মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২১৫)
আল্লাহর দান পেতে যোগ্যতা শর্ত নয়
ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইয়ামেনে ‘যারওয়ান’ নামক একটি গ্রামের খ্যাতি ছিল সুন্দর চরিত্র, ভদ্রতা ও দান-দক্ষিণার জন্য। সেই গ্রামে বাস করতেন আল্লাহর এক দানশীল নেক বান্দা। গম কাটার সময় তিনি সানন্দে গরিবদের মাঝে ১০ ভাগের একভাগ ওশর বণ্টন করে দিতেন। আবার যখন গম ভাঙিয়ে আটা তৈরি করতেন, পুনরায় দশভাগের একভাগ বিলিয়ে দিতেন। গমের মতো যে কোনো ফসলের বেলায় এই ছিল তার দানের নিয়ম। এই নিয়ম পালনে সন্তানদেরও তাগিদ দেতেন তিনি। বলতেন, তোমাদের আল্লাহর নামে সাবধান করছি, আমার মৃত্যুর পরেও এই নিয়মে সম্পদ বিলাবে, যাতে আল্লাহর হেফাজতে তোমাদের ধন-সম্পদ নিরাপদে থাকে।
সন্তানদের তিনি বারবার বুঝিয়ে বলেন, দেখ এই যে ফসল, ফলমূল, অর্থ-সম্পদ, এগুলো গায়েবি জগৎ থেকে প্রেরিত। আল্লাহতায়ালাই এগুলো পাঠিয়েছেন বান্দাদের ভোগ ব্যবহারের জন্য। কাজেই এই সম্পদ ভোগ করার সময় যিনি পাঠিয়েছেন তার জন্য এবং যেখান থেকে পাঠানো হয়েছে সেখানকার জন্য কিছু রেখে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এটিই কৃতজ্ঞতার চিহ্ন। ধন-সম্পদ যথাস্থানে ব্যয় করলে তোমাদের জন্য মুনাফা বয়ে আনবে আর বিপথে অপব্যয় করলে লোকসান দিতে হবে, দেউলিয়া হয়ে যাবে।
মওলানা রুমি আরো বলেন, তুর্কিদের অভ্যাস ছিল ফসল তোলার পর অনেক ফসল সেই জমিতে বপন করত। বুদ্ধিমানরা এমন কাজটিই করে। কারণ, শষ্যদানা জমিনে বপন করলে নষ্ট হয় না, গচ্ছিত আমানতরূপে আরো বর্ধিত হয়। সাধারণ মুচির উদাহরণ দেখ। রোজ যা আয় করে, জরুরি খরচ বাদে চামড়া ক্রয় করে রাখে। কারণ তা দিয়ে তার ব্যবসায় রওনক হবে। মুচির জীবনদর্শন, এই চামড়াই আমার মূলধন, আমার জীবন জীবিকার যোগানদাতা ও উৎস। কাজেই উৎসের গোড়ায় পানি ঢেলে তরতাজা রাখতে হবে। যেখান থেকে আয় হয়েছে সেখানেও ব্যয় করতে হবে। যার কাছ থেকে পাওয়া গেছে তাকে কিছু দিতে হবে। মুচির আয়ের উৎস চামড়া, কৃষকের কাছে জমি। কিন্তু এগুলো আয়-উপার্জনের মূল উৎস নয়। কাজেই তুমি ফসল বুনতে চাইলে আসল জমিতে বপন কর। তাহলেই শত হাজার গুণে ফেরত পাবে।
একটা হিসাব কর, যে জমিকে তুমি ফসলের উৎস মনে করছ, ধরে নাও সেখানে ফসল বুনেছ। যদি দু এক বছর সেখানে ফলন ভালো না হয় তখন কী কর? নিশ্চয়ই আপদ কেটে যাওয়ার জন্য করজোড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ কর। তার মানে তুমি স্বীকার কর যে, রিজিক দেয়ার আসল মালিক জমি নয়, ক্ষেত-খামারও নয়; বরং মহান রিজিকদাতা আল্লাহতায়ালা। কাজেই তার পথে ব্যয় কর। আর যদি রিজিক চাইতে হয়, তার কাছ থেকে চাও। সম্পদ ও সৌভাগ্যের লাভ করতে চাইলে তার কাছেই ধরনা দাও।
রিযক আয ওয়েই জো মাজু আয যায়দো আমার
মাস্তী আয ওয়েই জু মাজু আয বাঙ্গো খামার
রিযিক মাগো তার কাছে, যায়দ, আমরের কাছে নয়
মত্ততা তার কাছে চাও ভাং ও মাদকের কাছে নয়।
ধন-সম্পদ চাও তো তার কাছে চাও। দুনিয়ার মাল-দৌলতকে আসল ধন-সম্পদ মনে করো না। কেননা, শেষ পর্যন্ত এগুলো কিছুই থাকবে না। থাকবেন তিনি। কাজেই দমে দমে তাকেই ডাকো। তার দিকেই এগিয়ে যাও। তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সাধনা কর। এমন একদিন আসবে যেদিন মানুষ ভাই-আপনজনের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে। সন্তান তার পিতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই দুনিয়া বিচিত্র চিত্রশালা। তুমি এখানকার চিত্রকর্মের সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ আত্মহারা হয়ে আছ, তোমার দৃষ্টি চিত্রকর্মের উপর নিবদ্ধ। তাই চিত্রকর্মকে অতিক্রম করে চিত্রকর ও শিল্পির পরিচয় পাচ্ছ না। তার পরিচয় লাভ করার, তার কাছে যাওয়ার পথ হলো সবকিছুর আকর্ষণ ছেড়ে তার দিকে ধাবিত হওয়া। কাজেই দুনিয়াদার বন্ধুরা যদি তোমার সাথে শত্রুতা করে, আল্লাহর শোকর আদায় করো। কারণ, যারা অন্যায়ভাবে তোমার সাথে শত্রুতা করছে, তারা তোমাকে আরো বিপদে ফেলতে পারত, তোমার দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ করে দেয়ার মত অবস্থা সৃষ্টি হত।
আল্লাহ রহম করেছেন বলে তাদের মনের কদর্যতা আগেই প্রকাশ পেয়েছে। তাতে আল্লাহকে আপন ভাবার পথ খুঁজে পেয়েছ। তুমি মনে মনে ভাব যে, এদের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে এমন মালামাল ক্রয় করেছিলাম, যার দোষত্রুটি গোপন ছিল। এভাবে চলতে থাকলে আমি তাদের পাল্লায় পড়ে দেউলিয়া হয়ে যেতাম। আল্লাহর শোকর যে, ধনসম্পদ দিয়ে যে মুদ্রা ক্রয় করেছিলাম তা ভেজাল ছিল। এই ভেজাল টাকা কোথাও চলত না। সারা জীবন হাহুতাশ করে কাটাতে হত।
য়া’রে তো চোন দুশমনি পয়দা’ কুনাদ
গাররে হেকদো রাশকে উ বীরূন যানাদ
বন্ধু যখন তোমার শত্রু হয় টক্কর লেগে
হিংসা বিদ্বেষ উদ্গারিত বেরিয়ে পড়ে।
বন্ধু খাঁটি না ভেজাল কীভাবে চিনবে। কোনো কারণে যদি বন্ধুর সাথে স্বার্থের টক্কর লাগে, তখন যার মনের পুঞ্জীভূত ক্ষেদ, হিংসা ও শত্রুতার উদগীরণ হবে, বুঝে নেবে যে, সে তোমার দুশমন। আগেভাগে তার সাথে তোমার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় তোমার লাভ হয়েছে। তুমি এখন আসল বন্ধুর সাথে সম্পর্ক মজবুত করার ফুরসত পেয়েছ। সেই বন্ধু কে?
অ’ন মগর সুলতান বুয়াদ শাহে রফী‘
য়া’ বুয়াদ মকবূলে সুলতা’ন ও শফী‘
তিনি তো হলেন সুলতান মহামহিম বাদশাহ
অথবা বাদশাহর কাছে মকবুল তার প্রিয় বান্দা।
তোমার বিশ্বস্ত বন্ধু যিনি তোমার সহায় হতে পারেন তিনি হলেন মহান রাজাধিরাজ আল্লাহ। অথবা রাজাধিরাজের প্রিয়ভাজন আল্লাহর মকবুল নেক বান্দা, যিনি তোমাকে তার পথ দেখায়, সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পথে উৎসাহ যোগায়, পরিচালিত করে। তারা হলেন আম্বিয়া-আউলিয়া, সিদ্দিকিন, শহিদগণ, সালেহিন-নেক বান্দাগণ। (দ্র. সুরা নিসা : ৬৯)। অতএব, খারাপ লোকেরা যদি এই জগতে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে, তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাহলে মনে কর যে, বিরাট ধনভাণ্ডার তোমার হস্তগত হয়েছে। কেননা, তোমার জীবনটাই তাদের উপদ্রব থেকে নিরাপদ হয়ে গেল।
ইন জাফা’য়ে খালক বা’ তো দার জাহা’ন
গর বেদা’নী গাঞ্জে যার আ’মদ নেহা’ন
দুনিয়াদারদের বিশ্বাসভঙ্গ তোমার সাথে এই জগতে
যদি বুঝ মর্যাদা, স্বর্ণখনির গুপ্তধন পেয়ে গেছ তাতে।
কেন এবং কীভাবে গুপ্তধন তার ব্যাখ্যা দিয়ে মওলানা রুমি (রহ.) বলছেন, দুনিয়াপূজারি মন্দ স্বভাবের লোকেরা তোমার সাথে এমন আচরণ করে, যার ফলে তুমি আল্লাহমুখি হতে বাধ্য হও। এটিই তো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। কাজেই মন খারাপ করো না। এখন যারা তোমার সাথে খারাপ আচরণ করছে, শেষেও তারা তোমার শত্রু হয়ে দেখা দিত। তোমার অনিষ্টকামীকে আগেভাগে চিনতে পারা নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। তাহলে কি একা এবং নিঃসঙ্গ জীবই উত্তম? হ্যাঁ, অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে সৎসঙ্গই তোমার প্রয়োজন। খারাপ বন্ধুদের ছেড়ে নিঃসঙ্গ হলে চিন্তা কীসের। কবরেও তো নিঃসঙ্গ থাকতে হবে। সেখানে তো তিনিই তোমার সঙ্গী হবেন। কাজেই তোমার সম্পদ যদি কোনো সঙ্গীর জন্য ব্যয় করতে হয় তার জন্যই করো। তার কাছে জমা রাখ। এখানে জমা করলে ইঁদুরে কাটবে। নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আসমানের গুদামে যদি রাখ, সেখানে চোর ডাকাতের ভয় নাই, ঝড়-তুফানে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই।
মওলানা যারওয়ানবাসী নেক দানশীল বান্দার যবানীতে মূল্যবান নসিহত ও অনেক তত্ত্বকথা ব্যক্ত করার পর আবার কাহিনির ধারাভাষ্যে ফিরে আসছেন। বৃদ্ধ তার সন্তানদের উপদেশ দিলেন। কিন্তু যত প্রাণকাড়া উপদেশ দেয়া হোক, যাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে সে যদি কর্ণপাত না করে তাতে লাভ নেই। নবী-রাসূলগণের চেয়ে দরদি উপদেশদাতা আর কে হতে পারেন। অথচ গাফেল আত্মভোলা লোকেরা তাদের উপদেশে কর্ণপাত করেনি। এদের অন্তর পাথরের চেয়েও কঠিন বলে উল্লেখ রয়েছে পাক কোরআনে।
প্রশ্ন আসে, তাহলে কি এসব লোকদের হেদায়াত লাভের যোগ্যতা নেই? দার্শনিকদের যুক্তি হলো, কোনো কিছু লাভ করতে হলে তার যোগ্যতা থাকতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়মেই সবকিছু হয়। গোটা বিশ্বব্যবস্থা কার্যকারণ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত শাশ্বত নিয়মের নিগড়ে বন্দি। নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু হতে পারে না। যে কোনো কিছুর পেছনে কারণ আছে, থাকতে হবে। কারণ ছাড়া কিছুই হয় না। মওলানা তাদের যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, আল্লাহতায়ালা বিশ্বব্যবস্থায় কার্যকারণ নীতি বলবৎ করেছেন সত্য; কিন্তু তিনি কার্যকারণ তত্ত্ব ও প্রাকৃতিক নিয়মের উর্ধ্বে; তিনি মুসাব্বেবুল আসবাব, সব কারণের আদি কারণ। তার ইচ্ছার কাছে কার্যকারণ তত্ত্ব অচল। তিনি ইচ্ছা করলে কারণ ছাড়াই যে কোনো কিছু ঘটাতে পারেন। যোগ্যতা ছাড়াই দিতে পারেন। মসনবির দুটি পংক্তির দুই লাইনের মিশ্রণ এ রকম। যার আবেদন চিরন্তন।
দা’দে হক রা’ কা’বেলিয়্যত শর্ত নীস্ত
বল্কে শর্তে কা’বেলিয়াত দা’দে উস্ত
আল্লাহর দান পেতে যোগ্যতা নয় শর্ত
বরং তাঁর দানই যোগ্যতা লাভের শর্ত।
এই যুক্তি ও দর্শনের পক্ষে হাজারো প্রমাণ আছে ইতিহাসে। মুসা (আ.)-এর হাতের লাঠি আজদাহায় রূপান্তর এবং তার হাত সূর্যের মতো দেদিপ্যমান হওয়ার পেছনে কার্যকারণ বিধি নয়; বরং আল্লাহর দানের ভূমিকাই মূখ্য। নবী-রাসুল (আ.)-গণের অগণিত অলোকিক ঘটনাও কার্যকারণ বিধি বা ‘উপযুুক্ততার শর্তে দান তত্ত্বের’ বিপরীত ছিল। উপযুক্ততাই যদি দান পাওয়ার শর্ত হত, তাহলে আমরা কেউ তো এই জগতের মুখ দেখতাম না। অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্ব লাভের পেছনে আমাদের কার কী যোগ্যতাণ্ডউপযুক্ততা ছিল?
বিশ্বব্যবস্থার জন্য আল্লাহতায়ালা শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়ম বলবৎ করেছেন। মানুষ সেই নিয়ম ও কার্যকারণের পথ ধরে চেষ্টা করে এবং জগৎ-সংসার চলমান আছে। এসব নিয়ম ও কার্যকারণ আসল কারণের উপর আচ্ছাদন ও পর্দা স্বরূপ। আল্লাহর তাজাল্লীসমূহ ধারণ করার ক্ষমতা সব চোখের নেই। তারা পর্দার আড়াল হতেই আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য অবলোকন করতে পারে। নিয়ম ও কারণ এর নিয়ন্তা হলেন একমাত্র আল্লাহ। সবকিছুতে আল্লাহর ইচ্ছাই ক্রিয়াশীল। কাজেই মানুষের উচিত পর্দায় আড়ালে না থেকে অন্দরে প্রবেশ করা এবং আল্লাহর মহিমা দর্শনের জন্য দৃষ্টিশক্তিকে শাণিত করা। যদি কিছু চাওয়ার থাকে তার কাছ থেকে নেয়া। যোগ্যতার যদি দরকার হয় তার কাছে চাওয়া।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-১৪৭৩-১৫৫৫)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)