ঢাকা ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৩৫২)

ফেরাউনের জাদুকরদের শাহাদতের তামান্না

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ফেরাউনের জাদুকরদের শাহাদতের তামান্না

মিশরের জাতীয় দিবসের মহাউৎসব। আল্লাহর নবী মুসা (আ.) এর মোকাবিলায় ফেরাউনের জাদুর মহারণ। সারাদেশ থেকে জড়ো করা জাদুকরদের হাতে লাঠি আর রশি। ওদিকে মুসার হাতে একখানা লাঠি। জাদুকরদের সংখ্যাও অগণন। কেউ বলেছেন বাহাত্তরজন। কারও মতে আরও বেশি। সাত হাজার বলেও একটি বর্ণনা আছে। প্রথমে জাদুকররা জানতে চাইল, হে মুসা! জাদু কি তুমি আগে নিক্ষেপ করবে, না আমরাই নিক্ষেপ করব? মুসা (আ.) বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা নিক্ষেপ করল, তখন তারা লোকদের চোখে জাদু করল, তাদের আতঙ্কিত করল এবং তারা এক বড় রকমের জাদু দেখাল। (সুরা আ‘রাফ : ১১৫-১১৬)।

জাদুকররা রশি ছেড়ে দিল মাঠে। সঙ্গে তাদের হাতের লাঠিও। লাঠি আর রশি সাপ হয়ে লাফালাফি শুরু করল ময়দানজুড়ে। মুসার দিকে বারবার ধেয়ে আসে, ভেল্কি দেখায়। ফেরাউন আর তার লোকজনের মনে খুশির বাঁধভাঙা জোয়ার। মুসার পরাজয় সুনিশ্চিত। আসমানি আদেশের অপেক্ষায় থাকেন আল্লাহর নবী। অহি আসল, আমি মুসার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। সহসা তা তাদের অলীক মিথ্যা সৃষ্টিগুলোকে গিলতে লাগল। (সুরা আ‘রাফ : ১১৭)।

জাদুর চালে তারা সাপ নাচিয়ে বাজিমাত করতে চাইল। মুসার লাঠি মাটিতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে তা অজগর হয়ে প্রকাণ্ড হা করে ওসব গিলতে লাগল। অগণিত মানুষ হতবাক, ভীত বিহ্বল, এদিক সেদিক দৌড়ঝাঁপ। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, তারা যা করছিল তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হল। (সুরা আ‘রাফ : ১১৮)।

প্রমাণিত হলো, মুসা যা করেছেন, জাদু নয়। তাতে কোনোরূপ প্রতারণা-ছলনা নেই। বরং তা মুসা (আ.) এর অলৌকিক ক্ষমতার কাজ, আল্লাহ প্রদত্ত্ব। জাদুর ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ বিজয়ী হলে বিজিতদের জাদুর সরঞ্জাম অকেজো পড়ে থাকে মাটিতে। এখন তো সাপরূপ মুসার লাঠি সবকিছু গিলে ফেলেছে। এমন কাজ কিছুতেই জাদু হতে পারে না। এই মহারণে ফেরাউনের দলবল ও কিবতিদের সামগ্রিক অবস্থা- সেখানে তারা পরাভূত হলো ও লাঞ্ছিত হল। (সুরা আ‘রাফ : ১১৯)।

বর্ণিত আছে, জাদুর মহারণে যখন সত্য উদ্ভাসিত হলো, মিথ্যা পরাজিত হলো, তখন মুসা ও হারুণ (আ.) উভয়ে শোকরানা সিজদায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তখন জাদুকররাও মুসাকে অনুকরণ করল এবং জাদুকররা সিজদাবনত হলো। (সুরা আ‘রাফ : ১২০)।

তারাও আল্লাহর কাছে সিজদায় লুঠিয়ে পড়ল। মুহূর্তে তাদের চিন্তা ও বিশ্বাসে আমূল পরিবর্তন এসে গেল। তারা সমস্বরে বলে উঠল, আমরা ঈমান আনলাম জগতগুলোর প্রতিপালকের প্রতি। (সুরা আ‘রাফ : ১২১)। - যিনি মুসা ও হারুনেরও প্রতিপালক। (সুরা আ‘রাফ : ১২২)।

তাফসিরবিদ মাকাতিল বলেন, জাদুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মুসা (আ.) জাদুকর সর্দার শামাউনকে ডেকে বলেন, আমি যদি তোমার ওপর জয়ী হই, তাহলে কি তুমি আমার ওপর ঈমান আনবে? শামাউন বলল, আমি এমন জাদুর কারিশমা দেখাব, কোনো জাদু যার ধারে কাছে আসতে পারবে না। কাজেই তুমি যদি বিজয়ী হতে পার তাহলে অবশ্যই ঈমান আনব। কেননা, তাতে বুঝতে পারব যে, তোমার কারিশমা জাদু নয়, জাদু হলে আমার উপর জয়ী হতে পারত না। ফেরাউন দূর থেকে তাদের পারস্পরিক কথাবার্তার দৃশ্য দেখেছিল। একে অজুহাত বানিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক চালে মেতে উঠল। জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার কৌশল নিল। বলল, আজকের জাদু সম্পূর্ণ পাতানো খেলা। এর পেছনে তোমাদের অন্য মতলব আছে। ‘ফেরআউন বলল, কী! আমি তোমাদের অনুমতি দেয়ার আগে তোমরা তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলে? তা তো এক চক্রান্ত; তোমরা সজ্ঞানে এই চক্রান্ত করেছ নগরবাসীদের নগর থেকে বহিষ্কার করার জন্য। তোমরা শিগগিরই এর পরিণাম জানতে পারবে।’ (সুরা আ‘রাফ : ১২৩)।

জাতির উদ্দেশে জ্বালাময়ী এক ভাষণ। জনগণকে সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি ব্যবহার করল দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের স্লোগান দিল। মুসার বলল, তোমরা মিশরবাসীকে দেশ থেকে বহিষ্কারের ষড়যন্ত্র করেছ। তোমাদের উদ্দেশ্য মিশরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তোমরা কানে কানে সেই শলা-পরামর্শই করেছ। দু’জন কিবতি ছাড়া সব জাদুকর ছিল বনি ইসরাঈল বংশোদ্ভুত। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার উসকানিমূলক বক্তৃতার সঙ্গে তাদের দমিয়ে রাখার জন্য এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। সদম্ভে ঘোষণা করল-

‘আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করবই; অতঃপর তোমাদের সবাইকে শূলবিদ্ধ করবই। ডান পা আর বাম হাত অথবা বাম পা আর ডান হাত। অবশ্যই তোমাদের ফাঁসিকাষ্টে ঝুলিয়ে রাখব।” (সুরা আ‘রাফ : ১২৪)।

ফেরাউনের এমন হুমকিকে তোড়াই পাত্তা দিল জাদুকররা। ঈমানী শক্তির বিস্ফোরণে তাদের রক্ত কণিকায় শিহরণ জাগল আল্লাহর মহব্বতের আর তার রাহে শাহাদত লাভের তামান্নার। যে জাদুকররা সকালে কাফের ছিল তারাই বিকেল বেলা খাঁটি মুসলমানে রূপান্তরিত হল। আল্লাহর নবীকে পরাস্ত করতে রশি নিয়ে এসছিল, এখন নিজেরা বন্দি হয়ে গেল ঈমানের রশিতে। ক্ষমতাধর ফেরাউন যখন হাতপা কর্তন আর শূলীতে চড়ানোর হুমকি দিল তখনও তারা অবিচল। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনো আকুতি তাদের নেই। ‘তারা বলল, আমারা আমাদের প্রতিপালকের কাছে অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।’ (সুরা আ‘রাফ : ১২৫)।

তাদের ঈমানী চেতনার সামনে দুনিয়ার সব সুখ সম্ভোগ, ফেরাউনের সান্নিধ্য, পদোন্নতি, বেতন ভাতা বৃদ্ধির প্রলোভন তুচ্ছ হয়ে গেল। ফেরাউনকে তারা মুখের উপর বলে দিল: ‘তুমি তো আমাদের শাস্তি দিচ্ছ শুধু এ জন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে ঈমান এনেছি, যখন তা আমাদের কাছে এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ধৈর্যদান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদের মৃত্যু দাও।’ (সুরা আ‘রাফ : ১২৬)।

হ্যাঁ, অন্যায়ের সামনে মাথানত করা, জালিমের সহযোগিতা করা, জুলুমের সমর্থক হয়ে পদ পদবি লাভ করা, তার চেয়ে আমাদের কাছে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। জন্মেছি তো মরতে হবেই। এই মরণ যদি আল্লাহর রাহে হয়, সত্যের পথে হয় সেটিই হবে জীবনের পরম সাফল্য। সুরা তোয়াহায় ফেরাউনের উদ্দেশ্যে জাদুকরদের বক্তব্য আরও জোরদার। ফেরাউনকে- ‘তারা বলল, আমাদের কাছে যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার ওপর এবং যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ওপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দিব না। সুতরাং তুমি কর যা তুমি করতে চাও। তুমি তো শুধু পার্থিব জীবনের ওপর কর্তৃত্ব করতে পার। (সুরা তোয়াহা : ৭২)। “আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করেন এবং তুমি আমাদের জাদু করতে যে বাধ্য করেছ তাও (যেন ক্ষমা করেন)। আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী।’ (সুরা তোয়াহা : ৭৩)।

আমাদের সামনে জীবন মৃত্যুর অপার রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, ‘যে তার প্রতিপালকের কাছে অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো আছে জাহান্নাম, সেথায় সে মরবেও না, বাঁচবেও না।’ (সুরা তোয়াহা : ৭৪)। ‘এবং যারা তার কাছে উপস্থিত হবে মোমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে তাদের জন্য আছে সমুচ্চ মর্যাদা।’ (সুরা তোয়াহা : ৭৫)। ‘স্থায়ী জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই, যারা পবিত্র।’ (সুরা তোয়াহা : ৭৬)।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, তৃতীয় খণ্ড, বয়েত : ১৭২১ এর ভাবসম্প্রসারণ, দ্র. সুরা আরাফ, আয়াত -১১৬-১২৬ এবং সুরা তোয়াহা : ৭২-৭৬, তাফসিরে মাইবেদী)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত