করে, নুরের দরিয়ায় আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। অহমিকার গাধায় সওয়ার হয়েছে; অথচ ভাবে যে, আমি জীবনের উন্নতিতে অনেকদূর এগিয়ে গেছি।
এমন অবস্থা হতে তার নিস্তারের উপায় কী? মওলানা জবাব দেন, আল্লাহর পক্ষ হতে কোনো আকর্ষণ এলেই শুধু কেউ এমন অবস্থা হতে নাজাত পেতে পারে। তখনই তার সম্মুখ থেকে আগ্নেয় স্বভাব ও চিন্তা সরে যাবে। বুঝতে পারবে, জীবনে উন্নতি করেছে বা তরীকতের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে বলে যে ধারণা, তা মিথ্যা, বাতিল, প্রবঞ্চনা। কেননা, একমাত্র আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ ছাড়া নিজেকে কামিল, জীবনে উন্নত মনে করার কারণ নেই। কারণ দুনিয়ার যতকিছুই অর্জন করুক, সবই তো ধ্বংসশীল, কৃত্রিম। আর লোভ ও মোহের যে আকর্ষণটি সবচেয়ে মারাত্মক তা হচ্ছে যৌন কামনা।
যেস্তহা’ রা’ খোব বেনামা’য়াদ শারাহ
নীস্ত চোন শাহওয়াত বাতার য’াফা’তে রাহ
কুৎসিত লোভ ও মোহকে দেখায় লোভনীয় শোভনরূপে
সংগ্রামে সাধনায় বড় আপদ নাই যৌন কামনার চেয়ে।
সুনাম সুখ্যাতির অধিকারী বহু লোককে যৌনতা বদনামির শিকার করেছে। শত হাজার বিচক্ষণকে আহম্মক গাধায় পরিণত করে ছেড়েছে। চিন্তা কর, যৌন উন্মাদনা যেখানে গাধাকে ইউসুফ (আ.) এর মতো সুন্দররূপে দেখায়, সেখানে ইউসুফকে আরো কত সুন্দরভাবে চিত্রিত করতে পারে তোমার সামনে? যৌন উন্মাদনার আগুন যেখানে বিষ্ঠাকে দেখায় মধুরূপে সেখানে মধুকে কতরূপে দেখাতে পারে তা কি চিন্তা করা যায়?
মওলানা পরামর্শ দেন, যৌনতার উন্মাদনা আনে ভুরিভোজ। কাজেই তোমার খাওয়ার পরিমাণ কমাও আর বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হও। কারণ, অর্জন হতে বর্জন আর উপার্জন থেকে খরচের পথ বের হয়। যে কোনো ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে। ভুরিভোজের প্রতিক্রিয়া যৌনতা আর লোভের আগুন প্রজ্জ্বলিত হওয়া। একে প্রতিরোধ করার পথ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, রোজা পালন, বিবাহবন্ধন আর চিন্তা ও সাধনায়, উঠায়-বসায় আল্লাহর স্মরণ। এটিই ধর্মের বিধান। সত্যিই বিবাহবন্ধন লা হাউলা পড়ে শয়তানের ফাঁদ হতে আশ্রয় নেয়ার মতো অবলম্বন।
জীবন যুদ্ধে নফস তোমার বাহন। দুনিয়ার, সংসারের নানা প্রয়োজন তুমি সম্পূর্ণ বর্জন করতে পার না। কাজেই নফসের বাহনে সওয়ার হয়ে যে পথচলা সেটিই জীবন, সেটিই সাধনা। এই বাহন ছাড়া তুমি চলতে পারবে না। তবে তার লাগাম মুঠোয় রাখতে হবে শক্ত হাতে। নফস গাধার পিঠের উপর সাধনার কৃচ্ছ্রতার বোঝা চাপিয়ে রাখতে হবে। নচেৎ সে লাফ দেবে। উৎপাত করবে। শেষে তোমাকেই মাটিতে আছাড় দেবে।
নফসের আরেকটি উদাহরণ, সে আগুন। আগুন ছাড়া জীবন অচল। তবে আগুনের ব্যবহার তোমার জানতে হবে। ব্যবহার না জানলে দূরে সরে থাক আগুনের কাছ থেকে। নফসকে তার খাবার নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলা ও হারামের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে দিয়ো না। রান্নাবান্নার উদাহরণ সামনে রাখ। চুলোতে কখন ডেকসি বসাতে হয়, আগুন কখন জ্বালতে হয়, পানি কতটুকুন কখন দিতে হয় জানতে হবে। নচেৎ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাবে। কামারের পেশা যদি রপ্ত না থাকে আগুনের বাতির কাছে যেয়ো না, তাহলে তোমার চুল-দাড়ি পুড়ে যাবে। নফস আর নফসের সহযোগী দুনিয়াকে ভোগ ব্যবহার করার মাত্রা ও পরিমিতি তাই তোমাকে জানতেই হবে। নচেৎ তোমার জীবন তছনছ হয়ে যাবে।
এই জানার জন্যই তরিকতের সাধনা আর শরিয়তের সীমানা।
নফসে আম্মারার ফাঁদে পড়ে আমিত্বের অহমিকায় যদি তুমি মারা যাও, তাহলে তোমার পরিণাম হবে সেই গৃহকত্রীর মতো, যে গোপনে দাসীর যৌনাচার দেখে প্ররোচিত হয়েছিল আর অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে তার মাশুল গুণতে হয়েছিল। হ্যাঁ, নফসের উপমা গাধা। যদি নফসের অনুগত হয়ে জীবন যাপন কর, তাহলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তোমাকে উত্থিত করবেন গাধার আকৃতিতে। কেননা, সেদিন প্রত্যেকের অন্তর্গত অবস্থাই বাস্তব রূপ নেবে। ‘সেদিন সবার গোপন রহস্যসমূহ প্রকাশ্য রূপ নেবে।’ (সুরা তারেক : ৯)। সবার কর্মসমূহ আকৃতি ধারণ করে উপস্থিত হবে। যার চরিত্রে যে স্বভাবের প্রভাব বেশি সেই সূরত ধারণ করেই প্রত্যেকের হাশর হবে। সেদিনের অপমান হবে দোযখের আগুনের চেয়েও জঘন্য। আল্লাহতায়ালা কাফেরদের ভয় দেখিয়েছেন দোযখের আগুনের। কাফেররা বলবে, হে আল্লাহ! অপমান লজ্জা তো আরো জঘন্য দোযখের আগুনের চেয়ে।
চোন দার উফতাদ দার গেলুশা’ন হাবলে দা’ম
দা’না খোরদান গাশত বার জুমলে হারাম
ফাঁদের রশি যখন ফেঁসে যায় তাদের গলায়
পানাহার তাদের চিরতরে হারাম হয়ে যায়।
গল্পের গৃহকত্রী তার কণ্ঠনালীর আন্দায মতো গ্রাস মুখে দেয়নি। ফলে গলায় খাবার আটকে তার মুত্যৃর কারণ হয়েছে। ওহে মানুষ! তুমি খাবারের গ্রাস তোমার মুখের আন্দাযে খাও। মিষ্টান্ন বিরিয়ানী হলেও সীমা অতিক্রম করো না, খবরদার! কিন্তু লোভীরা এসব মানতে চায় না। তারা সবকিছু নিজের জন্য চায়; শেষ পর্যন্ত সবকিছু হারায়। যেনে রেখ লোভই তোমার বিভ্রান্তকারী দুশমন।
তুমি বুযুর্গদের জ্ঞানের কথা চুরি করে বলে বেড়াও, নিজেকে জাহির কর বড় জ্ঞানী ও বুযুর্গরূপে। তুমি সুনাম সুখ্যাতির লোভাতুর। তোমার উদাহরণ সেই পাখি, যার সামনে পাতানো ফাঁদে ছড়ানো লোভনীয় খাবার। বড়রা জানে খাবার কোনটি বা ফাঁদ কোথায়। যারা বর্ণচোরা বুযুর্গ তারা ফাঁদ দেখে না, শুধু খাবার হাতায়। সেই খাবার মুখে বুযুর্গীর ভাব দেখায়, নানা বুলি আওড়ায়। তাতে নফসের পাতানো ফাঁদে আটকে যায়। সতর্ক পাখিরা একবার ঠোকর দেয়, তিনবার তাকায়। তারা ফাঁদের খাবারে আটকা পড়ে না। তুমিও খাও, দুনিয়াকে ভোগ করো, তবে যাতে ফাঁদে আটকা না পড়, পরিমিতি ঠিক রাখ। তুমি বলতে পার, আল্লাহ তো বলেছেন ‘তোমরা খাও আর পান কর।’ কিন্তু তিনি যে বলেছেন, ‘আর তোমরা অপচয় করো না’ সে কথা কেন তোমার চিন্তায় আসে না? জ্ঞানী ব্যক্তিরা দুনিয়ার নেয়ামত ভোগ করে আন্দাজ মতো। ফলে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় না। কিন্তু মূর্খরা দুনিয়াকে লুটেপুটে খেতে গিয়ে আটকে যায়, লজ্জিত হয়, সব হারিয়ে বঞ্চিত হয়।
মোর্গে গাফেল মী খোরাদ দা’না যে দা’ম
হামচো আন্দার দা’মে দুনিয়া ইন আওয়া’ম
অসতর্ক পাখি যেভাবে খাবার খায় পাতানো ফাঁদে
নফসে আক্রান্তরা সেভাবে হাতড়ায় দুনিয়া, কাঁদে।
ফাঁদের দানাতে বিষ মিশ্রিত। দুর্ভাগ্য সে পাখির, যে দানা খোঁজে পাতানো ফাঁদে। শিকারীর ফাঁদে ধরা পড়লেও সতর্ক পাখি পার পেয়ে যায়। শিকারী বিচক্ষণ পাখি দেখে সুন্দর কণ্ঠস্বর ও গানের জন্য খাঁচায় পালে। সভা মজলিসে নিয়ে যায়। মূর্খ দেহসর্বস্ব পাখিরা প্রাণ দেয় শিকারির দুবেলা খাবারে। কারণ গায়ের গোশত ছাড়া তার কাছে যে আর কিছু নাই।
এই উপমা নিছক দুনিয়া শিকারীদের জন্য নয়। যারা আধ্যাত্মিক জগতের বুযুর্গদের বেশ ধারণ করেছে তাদের পরিণামও ভিন্ন নয়। তারা আলখেল্লা আর আচকান ছাড়া কিছুই শিখেনি বুযুর্গদের কাছ থেকে। মনের স্বচ্ছতা, মোহমুক্তি, ইবাদতে নিষ্ঠা, কথা ও কাজে সততার কিছুই রপ্ত করেনি পীরালির দরবার হতে। এরা বোকা মুরীদদের মাঝে বুযুর্গীর আস্ফালন করে।
হারয়্যকী দার কাফ আসা’ কে মূসা আম
মী দামাদ বার আবলাহা’ন কে ঈসা আম
লাঠি হাতে প্রত্যেকে বলে বুযুর্গীতে আমি এ যুুগের মুসা
আহম্মকদের উপর মন্ত্র পড়ে সর্বরোগনাশী আমি ঈসা।
আফসোস সেদিনের জন্য যেদিন তোমার কাছে দাবি করা হবে কথা ও কাজের সততা। পরীক্ষার কষ্টিপাথরে ধরা পড়বে তোমার সততা বা বক্রতা। সেদিন কোনো কিছুই লুকানো যাবে না। জারিজুরি ফাঁশ হয়ে যাবে। জীবনের কর্মফল বাস্তব রূপ নিয়ে হাজির হবে। তোমার আমার পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
‘আল্লাহতায়ালা বলেন, সেদিন সৎ লোকেরা তাদের সততার কল্যাণেই লাভবান হবে।’ (সুরা মায়েদা : ১৯)। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৩৩৩-১৪২৯)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন-
CHAYAPATH PROKASHONI)