মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২৩০)

দিলকে পরিচ্ছন্ন কর আয়নার মতো

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পীর সাররাযির পেশা এখন কাঙালি। এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি, এ দুয়ার থেকে ওদুয়ারে ভিক্ষা চেয়ে বেড়ান। একদিন এক আমিরের প্রাসাদে গেলেন কাঁধে ঝুলি, গায়ে আলখেল্লা, মুখে শাইয়ান লিল্লাহ (আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দেন) যিকির। কামিল লোকদের এমন আচরণের রহস্য বোঝা বড় কঠিন। বড় বড় জ্ঞানীরাও এর হেতু অনুন্ধানে দিশাহারা হয়ে যান। বিরক্ত হয়ে আমির বললেন, শেখ! লজ্জা শরম বলতে মানুষের কিছু থাকা চাই। এক বাড়িতে দিনে কয়বার ধর্ণা দিতে আসেন। সকাল থেকে চারবার এভাবে বিরক্ত করার কোনো মানে আছে? কীসের ভান ধরেছেন। মনে করেছেন এখানে বুঝি এসব বুজরুকিতে ধোঁকা খাওয়ার কেউ আছে। এমন লোক দেখলে তো পাড়ার ভিক্ষুকরাও লজ্জা পাবে। বিনা পুঁজিতে কোন ধরনের ব্যবসা পেতেছেন। নফসের গোলামিতে জীবনটা বরবাদ করে দিচ্ছেন। সাররাযি এতক্ষণে মুখ খুললেন, আমির! ক্ষান্ত হোন, আমি কিন্তু এমনিতে কাঙ্গাল সাজিনি। আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর দ্বীনের জন্য এ পথে নেমেছি। (নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা তাদের সম্পদে জাকাত ফরজ করে দিয়েছেন। এই জাকাত তাদের ধনীদের থেকে আদায় করা হবে আর তাদের গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হবে। (বোখারি)।

সাররাযি আরো বললেন, আমার নিজের রুটি-রুজির জন্য যদি পথে নামতাম তা হলে আমার এই পেট নিজেই ফেটে ফেলতাম। সাতটি বছর প্রেমের অনলে নিজেকে দগ্ধ করেছি। দেহকে সিদ্ধ করে মরু বিয়াবানে গাছের পাতা খেয়ে দিন গুজরান করেছি। সেই লোক আপনার কাছে ভিক্ষার জন্য ধর্ণা দেবে কীভাবে ভাবতে পারেন। আপনি তো প্রেমশূন্য মনুষ্যের চামড়ায় আচ্ছাদিত। বাইরের আবরণের ভেতরে আপনার দৃষ্টিশক্তি অগম্য। কাজেই প্রেমের আগুনে পোড়া লোকদের আপনার জ্ঞানের মাপকাটিতে ওজন দেয়ার চেষ্টা করবেন না।

দুনিয়ার ইলম, জাদুবিদ্যা, দর্শন, অর্থ উপার্জনের নানা কূটকৌশল আয়ত্ব করে নিজেকে ভাবছেন অনেক কিছু। যাহেরি ইলমের বন্দিদশায় ঘুরপাক খাচ্ছেন, তাই আল্লাহকে চেনার ইলম থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। আপনি তো এখনো নিজের পরিচয় পাননি; আপনি কীভাবে মহামহিমের জ্যোতিষ্ক দেখতে পাবেন! আমার একটি উপদেশ শুনুন। তাহলো আশেকদের আপনি প্রেমের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার, মূল্যায়ন করার চেষ্টা করুন। বুঝার চেষ্টা করুন, এই লোকেরা কেন আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দ্বীনের জন্য, অসহায় মানুষের জন্য পাগল পারা, কেন নিজের স্বার্থ অর্থবিত্তের কথা চিন্তা না করে দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।

এসব কথার ব্যাখ্যা প্রেমিকরা আপনাকে দেবেন না, ব্যাখ্যা দেয়ার সময় তাদের হাতে নেই। তারা সর্বক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে রত।

ফাহম কুন মওকুফে আন গোফতান মবাশ

সীনেহায়ে আশেকান রা কম খারা’শ

বুঝবার চেষ্টা কর, মুখের কথায় তুষ্ট থেকো না

প্রেমিকদের বক্ষকে বিক্ষত করার চেষ্টা করো না।

একথা বলেই সারারাযি কান্নাজুড়ে দিলেন। অঝোর ধারায় শুরু হলো দুচোখে অশ্রুবন্যা। অবস্থা দেখে আমিরের অবস্থাও বেসামাল। পীরের সততা, মনের স্বচ্ছতা আমিরের অন্তরের উপর প্রভাব বিস্তার করল। কারণ প্রেম ও সততা আগুনের মতো। সততা যেখানে জড় জগৎকে প্রভাবিত করে সেখানে জ্ঞানী লোকদের তো স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব বিস্তার করবে। ইতিহাস থেকে তার প্রমাণ,

সিদক মূসা বর আসা ও কূহ যদ

বলকে বর দরয়ায়ে পুর এশকূহ যদ

মুসার সততা শুধু লাঠি ও পাহাড় প্রভাবিত করেনি

বরং উত্তাল সাগরকেও প্রভাবিত করেছিল ঠিকই।

এই বয়েতে মওলানা রুমি মুসা (আ.)-এর হাতে জড়বস্তু সম্পর্কিত লাঠি প্রাণবন্ত হওয়া, আল্লাহর সাথে কথা বলার সময় কূহে তুর উন্মাতাল হওয়া এবং মিশর থেকে পলায়নের সময় নীলনদের পানি দুভাগ হয়ে মাঝখানে রাস্তা তৈরি হওয়ার অলৌকিক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অনূরূপভাবে হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর বেলায়ও চাঁদ দুটুকরা হওয়া এবং একবারের ঘটনায় হজরত আলী (রা.)-এর যুদ্ধব্যস্ততায় আসরের নামাজ আদায়ের আগেই সূর্য ডুবে যাওয়ার পর নবীজির দোয়ায় সূর্য পেছনে এসে উদিত হওয়ার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে মওলানা বলছেন,

সিদকে আহমদ বর জমালে মাহ যদ

বলকে খোরশীদ রখশানে রাহ যদ

নবীজির সততা চাদের সৌন্দর্য হরণ করেছে

এমনকি উজ্জ্বল সূর্যেরও গতিরোধ করেছে।

বস্তুত পীর সারারাযির কথার প্রভাবে তার মনের সততা ও স্বচ্ছতায় আলোকচ্ছটায় আমিরের ভাবান্তর হলো। অঝোর নয়নে আমির কাঁদতে লাগল। দুজন সামনা সামনি একজনের দিকে আরেকজন তাকিয়ে কেবলই কাঁদে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধুই কান্না। অনেকক্ষণ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর আমির ফকিরকে বলল, উঠেন হে সম্মানিত। এই নেন চাবি। আমার কোষাগার হতে যত ইচ্ছা ধন-রত্ন নিয়ে নেন। আমার বাড়ি আপনার বাড়ি। আমার সম্পদ অর্পণ করলাম আপনার হাতে। ফকির বুযুর্গ বললেন, সে অনুমতি আমার নেই। আমি হুকুমের গোলাম। আপনার সম্পদ আমি নেব না নিজের হাতে। এই কথা বলে, ফকির চলে এলেন আমিরের কাছ থেকে।

পীর সাররাযি ধনীদের কাছ থেকে নেন আর পূর্ণ আমানতদারির সাথে গরিবদের মাঝে বিলান। এই অর্থ হতে নিজের ভোগ বিলাসিতার জন্য গ্রহণ করেন না। এতে মানুষের মাঝে তার অবস্থা দাঁড়ায় লোকেরা তার হাতে টাকা-পয়সা তুলে দিতে পারলেই খুশি হয়। কারণ, তারা জানে, সাররাযিকে দেয়া টাকা-পয়সা যথাযথভাবে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় হবে।

এভাবে আরো দুটি বছর কেটে গেল ফকিরির বেশে পরের দুয়ারে যাচনা করে। এবার আল্লাহর পক্ষ হতে ফকিরের প্রতি আদেশ এলো তুমি কারো কাছে কিছু চাইতে পারবে না; শুধুই দান করবে। মানুষকে দেয়ার জন্য গায়েবি কোষাগার হতে আমি তোমাকে দিতে থাকব। যে কোনো ভিখারী আসুক, অভাব অভিযোগ নিয়ে যেই আসুক, তাকে দাও। তোমার কাছে যখন কিছু না থাকবে তোমার বিছানার নিচে হাত দাও সেখান থেকে নিয়ে অভাবীদের অভাব মোচনের চেষ্টা করবে। দেখবে তোমার হাতে মাটি স্বর্ণে পরিণত হচ্ছে।

বাদ আযীন মী দেহ ওলী আয কাস মাখা’হ

মা বেদাদীমাত যে গাইব ইন দস্তগাহ

এরপরে বিলাতে থাক কিন্তু চেয়ো না কারো কাছে

আমিই তোমাকে দিয়েছি এ ধনভান্ডার অদৃশ্য হতে।

এখন থেকে তোমার সাধনা হবে কারো কাছ থেকে কিছু চাইতে পারবে না। শুধু দান করবে। কম হোক বেশি হোক কোনো সাহায্য প্রার্থীকে ফেরাতে পারবে না। প্রশ্ন করতে পার এত টাকা তুমি কোথায় পাবে? চিন্তা নেই তোমার বিছানার মাদুর উল্টাও, সেখান থেকে অকাতরে দান করবে। আমি তোমার জন্য আমার রহমতের দুয়ার খুলে দেব। তোমার হাতের পরশে তখন মাটি স্বর্ণ হয়ে যাবে। কাউকে দান করতে কুণ্ঠিত হবে না। দিতে থাক। যত দাও আরো দেবো আমার রহমতের ভান্ডার খুলে।

রও য়াদুল্লাহ ফাউকা আইদিহিম তো বা’শ

হামচো দাস্তে হক গেযাফী রিযক পা’শ

যাও আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর হও

আল্লাহর হাতের মতো দান অবারিত বিলাও।

দান দক্ষিণায় আল্লাহর দানশীলতা গুণের প্রকাশকারীতে পরিণত হও। আল্লাহতায়ালা যেমন কোনো স্বার্থচিন্তা বা প্রতিদানের আশা ব্যতিরেকে দান করেন তুমিও অকাতরে বিলাতে থাক।

ওয়ামদারা’ন রা’ যে ওহদে ওয়ারেহা’ন

হামচো বারা’ন সবজ কুন ফরশে জাহা’ন

ঋণগ্রস্তদের তুমি মুক্তি দাও ঋণের বোঝা হতে

বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর বিছানা সাজাও সবুজ ফরাশে।

অবারিত অকাতরে দান ও বদান্যতায় মানুষের মনে খুশির জোয়ার আন। সমাজের সর্বত্র স্বচ্ছতা, সততা, মানব প্রেমের পশরা সাজাও। মানুষে মানুষে প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার সুবাতাস প্রবাহিত হোক। এভাবে পীর সাররাযির জীবনে একটি বছর কেটে গেল। অবস্থা এমন হলো, কোনো সাহায্যপ্রার্থী আসলে মুখে বলতে হত না। সাররাযি আগন্তুকের মনের পুস্তক পাঠ করে নিতেন। তারপর এমনভাবে দান করতেন, যা প্রার্থীর প্রয়োজন মিটিয়ে দিত। শায়খের কারামাত দেখে একদল লোক রহস্য জানতে চাইল, হুযুর! কী ব্যাপার যেই আসুক মুখে বলা ছাড়াই আপনি তার ঠিক প্রয়োজনটি পূরণ করে দেন। তার মনের কথা কীভাবে আপনি জানতে পারেন আমাদের জানার বড় কৌতূহল। সারারাযি জবাব দিলেন, মনের বাড়ি তো শূূন্যঘর। এখানে কোনো কিছুর লোভ বা আশা নেই। বেহেশতের বাসনাও লালন করি না। আল্লাহর ভালোবাসা ছাড়া তার মিলন ও সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছু চাই না। ফলে মনটা স্বচ্ছ আয়নার মতো হয়ে আসে। আয়ানার সামনে যাকিছু আসে হুবহু তাতে প্রতিবিম্¦িত হয়। কাজেই আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুর চিন্তা যদি আমার মনে আসে, সাথে সাথে বুঝে নেই যে, এতো আমার নিজের নয়। অন্য কারো মনের কথা আমার মনে প্রতিফলিত হয়েছে।

হে যুবক! পানির মধ্যে যদি কোনো কিছুর ছবি দেখ বুঝে নাও যে সে ছবি পানির নয়, বাইরের। তবে শর্ত হলো, পাত্রের পানি স্বচ্ছ, নির্মল রাখতে হবে। তাহলেই বাইরের বস্তুর প্রতিফল নির্ভুল হবে। তুমি যদি শুধু খাওয়া ভোগ ও নিদ্রার মধ্যে ডুবে থাক। তোমার মানসপট কীভাবে স্বচ্ছ নির্মল হবে তুমিই বল। তোমার বাড়ি যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকে। যদি ময়লা-আবর্জনার বাগাড় হয়ে থাকে, তাহলে তো তাতে দৈত্যদানব, হিংস্র প্রাণীর আখড়ায় পরিণত হবে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫খ. বয়েত-২৬০০-২৮৮৬)।

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)