ঢাকা ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

মাহবুবুর রহমান
ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

ইসলামিক শরিয়তের ভাষায় প্রতিবেশী বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি আপনার বাড়ির বা বসতবাড়ির আশপাশে অবস্থান করেন এবং যার সাথে আপনার নিকটবর্তী সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। ইসলামে প্রতিবেশীর সংজ্ঞা বেশ বিস্তৃত। হাদিসে বলা হয়েছে, একজন প্রতিবেশী হতে পারেন যিনি আপনার বাড়ির ৪০ ঘর পর্যন্ত বা প্রায় ৪০ বাড়ি পর্যন্ত প্রসারিত অঞ্চলে বসবাস করেন। ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গভীরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসে প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, যা ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা। নিচে ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকারের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হলো।

১. প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা : কোরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। আর পিতা-মাতার সাথে সৎ ব্যবহার করো, আত্মীয়স্বজন, এতিম ও অভাবগ্রস্তদের সাথে এবং কাছের ও দূরের প্রতিবেশীর সাথে সৎ ব্যবহার করো।, (সুরা নিসা : ৩৬)। এখানে আল্লাহ প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণকে পরিবারের পরেই গুরুত্ব দিয়েছেন, যা স্পষ্টভাবে বোঝায়, প্রতিবেশীর অধিকার অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। কোরআনের এই নির্দেশনা মুসলমানদের প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌজন্যতা, সহানুভূতি, সাহায্য এবং সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।

২. হাদিসে প্রতিবেশীর অধিকার : হাদিসে প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে প্রায়শই আলোচনা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে এত বেশি উপদেশ দিয়েছেন, আমি মনে করেছিলাম প্রতিবেশীকে ওয়ারিস বানানো হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। এই হাদিসে বোঝা যায়, প্রতিবেশীর অধিকারকে ইসলামে কতটা উচ্চ স্থানে রাখা হয়েছে। ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি এমন আচরণ করতে বলা হয়েছে যেন, সে পরিবারের সদস্যের মতো অধিকার ভোগ করতে পারে।

৩. প্রতিবেশীর বিপদে সাহায্য করা : ইসলাম আমাদের নির্দেশনা দেয়, কোনো প্রতিবেশী বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়ানো মুসলমানদের দায়িত্ব। একটি হাদিসে বলা হয়েছে : ‘যে ব্যক্তি তার পেট ভরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে প্রকৃত মোমেন নয়।’ (মুসনাদে আহমদ)। অর্থাৎ একজন প্রকৃত মোমেন তার প্রতিবেশীর ক্ষুধার্ত থাকার ব্যাপারে অসচেতন থাকতে পারে না। প্রয়োজনের সময়ে প্রতিবেশীর সহায়তা করা, তাকে খাবার ও আশ্রয় দেয়া এবং তার প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা ইসলামের এক বিশেষ শিক্ষা।

৪. প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়া : ইসলাম স্পষ্টভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া বা অপমান করার বিষয়টিকে নিষেধ করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তিনি মোমেন হতে পারেন না, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ (বোখারি ও মুসলিম)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, একজন মোমেনের নৈতিক দায়িত্ব হলো তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া এবং তার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কোনো শব্দ, কাজ বা আচরণের মাধ্যমে প্রতিবেশীর প্রতি বিরক্তি বা কষ্ট সৃষ্টি করা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়।

৫. সহানুভূতি ও সহযোগিতা প্রদান : ইসলাম শেখায় যে, প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মোমেন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তার প্রতিবেশীর জন্যও তা পছন্দ করে।’ (মুসলিম)। এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, একজন প্রকৃত মোমেনের উচিত তার প্রতিবেশীর জন্য নিজের মতোই মঙ্গল কামনা করা। অর্থাৎ, এক মুসলিম প্রতিবেশীর সুখ-শান্তি ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে।

৬. উপহার প্রদান ও ভালোবাসা বৃদ্ধি : প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ইসলাম আমাদের উপহার বিনিময় করার কথা বলেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তোমরা পরস্পর উপহার বিনিময় করো, এতে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।’ (মুসনাদে আহমদ)। প্রতিবেশীর প্রতি সৌজন্য প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো তাকে ছোট-খাটো উপহার দেয়া, যা পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করে এবং ভালোবাসা ও আন্তরিকতা বাড়ায়।

৭. প্রতিবেশীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান : ইসলাম প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সহাবস্থান করার ওপর গুরুত্ব দেয়। প্রতিবেশীর সাথে অশান্তি বা বিরোধের সৃষ্টি করা ইসলামে অবাঞ্ছিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘মুসলিম হলো সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি)। এটি একটি সাধারণ নীতিমালা, যা প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করা এবং কোনোরূপ ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা ইসলামের একটি প্রধান নির্দেশনা।

৮. প্রতিবেশীর অধিকার অমান্য করার শাস্তি : ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার লঙ্ঘন করার জন্য কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তি এমন অবস্থায় আসবে যে, তার নেক আমলের পরিমাণ পাহাড়ের মতো হবে। তবে তার প্রতিবেশীরা এসে বলবে, হে আল্লাহ! এই ব্যক্তি আমাদের কষ্ট দিয়েছে, আমাদের প্রতি অন্যায় করেছে। ফলে তার নেক আমল তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহমদ)। এই হাদিসে বোঝানো হয়েছে, যদি কেউ তার প্রতিবেশীর অধিকার নষ্ট করে বা তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, তবে সে দুনিয়াতে নেক কাজ করলেও কেয়ামতের দিনে সেই কাজের সওয়াব প্রতিবেশীদের দেওয়া হবে। ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকারের বিষয়ে আরও গভীর দৃষ্টিতে আলোচনা করলে বোঝা যায়, এটি শুধু সামাজিক আচরণের একটি অনুষঙ্গ নয় বরং মুসলমানের ব্যক্তিগত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

৯. প্রতিবেশীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা : ইসলামে প্রতিবেশীর ব্যক্তিগত জীবনকে সম্মান ও গোপনীয়তা রক্ষা করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিবেশীর গোপনীয়তা সম্পর্কে আগ্রহ দেখানো, তার কথা শোনা বা তার প্রতি সন্দেহ করা ইসলামের আদর্শের পরিপন্থি। ইসলামে ব্যক্তির গোপনীয়তাকে রক্ষা করতে বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যেন কোনোভাবেই তার সম্মানহানি না হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের গোপনীয়তা রক্ষা করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।’ (মুসলিম)। এখানে ‘মুসলমান ভাই’ বলতে সকল মুসলমান উদ্দেশ্য। মুসলমান প্রতিবেশীও এর অন্তর্ভুক্ত।

১০. প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়ানো : ইসলামে প্রতিবেশীর জান-মাল ও সম্মান রক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একজন মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব হলো বিপদে প্রতিবেশীর পাশে থাকা। তাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করা। একটি হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন: ‘তোমরা একে অপরের শত্রু নয়, বরং ভাই ভাই হয়ে থাকো।’ (মুসলিম)।

১১. প্রতিবেশীর সাথে হিংসা ও ঈর্ষা না করা : প্রতিবেশীর প্রতি ঈর্ষা বা হিংসা পোষণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। বরং প্রতিবেশীর ভালোতে আনন্দিত হওয়া এবং তার সাফল্যের জন্য দোয়া করা ইসলামের শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘তোমরা একে অপরের সাথে হিংসা করো না, একে অপরকে হেয় করো না, বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো।’ (মুসলিম)। এই হাদিসে প্রতিবেশীর সফলতা বা প্রাচুরে‌্যর প্রতি হিংসা না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ইসলামে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমরা যেন পরস্পরের কল্যাণ কামনা করি এবং ঈর্ষা থেকে বিরত থাকি।

১২. প্রতিবেশীর সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা : যেকোনো কারণে যদি প্রতিবেশীর সাথে বিরোধ বা ঝগড়া লেগে যায়, তাহলে তা দ্রুত মিটিয়ে ফেলা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘তিন দিনের বেশি কোনো মুসলমান যেন অন্য মুসলমানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করে।’ (বোখারি ও মুসলিম)। প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা এবং প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক সুন্দর ও মজবুত করা, যা একটি সুন্দর ও সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রভাষক : রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত