ঢাকা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হেদায়েতের পথে পীর-আউলিয়ার ভূমিকা

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
হেদায়েতের পথে পীর-আউলিয়ার ভূমিকা

পীর। বহুল প্রচলিত ফারসি শব্দ। আরবিতে বলা হয় শেখ বা শায়খ। বাংলায় তার অর্থ বুড়ো। ইদানীং যত্রতত্র শায়খের প্রচলন হয়ে গেছে আর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের পরিভাষা পীর বলতে অনেকে সংকোচিত হয়। যাহোক, এক বুড়ো ছিলেন আগেকার দিনে এক লোকালয়ে। বুড়ো হলেও আসমানি আলোতে উদ্ভাসিত ছিল তার অন্তর। তাই সবার কাছে ছিল তার আলাদা সম্মান ও কদর। সমাজে তার মর্যাদা ছিল আপন উম্মতের মাঝে পয়গাম্বরের মতো। হাদিস শরিফে বর্ণিত ‘কোনো গোত্রের বুড়ো লোক আপন উম্মতের মাঝে পয়গাম্বরের মতো।’ ইসলামি সমাজে বুড়োদের প্রতি সম্মানবোধের যে আসন সংরক্ষিত, তার নেপথ্যে এই হাদিসের আবেদন অনস্বীকার্য। পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় ৬০ থেকে ৬৫ বছরের পর মানুষকে ঠেলে দেয়া হয় অবসর জীবনে। তাদের কি-না কার্যক্ষমতা রহিত। জ্যান্ত মানুষকে জীবন্মৃত করার এ ব্যবস্থা ইসলামি ভাবধারার পরিষ্কার পরিপন্থি। ৬০ বছরের পরে যদি সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান থেকে বাধা না থাকে, তাহলে এ বয়সে সরকারি চাকরি থেকে কেন বিচ্যুত করা হবে?

মা-বাবার খেদমতে বেহেশত পাওয়া আর মুরব্বিদের দোয়ায় জীবন ধন্য হওয়ার যে বিশ্বাস আমাদের সমাজে বিরাজিত, তা ইসলামি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দুর্লভ উপহার। আবু রাফে বর্ণিত উপরোক্ত মরফু হাদিসটির সনদ বর্ণনা করেছেন ইমাম দারেমি। ইবনে হিব্বান ও ইবনে তাইমিয়া দুর্বল হাদিসের তালিকাভুক্ত করলেও ‘আলেমরা নবীদের উত্তরাধিকারী’ শীর্ষক হাদিস ও কোরআন মজিদে ‘তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর’ মর্মে সুরা নাহলের ৪৩ নম্বর আয়াতের আবেদন সামনে রাখলে বুড়োদের মর্যাদা সম্পর্কিত হাদিসের বাণীর অকাট্যতা অস্বীকার করার সাধ্য কারও নেই।

একবার গ্রামের সেই বুড়োর এক ছেলে মারা যায়। কম বয়সি ছেলেকে হারিয়ে বাড়িঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়। চারিদিকে মাতম, আহাজারি। কিন্তু বুড়ো নির্বিকার, নিরুত্তাপ। শোকার্ত পরিবারের লোকরা বুড়োকে বলে : আপনার ছেলের মৃত্যুতে আমরা কাঁদছি। অথচ আপনার চোখে পানি নেই, কারণ কী? আপনার মনে কি দয়ামায়া বলতে কিছু নেই। নিজের ছেলে মারা গেল। তারপরও দিব্যি আরামে আছেন। আপনার আচরণে আমরা তো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত। আপনার প্রতি আমাদের আশা কি তাহলে বৃথা? আমরা তো মরণের পর আপনার দয়া-মমতার আশ্রয় পাব, আপনি আমাদের জন্য শাফায়াত করবেন, আমাদের গোনাহ খাতার মার্জনা পাব; এই আশা নিয়েই দিন গুজরান করি। আর যদি আপনার মনটাই নির্দয় হয়, তাহলে আমরা কার কাছে কী আশা করব। নবীজির উত্তরাধিকারী হিসেবে আপনার কাছে আমাদের এ প্রতাশ্যা তো অমূলক নয়। মওলানা রুমির চিন্তা এখানে চলে গেছে আরেক সত্যের দিকে। তাহলো আল্লাহর দরবারে সুপারিশের মাধ্যমে পাপিতাপী গোনাহগারদের মুক্তি প্রসঙ্গ।

গোফত পয়গাম্বর কে রুযে রাস্তাখিয

কেই গুযা’রাম মুজরেমা’ন রা’ আশ্করীয

নবীজি বলেছেন, হাশর নশর হবে যেদিন

পাপীদের কি অশ্রুঝরা রাখতে পারি সেদিন। ৩খ.ব-১৭৮৩

মন শফীয়ে আসিয়াঁ বা’শম বে জা’ন

তা’ রেহা’নম যে এশ্কানজা’য়ে গেরা’ন

গোনাহদের আমি শাফায়াতকারী হব মনেপ্রাণে

যাতে তাদের আজাব থেকে উদ্ধার করতে পারি নির্বিঘ্নে। ৩খ.ব-১৭৮৪

নবীজি (সা.) বলেছেন, আমি জানপ্রাণ দিয়ে গোনাহদের জন্য শাফায়াত করব। তাদের কঠিন আজাব থেকে মুক্ত করার জন্য আমি আল্লাহর সমীপে ফরিয়াদ জানাব। মওলানা রুমি (রহ.) এখানে ইসলামি জীবন দর্শনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শাফায়াত প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। বলেছেন, হাশরের ময়দানে আল্লাহতায়ালা নবী, ওলি তথা আপন প্রিয় বান্দাদের অনুমতি দেবেন, যাতে তারা গোনাহদের জন্য সুপারিশ করেন, মার্জনা নিয়ে গোনাহদের দোজখ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। সেই অনুমতির সুবাদে তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে এবং গোনাহরা মুক্তি পাবে। সবচেয়ে বড় সুপারিশ হবে প্রিয় নবীজি (সা.) এর শাফায়াত। তিনি বলেন, ‘আমার উম্মতের যারা কবিরা গোনাহে লিপ্ত ছিল, তাদের জন্য আমার সুপারিশ প্রযোজ্য হবে।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনু মাজা, আহমদ, আবনে হিব্বান, হাকেম)।

মওলানা রুমির ভাষায় নবীজি বলেন, আমার উম্মতের যারা নেককার, তাদের জন্য আমি শাফায়াত করব না। আমার শাফায়াতের দরকার তাদের হবে না। তারা নিজেরাই তো অন্যদের জন্য সুপারিশ করবে। প্রিয় নবীজির শাফায়াতের পর আছে অন্য পয়গাম্বরদের শাফায়াত। কাবাঘরের কালো পাথর, সিদ্দিকীন, শহীদরা, শৈশবে মৃত সন্তান, রোজা ইবাদত প্রভৃতি আর নবীজির উম্মতের নেক বান্দাদের শাফায়াতে অগণিত গোনাহগারের মুক্তির কথা বর্ণিত আছে হাদিসে। আবু জাদআ থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন : ‘আমার উম্মতের এক ব্যক্তির সুপারিশে বনি তামিম গোত্রের ভেড়ার পালের লোমের সংখ্যার চাইতেও অধিক লোককে বেহেশতে দাখিল করানো হবে।’ (মুস্তাদরাক, তিরমিজি, ইবনু মাজা, দারামি)।

একটি ভেড়ার গায়ের লোম কি মানুষ গণে শেষ করতে পারবে? তারপরে আরবের সর্বাধিক ভেড়া পালার জন্য বিখ্যাত বনি তামিম গোত্রের অসংখ্য ভেড়ার গায়ের লোম কতখানি হবে চিন্তা করে দেখুন। শাফায়াতের এই প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত স্বয়ং আল্লাহতায়ালাও শরিক হবেন।

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) সূত্রে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘...অতপর স্বয়ং আল্লাহ বলবেন, আমার শাফায়াত তো বাকি রয়ে গেল। তিনি দোজখের আগুন থেকে একমুষ্ঠি নেবেন। তারপর এমন লোকদের বের করবেন, যারা পোড়া কয়লায় পরিণত হয়েছে। ওদের জান্নাতের প্রবেশদ্বারের নহরের পানিতে ফেলে দেবেন। সেই পানির নাম মা-উল হায়াত, জীবনপানি। এর ফলে তারা নহরের পাড়ে গজিয়ে উঠবে, যেভাবে বন্যার পলিমাটিতে শস্যবীজ গজিয়ে ওঠে। তোমরা তো পাথরের বা গাছের আশপাশে এমনটি হতে দেখেছ। এর মধ্যে যেগুলো সূর্যের তাপের নিচে থাকে সেগুলোর রং সবুজ হয়। আর যেগুলো ছায়ায় থাকে, সেগুলোর রং হয় সাদা। অতঃপর, তারা মণি-মুক্তার মতো জ্বলজ্বল অবস্থায় বের হবে। তারপর তাদের কাঁধের উপর মোহরাঙ্কিত করা হবে। এরপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। জান্নাতবাসী তাদের দেখে বলাবলি করবে, এরা হলো আল্লাহর মুক্ত করা কাফেলা। এরা কোনো আমল করেনি, কোনো সৎকাজ তাদের আমলনামায় নেই। এরপরও আল্লাহ তাদের জান্নাতে দাখিল করেছেন।...’ (বোখারি : ৬৮৮৬)।

আসলে আল্লাহর রহমত ও দয়ার বিশালতার সীমা-পরিসীমা নেই। সেই রহমতে গোনাহগারদের শামিল করার জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করবেন, যার একটি শাফায়াত।

শাফায়াত সম্পর্কিত বিভিন্ন বর্ণনা থেকে কারও মনে যেন এই ধারণা না জন্মে যে, সুপারিশকারী ব্যক্তি বুঝি কারও পাপের বোঝা মাথায় নেবে।

হীচ ওয়াজের ভিযরে গাইরি বর নদাশত

মন নয়াম ভিযরে খোদা’য়ম বর ফরা’শত

কোনো বান্দা অন্যের পাপের বোঝা বহন করবে না

আমি (নবী) কারও গোনাহের বোঝা কাঁধে নেবো না। ৩খ.ব-১৭৮৮

কারণ কোরআন মজিদে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন : ‘প্রত্যেকে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারও ভার গ্রহণ করবে না। অতঃপর, তোমাদের প্রত্যাবর্তন তোমাদের প্রতিপালকের নিকটেই। তৎপর যে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করতে তা তিনি তোমাদের অবহিত করবেন।’ (সুরা আনআম : ১৬৪)।

এই আয়াত পরিষ্কার করে দিয়েছে, যিশু তার অনুসারীদের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে শূলিতে চড়েছেন ধরনের কোনো আকিদার স্থান ইসলামে নেই। গোনাহদের পাপের বোঝা তুলে নিয়ে পীর বাবা তরী পার করিয়ে দেবেন ধরনের বিশ্বাসও ইসলামের পরিপন্থি। কারণ শাফায়াত করার অধিকার কেউ পাবে না, যতক্ষণ আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি না হবে। অনুমতি পাওয়ার পরই নবী, ওলি ও নেককার লোকেরা আল্লাহর বিশাল রহমতের চাদরে মানুষকে স্থান নেয়ার জন্য ডাকাডাকির ভূমিকা পালন করবেন। মওলানা রুমির দৃষ্টিতে এক্ষেত্রে লোকালয়ের যিনি মুরব্বি বা পীর তার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি পরিষ্কার করে দিতে চান পীর কে বা কারা। মওলানা রুমি বলেন,

আঁকে বী ভির্যাস্ত শেখাস্ত আই জাওয়ান

দর কবূলে হক চো আন্দর কাফ কামান

যিনি শেখ তিনি পাপমুক্ত, কথাটি বুঝে নাও যুবক

কবুলিয়তে তিনি যেন তীরন্দাজের মুঠোয় ধনুক। ৩খ.ব-১৭৮৯

পীর অর্থে যে বুড়ো বা শায়খের কথা বলছি, তিনি পাপমুক্ত, তার চরিত্র সংরক্ষিত এবং আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে তার অবস্থান। কোনো চরিত্রহীন কখনও পীর হতে পারে না। মওলানা বলেন, সাধারণত কালো চুল বা দাড়ি সাদা হলেই বয়সের শেষ সীমায় পৌঁছলে কাউকে পীর বা বুড়ো বলা হয়। কিন্তু সুফিদের দৃষ্টিতে এই কালো চুল, সাদা চুল ভিন্ন জিনিস।

হাস্ত আ’ন মূয়ে সিয়াহ হাস্তিয়ে উ

তা’ যে হাস্তি আশ নমা’নদ তা’য়ে মূ

সেই কালো চুল, তার আমিত্ব ও অস্তিত্বের নাম

আমিত্বের অস্তিÍত্ব না থাকলেই হয় পীর নাম। ৩খ.ব-১৭৯১

কালো চুল দাড়ি সাদা হলে মানুষ বুড়া হয়ে যায়। আর চরিত্র ও স্বভাবের কালো চুল দাড়ি সাদা হলে পীর হওয়া যায়। স্বভাব ও চরিত্রের কালো চুল-দাড়িকে মওলানা রুমি বলেছেন ‘হাস্তি’। হাস্তি মানে অস্তিত্ব। অর্থাৎ স্বভাব চরিত্র, চিন্তা ও কর্মের মনুষ্য সত্তা। মানুষ যখন অহংকার, লোভ মোহ, জৈবিক, কামনা-বাসনা দমন করতে সক্ষম হয়, যখন আমিত্বকে অতিক্রম করে ঈমান ও তাকওয়ার বর্মে সজ্জিত হয়, তখন ধরে নেয়া যায় যে, তার চুল-দাড়ি সাদা হয়েছে। সে পীর ও ওলির মর্যাদায় চলে গেছে। বয়সে নবীন হলেও তিনি পীর, প্রবীণ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হজরত ঈসা (আ.)। কেননা, তিনি দোলনায় থেকে জ্ঞানবান মানুষের মতো কথা বলেছিলেন। মওলানার ভাষায় হজরত ঈসা (আ.) দোলনায় থাকতেই অতিক্রম করেছিলেন শায়খ ও পীরের মাকাম।

মওলানা রুমির দৃষ্টিতে সমাজ জীবনে এই পীর, গুরু, শায়খ বা মুর্শিদের গুরুত্ব অপরিসীম। মসনবি প্রথম খণ্ডের একটি বয়েতে তিনি জোরালো ভাষায় বলেন,

জুমলা আলম যিন সবব গুমরাহ শুদ

কম কেসী যাব্দালে হক আগাহ শুদ

সমগ্র জাহান এই কারণে গোমরাহ হয়ে গেল

কম লোকই আল্লাহর আব্দালদের পরিচয় পেল। (১খ. ব-২৬৪)

আব্দাল মানেও ওলি এবং কুতুব গাউছ নামে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় আছে। আল্লামা ইকবাল জাভিদনামায় তাদের ‘মর্দে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। আর তাদের সান্নিধ্য লাভে প্রাণান্ত চেষ্টার জন্য ছেলে জাভিদ ইকবালকে প্রাণ উজাড় করা উপদেশ দিয়েছেন। সামনের সংখ্যায় কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার আশা রাখি।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, তৃতীয় খণ্ড, বয়েত : ১৭৭২-১৭৯৮)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত