ইসলামে শিশুহত্যা নিষিদ্ধ

মুফতি ইবরাহীম আল খলীল

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সংবাদের কাগজে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুহত্যার ঘটনা আজকাল প্রায় নিত্যদিনের সংবাদে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি কেন্দ্রিক জেদ, পারিবারিক কোন্দল ইত্যাদির কারণে বলির শিকার হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু। এটা আমাদের সামাজিক, মানবিক ও নৈতিক অবক্ষয়। কী কারণে আমরা তাদের হত্যা করছি? নিষ্পাপ ফুলের মতো শিশুদের জীবন আমরা কেন কেড়ে নিচ্ছি? তাদের তো কোনো দোষ নেই! আমাদের ভেতর কি দয়া মায়া বলতে কিছু নেই! ইসলাম যেখানে একটি সামন্যতম ছোট প্রাণীকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া হারাম করেছে, সেখানে একজন মানুষ হত্যা আর তা যদি হয় নিষ্পাপ শিশুহত্যা! বিষয়টা ভীষণ উদ্বেগের। সামাজিক অবক্ষয়ের। এসব ঘটনা জাহেলি যুগের নিষ্ঠুরতা আর জঘণ্যতাকেও হার মানাচ্ছে।

শিশুর প্রতি দয়া করি : শিশু শব্দটি জুড়ে রয়েছে কোমলতা। কেমন যেন একটা মায়া মায়া ভাব। শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সদা সুন্দর নিষ্পাপ মায়াবী চেহারা। শিশুর প্রতি মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা আল্লাহতায়ালার বিশেষ নেয়ামত। মহানবী (সা.) শিশুদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। যেকোনো শিশুকে তিনি নিজের সন্তানের মতো আদর-সোহাগ করতেন। শিশুদের কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করে তাদের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দানের কথা উল্লেখ করে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা শিশুসন্তানদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।’ (তিরমিজি)।

শিশুরা আল্লাহর দেয়া খুশবু। ওরা ফুলের মতো। ফুলের মতো নির্মল। নির্মোহ ও নিরপরাধ। শিশুরা বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের আনন্দের খোরাক। ফুল ও শিশুকে যারা ভালোবাসে না- তারা অমানুষ অথবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নিজের শিশু সন্তান তো বটেই, অন্যের এমনকি প্রাণঘাতী শত্রুর শিশু হলেও তার প্রতি কেউ প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে না, যদি সামান্যতম মানবতাবোধ থাকে।

শিশুকে স্নেহ করা নবীর সুন্নত : শিশুরা আল্লাহর সাজানো বাগানের ফুল। ফুল দেখলেই যেমন মানুষ তার ঘ্রাণে মোহিত হতে চায়, তেমনি মানববাগানের ফুল দেখেও মানুষ আনন্দিত হয়। চক্ষু শীতল করে। শিশুরা মমতার আধার। শিশুদের আদর-স্নেহ করা নবীর সুন্নত। নবীজি (সা.) তার দৌহিত্রকে ভরা মজলিসে স্নেহের চুম্বন দিয়ে আমাদের তা শিখিয়েছেন। একদা নবীজি (সা.) এর নাতি হাসানকে চুমু খাচ্ছিলেন, তা দেখে আকবা বিন হারেস নামে এক সাহাবি নবীজি (সা.) কে বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি শিশুদের দেখে এত আনন্দিত হন এবং আদর স্নেহ করেন, তারাও আপনার আদরে আপ্লুত হয় আমার তো অনেক সন্তান; কিন্তু তাদের আপনার মতো স্নেহ করতে পারি না, নবীজি বলেন, তোমার হৃদয়ে স্নেহ মমতা না থাকলে আমার কী করার আছে? হাদিসে বর্ণিত আছে, একদিন নবীজি (সা.) একদল শিশুর সঙ্গে আনন্দ করছেন। শিশুরাও নবীজি (সা.) কে ঘিরে আনন্দ খুশিতে মেতে ওঠে। এমন সময় সেখানে এক বেদুঈন এসে উপস্থিত হয়। সে নবীজি (সা.) কে বলে, শিশুদের নিয়ে এমন আমোদ আহ্লাদ করা আমার পছন্দ নয়। এ কথা শুনে নবীজি (সা.) এর হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে যায়। তিনি বললেন, যে ব্যক্তির হৃদয়ে মায়া দয়া নেই, আল্লাহ যেন তাকে দয়া না করেন।

শিশুহত্যা নিষিদ্ধ : সম্প্রতি সিলেটে মুনতাহা নামক এক নিষ্পাপ শিশুহত্যার যে লোমহর্ষক ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে; তা শুধু ভয়াবহই নয়, অমানবিক ও। শিশুহত্যা করা জাহেলি যুগের ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ। ইসলাম শিশুকে বাঁচার অধিকার দিয়েছে। শিশুহত্যা করা জঘন্য পাপ। কোরআন ও হাদিস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত, ইসলাম সব সময় শিশুর অধিকার প্রাপ্তির সপক্ষে কঠোর অবস্থানে ছিল। ইসলাম শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করেছে। জ্যান্ত কবরস্থ বা হত্যার শিকার না হয়ে সামাজিকভাবে বেঁচে থাকা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার। শিশুর জীবন রক্ষা করার জন্য মহানবী (সা.) সর্বাগ্রে দয়ামায়াহীন আরব পৌত্তলিকদের জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। শিশুদের যথার্থ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে তিনি শিশুহত্যায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের গোপন পন্থায় ধ্বংস করবে না।’ (আবু দাউদ)। যে জাতি আপন সন্তানকে জীবিতাবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করত, ইসলামের নবীর সংস্পর্শে ও হুঁশিয়ার বাণীতে তা পরিত্যাগ করে তারাও সভ্য সমাজ হয়ে ওঠে। এভাবে তিনি কোমলমতি শিশুদের পৃথিবীতে নিরাপদে বেঁচে থাকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি : ২০৪৪)।

লেখক : শিক্ষক, মাদ্রাসা, আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও ঢাকা।