বিয়ে করার বাসনা লালন করেছিলাম। বিয়ে হলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম। এটা তো পূর্ণতা নয়। সাংসারিক পূর্ণতা আসে সন্তানে। সন্তান এলো। পিতা হলাম। আবার বুঝলাম। এই ছোট গৃহে সংকুলান হচ্ছে না। কাজ বাড়িয়ে দিলাম। পরিশ্রমের কমতি নেই। সফল হলাম। ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বড় বাড়িতে ওঠলাম। ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের কোলাহল। চারপাশ মুখরিত।
সময় যায়। দ্রুত যায়। বছরগুলো যেন ঝরাপাতার মতো পড়তে থাকে। সময় যত গেল, সন্তানরাও বড় হলো। একসময় নিজের বিয়ের বাসনা ছিল। এখন সন্তানদের বিয়ের বাস্তবতা তাড়া দিল। দায়িত্বের পর দায়িত্ব। দায়িত্ব নামক জলের ঘটি পুকুর হয়। পুকুর দিঘি হয়। দিঘি সমুদ্র হয়। এই উন্মাতাল জীবন সমুদ্রে অবসরের সময় কই। এত পরিশ্রমে শারীরিক শ্রান্তিতে অবসাদ আসতে লাগল ঝোড়োগতিতে। একটু যদি জিরোতে পারতাম। একটু যদি দাঁড়াতে পারতাম। বৃক্ষ যেমন দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনি। এই বাসনাও পূর্ণ হলো। চাকরি থেকে অবসর পেলাম। এবার একেবারে অখণ্ড অবসর।
এখন, দেখি এই অবসরে একেবারে একা। চারপাশে কেউ নেই। কেউ পাতা হয়ে ঝরে গেছে। কেউ মেঘ হয়ে উড়ে গেছে। কেউ একেবারে তারা হওয়ার আগেই তারা হয়ে গেছে।
এই অবসরে দু-এক লাইন কোরআন শরিফের আয়াত মুখস্থ করার চেষ্টা করি। পারি না। স্মরণশক্তি প্রতারণা করে। আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস করারও চেষ্টা করি। পারি না। শারীরিক দুর্বলতাই জয়লাভ করে। ভোরে ওঠে জায়নামাজে দাঁড়াতে গেলে কষ্ট হয়। শরীরটা ফেটিগড হয়ে গেছে। বুঝি, আমি মোহের মায়ায়, সময়ের খেয়ায় দৌড়ে দৌড়ে জীবনটা খুইয়েছি। অথচ, আসল জিনিসটাই বুঝি নেই। যা বুঝার জন্য বারবার নবী (সা.) তাগাদা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-ব্যস্ততার আগে অবসরের, বার্ধক্যের আগে তারুণ্যের, অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতার, খরচের আগে মিতব্যয়িতার আর মৃত্যুর আগে জীবনের গুরুত্ব দিতে।
কিছুদিন আগে একটা ছবি দেখলাম। লায়ন অব ডেজার্ট। ওমর মুখতারের জীবন কাহিনি। ২০ বছর ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির বিরুদ্ধে লিবিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে গিয়ে যার ফাঁসি হয়। ওমর মুখতার ছাত্রদের তালিম দিয়ে বলছেন, পবিত্র কোরআনে কেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পাল্লার কথা বলেছেন? ছাত্ররা বলে-কেন? ওমর মুখতার বলেন-পাল্লা হলো ব্যালেন্স। আর ব্যালেন্স না থাকলে সব কিছু পড়ে যায়। সবকিছুই একটা ব্যালেন্সের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে। কি একটা গভীর তাৎপর্যময় কথা।
জীবন চালাতে গেলে সংসার থাকবে, জীবিকা থাকবে। সব ছেড়ে দিয়ে একেবারে সন্যাস হলে চলবে না। ব্যালেন্সটা ঠিক করতে হবে। আর এই ব্যালেন্স ঠিক রাখতে গিয়ে দুনিয়ার পাল্লা একটু গড়বড়ে হয়ে গেলেও খেয়াল রাখতে হবে-আখেরাতের পাল্লাটা যেন সবসময় ঠিক থাকে। কারণ এটাই স্থায়ী এবং আসল। আর দুনিয়াটা-এক শূন্যে ভাসা বাবল। বাবলের চাকচিক্য এই আছে এই নাই। জীবনটাও এমন। নিঃশ্বাস এই আছে-এই নাই।