ইসলাম পুরুষের ওপর স্ত্রী-সন্তানের যাবতীয় দায়িত্ব অর্পণ করেছে। বিয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত একজন স্বামী এ দায়িত্ব পালন করেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কর্মক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারেন। কোরআন-হাদিসে এর নির্দেশনা ও উদাহরণ রয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং তোমরা ওর আকাঙ্ক্ষা করো না, যা দ্বারা আল্লাহ একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, পুরুষরা যা উপার্জন করেছে তাতে তাদের অংশ রয়েছে এবং নারীরা যা উপার্জন করেছে তাতে তাদের অংশ রয়েছে এবং তোমরা আল্লাহরই নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে মহাজ্ঞানী। (সুরা নিসা : ৩২)। ঘরোয়াভাবে নারীদের আর্থিক উন্নতির বৈধ কিছু উপায় এখানে উল্লেখ করা হলো।
নারী উদ্যোক্তা হওয়া : একজন নারী তার স্বকীয়তা, আলাদা বৈশিষ্ট্য, মান-সম্মান ও পর্দা বজায় রেখে আয় উপার্জনের পথ বেছে নিতে পারেন। ব্যবসা-বাণিজ্য অংশগ্রহণ করতে পারেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সুরা বাকারা :২৭৫)। এই আয়াতে ব্যবসা হালাল হওয়া এবং সুদ হারাম হওয়া নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। একজন নারীও পুরুষের মতো হালাল পন্থায় অনলাইন অফলাইনে যেমন ব্যবসা করতে পারেন। নারীদের ব্যবসার উপর নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত কোন বিধান বর্ণিত হয়নি। একজন ধার্মিক নারী যদি ছোট বা মাঝারি ব্যবসা শুরু করেন, তাহলে এতে অন্য নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া একজন নারীকে বেপর্দার সাথে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার চেয়ে উত্তম হবে। অবশ্য নারী অনলাইনে কাজ করার ক্ষেত্রে পর্দার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। সে নিজে কণ্ঠ দিবে না। সামনে প্রদর্শিত হবে না। কোনো পুরুষ মানুষের মাধ্যমে পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। অথবা শুধু নারীদের সঙ্গে লেনদেন করবে।
কুটির শিল্পে মনোযোগী হওয়া : একজন নারী কুটির শিল্পে মনোযোগী হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারেন। অবদান রাখতে পারেন আর্থ সামাজিক উন্নয়নে। ইসলাম নারীদের জন্য কুটির শিল্প সমর্থন করে। এই কাজ নারীদের ঘরোয়াভাবে করা সম্ভব এবং পরিবারের জন্য উপকারী। কুটির শিল্পের মধ্যে অন্যতম মাটির পাত্র, নকশী কাঁথা, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, হাতের তৈরি জামা-কাপড়, পাটের সামগ্রী ইত্যাদি নারীরা তৈরি করে বাজারজাত করতে পারেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলেন জয়নাব (রা.)। তিনি হস্তশিল্পে পারদর্শী ছিলেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার বললেন, তোমাদের মধ্যে যার হাত সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ সবার আগে সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথা শুনে আমরা একে অপরের হাত মেপে দেখলাম। কার হাত সবচেয়ে লম্বা! প্রকৃত অর্থে জয়নাব (রা.)-এর হাত দীর্ঘ ছিল। কারণ হাতের দৈর্ঘ্য বলতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দানশীলতা ও উদারতা বুঝিয়েছেন। জয়নাব (রা.) নিজ হাতে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে সদকা করতেন। ( মুসলিম : ২৪৫২)।
গৃহপালিত পশুর খামার করা : ইসলাম গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত পশু পাখি পালনের অনুমতি দিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ উৎসাহ জুগিয়েছে। একজন নারী খামার তৈরি করার মাধ্যমে আর্থিক স্বাবলম্বী হতে পারেন। গৃহপালিত জন্তুর উপকারিতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য গবাদি পশুতে আছে শিক্ষা। তার উদরে যা আছে তা (অর্থাৎ দুধ) থেকে আমি তোমাদের পান করাই এবং তার মধ্যে তোমাদের জন্য আছে বহু উপকারিতা আর তা থেকে তোমরা খাদ্য গ্রহণ কর। (সুরা মুমিনুন : ২১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষভাবে ছাগল পালনের তাগিদ দিয়েছেন। উম্মে হানী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেছেন, তুমি বকরী পাল। কারণ তাতে বরকত রয়েছে। (ইবনে মাজা : ২৩০৪)। এক বকরির সঙ্গে আরেক বকরি যুক্ত হওয়া প্রাচুর্যের সঙ্গে প্রাচুর্য যুক্ত হওয়ার সমতুল্য। আলী (রা.) হইতে বর্ণিত আছে যে, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ঘরে একটি বকরি একটি বরকত স্বরূপ, দুইটি বকরি দুইটি বরকত স্বরূপ, তিনটি বকরি তিনটি বরকত স্বরূপ। (আল-আদাবুল মুফরাদ : ৫৭৪)। তবে গৃহপালিত পশু পাখি লালন পালনের ক্ষেত্রে দয়া ও সহানুভূতির বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তাদের যথাযথ যত্ন নেয়া, সঠিক খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা একান্ত জরুরি।
কৃষি কাজের উদ্যোগ নেয়া : কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করে একজন নারী উৎপাদনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্তত শহুরে নারীরা সময়ের জনপ্রিয় ব্যবস্থা ছাদ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন। আর গ্রামাঞ্চলের নারীরা বাড়ির সীমানার আশপাশের জমিনে প্রাথমিক কৃষিকাজ চালিয়ে যেতে পারেন। স্বামী এবং নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কৃষিকাজে জড়িত ব্যক্তিদের সহযোগিতাও করা যায়। একাধিক নারী সাহাবীদের জীবন থেকে এটা বোঝা যায় ।
আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন যুবাইর (রা.) আমাকে শাদী করলেন, তখন তার কাছে কোন ধন-সম্পদ ছিল না, এমন কি কোন স্থাবর জমি-জমা, দাস-দাসীও ছিল না; শুধুমাত্র কুয়ো থেকে পানি উত্তোলনকারী একটি উট ও একটি ঘোড়া ছিল। আমি তাঁর উট ও ঘোড়া চড়াতাম, পানি পান করাতাম এবং পানি উত্তোলনকারী মশক ছিঁড়ে গেলে সেলাই করতাম, আটা পিষতাম; কিন্তু ভালো রুটি তৈরি করতে পারতাম না। তাই আনসারী প্রতিবেশী মহিলারা আমার রুটি তৈরিতে সাহায্য করত। আর তারা ছিল খুবই উত্তম নারী। রাসুলুল্লাহ (সা.) যুবাইর (রা.)-কে একখণ্ড জমি দিয়েছিলেন। আমি সেখান থেকে মাথায় করে খেজুরের আটি বহন করে আনতাম। ঐ জমির দূরত্ব ছিল প্রায় দুমাইল... (বোখারি : ৪৮৪৮)।
উল্লেখিত উপায়গুলো সম্পর্কে কোন নারীকে যদি স্বামী বা পরিবার থেকে অনুমতি দেয়া হয়, ধর্মীয় বিধি-বিধান লঙ্ঘিত না হয়, স্বামী-সন্তানের খেদমতের ত্রুটি না হয়, তাহলেই উপরোক্ত উপায় গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হতে পারবেন নারীরা অন্যথায় নয়। এক্ষেত্রে, স্বামী, স্বামীর পরিবার ও নিজের পরিবারের অন্যদের সহায়তা থাকলে নারীরা ঘরে বসে থেকেও বৈধ উপায়ে এবং ধর্ম মেনে স্বাবলম্বী হতে পারবে খুব সহজে। নারী পর্দা লঙ্ঘন হয় এমন আধুনিক পোশাক পরে, প্যান্ট-শার্ট পরে বা নিজের রূপ প্রদর্শন করে চাকরি করা ইসলামে বৈধ নয়। কেননা, এতে নারী পর্দা লঙ্ঘনের কারণে গুনাহগার হয় এবং নারী ঘটিত পাপ বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। এর তুলনায় ক্ষুদে উদ্যোক্তা হওয়া উত্তম। যদি শরিয়তের বিধান মেনে চলা যায়।
লেখক : শিক্ষক ও খতিব