রমজানের বাঁকা চাঁদ উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি মোমিনের হৃদয়ে ঈমানের বসন্ত শুরু হয়। রমজান মাস হলো মোমিনের জন্য ইবাদতের বসন্তকাল। কারণ এই মাসে ঈমানদারগণ নিজেদের আত্মাকে শুদ্ধ করার একটি দারুণ সুযোগ পায়। এ সময়ে মুসলিমরা বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জেনের চেষ্টা করে।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। (সুরা বাকারা : ১৮৩)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন রমজানের চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখবে। আর যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ৩০ দিন রোজা রাখবে। (বোখারি : ১৯০৯)। উক্ত আয়াত ও হাদিসদ্বয় এবং এ বিষয়ক অন্যান্য দলিল দ্বারা রমজান মাসের রোজা রাখা ফরজ প্রমাণিত। রমজান মাস আমলের মাস। এ মাসে ব্যাপক আমল করার সুযোগ রয়েছে। এ মাসে আমলের মর্যাদাও অনেক। ফজিলত ও তাৎপর্যও ব্যাপক। নিচে রমজান মাসের বিশেষ কিছু আমল উল্লেখ করা হলো-
রোজা রাখা : রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। এটি এ মাসের জন্য বিশেষ আমল, যা মুসলিমদের আদায় করা জরুরি।
তারাবি নামাজ : রমজানের রাতের বিশেষ আমল হলো বিশ রাকাত তারাবি নামাজ পড়া। এ মাসের অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাত লাভের জন্য এবং সওয়াব ও পুরস্কার পাওয়ার জন্য তারাবি নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম।
দান করা : দান-সদকা একটি উৎকৃষ্ট আমল; কিন্তু রমজানে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলে কারিম (সা.) দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে তার দানের হাত আরো প্রসারিত হতো। (বোখারি : ১৯০২)।
কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত : রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। রাসুলে কারিম (সা.) জিবরাইল (আ.)-এর সাথে রমজানের প্রত্যেক রাতে কোরআন মাজিদ দাওর করতেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত জিবরাইল (আ.) রমজানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে রাসুল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসুল (সা.) তাকে কোরআন মাজিদ শোনাতেন। (বোখারি : ১৯০২)। আমাদের উচিত রমজানে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করা। অন্তত একবার হলেও পূর্ণ কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করে খতম করা।
নফল ইবাদত : রমজান মাসে শয়তান শিকলবন্দি থাকে। এই সুযোগে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জন করা সহজ হয়। এ মাসে যে কোনো ইবাদত নিয়মিত করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না এবং পরবর্তীতে তা সহজেই অভ্যাসে পরিণত হয়। সুতরাং যিকির-আযকারের সঙ্গে অধিক পরিমাণে নফল নামাজ আদায় করা উচিত। অন্তত বিভিন্ন সময়ের নফল নামাজগুলো আদায় করা। যেমন-ইশরাক, চাশত ও তাহাজ্জুদ ইত্যাদি।
দোয়া করা : এ মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের মাস। তাই বেশি বেশি আল্লাহতায়ালার শরণাপন্ন হয়ে কান্না-কাটি করে দোয়া করা উচিত। যাতে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও ক্ষমা লাভ করা সহজ হয়।
ইতিকাফ করা : শেষ দশকের মাসনুন ইতিকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলে কারিম (সা.) রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। (বোখারি : ২০২১) ।
শবেকদর খোঁজ করা : ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে হাজার রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম রাত-লাইলাতুল কদর তালাশ করা কর্তব্য। রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কথা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। শুধু ২৭ রমজানে শবে কদর হওয়া নিশ্চিত নয়। তাই উত্তম হলো শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা। তাহলে শবেকদর পাওয়া অধিকতর সহজ হয়। রমজানের অনেক বরকত ও ফজিলত রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
রোজার প্রতিদান আল্লাহ নিজ হাতে দেবেন : রোজাদারের জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে অনন্য পুরস্কার হলো পুরস্কারটি সরাসরি আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে গ্রহণ করা। এ পুরস্কারটি অন্য সকল ইবাদতের পুরস্কার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকির সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, কিন্তু রোজা আলাদা। কেননা, তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। (মুসলিম : ১১৫১)।
জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢালস্বরূপ : হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, আমাদের মহান রব বলেছেন, রোজা হলো ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দেব। (মুসনাদে আহমদ : ১৪৬৬৯)।
গোনাহ মাফের সুযোগ : এক হাদিসে হজরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন, আর আমি কিয়ামুল লাইল তথা তারাবি’র নামাজকে সুন্নত করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানের সিয়াম ও কিয়াম আদায় করবে, সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন সে মায়ের গর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। (নাসায়ি : ২৫১৮)।
দুটি আনন্দের মুহূর্ত : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে, যখন সে আনন্দিত হবে। এক. যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারের কারণে আনন্দ পায়। দুই. যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হবে, তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হবে, আর তিনি তাকে পুরস্কার দেবেন, তখন সে আনন্দিত হবে। (বোখারি : ১৯০৪, ১৮৯৪)।
দোয়া কবুল হয় : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ইফতারের সময় রোজাদার যখন দোয়া করে, তখন তার দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। (অর্থাৎ, তার দোয়া কবুল করা হয়)। (ইবনে মাজাহ : ১৭৫৩)। রমজান মাসের ফজিলত কোরআন ও হাদিসে অসংখ্যবার উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি অনন্য সময়, যখন মুসলিমগণ আল্লাহর নিকট নিজেদের আত্মাকে শুদ্ধ করার সুযোগ পায় এবং সকল গোনাহ মাফ করার সুযোগ থাকে। রমজান মাস একদিকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যম, অন্যদিকে সমাজে ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং ঐক্যের বার্তা বহন করে।
লেখক : প্রভাষক
সাভার ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা, সাভার, ঢাকা