ঢাকা ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পীর-আউলিয়ার প্রকৃত পরিচয়

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
পীর-আউলিয়ার প্রকৃত পরিচয়

মসনবি শরিফের গেল আসরের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল পীর-আউলিয়া। ইতিহাস বলে, এই ভূখণ্ডে ইসলামের আগমন ও প্রচার-প্রসার হয়েছে পীর-আউলিয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামকে বলা হয় বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি। ওলিাভ সারাদিন পাড়ায়-মহল্লায় লোকালয়ে গিয়ে আমণ্ডজনতাকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন। তাদের সহজ-সরল কথাবার্তা, আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র দেখে ও ইসলামি জীবনবোধের অনুপম শিক্ষাদীক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করত। ওলিাভ সারা দিনমান ধর্মপ্রচারের পর একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে একত্রে রাতযাপন করতেন। ইবাদত-বন্দেগি, আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হতেন। পরদিন আবার মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে আল্লাহর পথে সত্য ও সুন্দর জীবন প্রণালির ছায়াতলে আসার জন্য বলতেন। তাদের সেই অবস্থানস্থল আস্তানা হিসেবে পরিচিত ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পদুয়ায় আরাকান রোডের সঙ্গে লাগোয়া একটি স্থানের নাম বার আউলিয়ার দরগাহ। চট্টগ্রাম শহর থেকে বের হয়ে ঢাকার পথে যাওয়ার সময়ও একটি স্থান আছে বার আউলিয়ার মাজার নামে। এগুলো আসলে বার আউলিয়ার স্মৃতির স্মারক, যাদের প্রচেষ্টার ফসল এখানে ইসলামের বিস্তার ও আমরা মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয়ার অধিকার অর্জন করি। আমরা আজকে ওলি-আল্লাহদের পরিচয় সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিকোণ থেকে জানার চেষ্টা করব।

ওলি। কোরআন মজিদের একটি পরিভাষা। পীর-আউলিয়া বলতে সাধারণভাবে আমরা আল্লাহর ওলিদেরই বুঝি। কিন্তু কারা এই ওলি? কী তাদের পরিচয়? তাদের যোগ্যতার মানদণ্ড কী? কীভাবে তাদের চেনা যায়? এসব প্রশ্নে কৌতূহলের শেষ নেই। অনেকে ওলি নামে কোনো বিশেষ শ্রেণির অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। তাদের বক্তব্য মোমিনরাই আল্লাহর ওলি। আবার অনেক ভ- ওলি সেজে আলখেল্লা জড়িয়ে ভালো ব্যবসা করেন। ফলে ওলির প্রকৃত পরিচয় নিয়ে ধূম্রজাল আর আমরা বিভ্রান্ত হই। মসনবি শরিফে মওলানা রুমি ওলি আল্লাহদের সাহচর্য গ্রহণের জোর তাগিদ দিয়েছেন। তাদের বিভিন্ন পরিচয়ও তিনি ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য আমরা সরাসরি কোরআন মজিদ ও হাদিস শরিফের আশ্রয় নিতে চাই। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন :

‘যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের ওলি। তিনি তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোকে নিয়ে যান। আর যারা কুফরি করে তাদের ওলি তাগুত। এরা তাদের আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। এরাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (সুরা বাকারা : ১৫৭)।

ওলি অর্থ অভিভাবক, বন্ধুজন। এই আয়াতে অভিভাবক অর্থই অধিক সুন্দর, সংগত ও প্রযোজ্য। অর্থাৎ যারা খাঁটি ঈমানদার হয়, তারা আল্লাহর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আল্লাহ তাদের অভিভাবক সাব্যস্ত হন। ফলে ঈমানের বরকতে তারা মন, চিন্তা, চরিত্র ও কর্মের অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার পথ খুঁজে পান। আর যারা ঈমান এনে আল্লাহকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে না, তারা কাফের। তাদের বন্ধুজন ও অভিভাবক হয় শয়তান। শয়তান জিন-জাতির মধ্যে যেমন আছে, তেমনি মানুষের মধ্যেও আছে। যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত থেকে বাধ্য করে, তারাই তাগুত।

দৃশ্যত সহজ মনে হলেও খুব জটিল একটি বিষয়ে আমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি প্রশ্ন করা হয়, মুসলিম সমাজ কোন শ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত হবে বা মানুষ কাদের দিকনির্দেশনা মেনে চলবে? মানুষের ইসলামি জীবন পরিচালনার নেতৃত্ব কি রাজনৈতিক নেতারা দেবেন, নাকি অর্থবিত্তে যারা সবার সেরা তারা হবেন সমাজের কর্ণধার? নাকি জ্ঞানী-গুণীরা হবেন পথপ্রদর্শক? জ্ঞানীদের মধ্যে সাধারণ জ্ঞানী ও ধর্মীয় জ্ঞানী বা উভয়ের মিশ্রন আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে মুসলিম সমাজ এমন ধর্মীয় জ্ঞানীদের দিকনির্দেশনায় চলবে, যাদের কথা আর কাজে মিল আছে। যাদের জীবন প্রণালি সাক্ষ্য দেয়, তারা ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, আল্লাহ ও রাসুলকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। যাদের দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা ও সমীহ জাগে। যারা দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। আসলে এরাই আল্লাহর ওলি। ঢাকঢোল পিটিয়ে ওলি হিসেবে যারা দরবার সাজিয়ে আছেন, তাদের চিত্রটা দৃষ্টির আড়ালে রেখে যদি আমরা প্রকৃত ওলির সন্ধান করি, তাহলে নিশ্চয়ই একটি দিকনির্দেশনা কোরআন ও হাদিস থেকে পেয়ে যাব।

কোরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াতের ভাষ্য থেকে জানা যায়, আল্লাহ যেমন ঈমানদারদের ওলি বা বন্ধুজন, তেমনি যারা ঈমানের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ তারাও আল্লাহর বন্ধুজন। আউলিয়া ‘আল্লাহর বন্ধু’ বলতে তাদেরই বোঝানো হয়। ওপরে উল্লেখিত আয়াতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা মোমিনদের ওলি, অভিভাবক বা বন্ধু হিসেবে পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে। আর নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহর বন্ধু হিসেবে মোমিনের পরিচয় দেয়া হয়েছে।

‘জেনে রেখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর বাণীর কোনো পরিবর্তন নেই; এটিই মহাসাফল্য।’ (সুরা ইউনুস : ৬২-৬৪)।

আয়াতের ভাষা হলো, ‘আউলিয়া আল্লাহ’ (আল্লাহর বন্ধুরা)। আউলিয়ার একবচন ওলি। ও দিয়ে ওলি হিসেবেও লেখা হয়। ওলি ফাঈলুন-এর ওজনে ফায়েল বা কর্তৃকারকের অতিশয়বাচক মুবালিগা। এই অর্থে ওলি বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যার ইবাদত ও আনুগত্য এমন লাগাতার, কোনোরূপ নাফরমানি তাতে বিঘ্ন বা ব্যত্যয় সৃষ্টি করে না।

একে মাফউল বা কর্মকারকের মুবালিগা হিসেবেও গণ্য করা যায়। যেমন জরিহ অর্থ জখম হয়েছে এমন আর কাতিল অর্থ নিহত। এ অবস্থায়, ওলি অর্থ এমন ব্যক্তি যার ওপর আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাগাতারভাবে বর্ষিত হয়। কখনও কখনও ওলি অর্থ এমন লোক বোঝায়, যিনি সর্বাবস্থায় পদস্খলন হতে সংরক্ষিত। যে কোনো নবীকে যেমন অবশ্যই মাসুম ও নিষ্পাপ হতে হবে, তেমনি ওলিকে হতে হবে সংরক্ষিত। নিষ্পাপ ও সংরক্ষিত এর মধ্যে পার্থক্য হলো, কোনো নিষ্পাপ বা মাসুমকে কখনও পাপ স্পর্শ করে না। আর মাহফুয এর বেলায় ব্যত্যয় ঘটতে পারে। তার ছোটোখাট পদস্খলন হতে পারে। তবে তিনি সেই পদস্খলনের পুনরাবৃত্তি করেন না। কোরআন মজিদের ভাষায় ‘এরাই হলো সেই লোক যারা অনতিবিলম্বে তওবা করে নেয়।’

‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং সত্বর তওবা করে, এরাই তারা যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা : ১৭)।

হজরত সাঈদ ইবনে জুবায়র (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়, কারা আল্লাহর ওলি। নবীজি বলেন, তারা সেই লোক যাদের দেখলেই আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। (আসসিল সিলাতুস সাহীহা, ৪/ ৩১১)।

নবী করিম (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার ওলি তারা, যারা আমার স্মরণ নিয়ে আলোচনা করে আর আমি তাদের কথা স্মরণ করে আলোচনা করি। (মুসনদে আহমদ, ৪/২২৭)।

হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন লোকরা রয়েছেন, যারা নবী নন, শহীদও নন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের পদমর্যাদা দেখে নবীরা ও শহীদরা ঈর্ষান্বিত হবেন। লোকদের মধ্যে একজন বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তারা কারা? এবং তাদের কাজকর্ম কীরূপ? হয়তো আমরা তাদের পরিচয় পেয়ে তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করব। নবীজি বললেন, তারা সেই লোক, যারা পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন না থাকা বা একে অপরের মধ্যে কোনোরূপ লেনদেন বা টাকাণ্ডপয়সার স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে পরস্পরকে ভালোবাসে। আল্লাহর কসম তাদের মুখমণ্ডল হবে নূরে আলোকিত। আর তারা অবস্থান করবে নূরের মিম্বরের ওপর। মানুষ যখন ভীতসন্ত্রস্ত্র হবে, তখন তারা ভীত হবে না। মানুষ যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে, তখন তারা চিন্তান্বিত হবে না। অতপর, নবীজি এ আয়াতখানি তেলাওয়াত করেন : ‘জেনে রেখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (মুসনদে আহমদ, ৫/৩৪১)।

আবু ইদ্রিস আল-খাওলানী হজরত আবুদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার মহব্বত (ভালোবাসা) ওইসব লোকদের জন্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে, যারা আমার জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে। আমার ভালোবাসা তাদের জন্য অবধারিত হয়েছে, যারা আল্লাহর ওয়াস্তে পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করে। আমার মহব্বত তাদের জন্য অবধারিত হয়ে গেছে, যারা আমার ওয়াস্তে পরস্পর উঠাবসা করে। যারা আমার মসজিদগুলোকে আমার স্মরণ দ্বারা আবাদ রাখে। যারা মানুষের উপকার সাধন করে এবং তাদের আমার আনুগত্যের দিকে আহ্বান করে। তারাই হলো আমার বন্ধুজন। যাদের আমার আরশের ছায়ার নিচে ছায়া দেব, আমার কাছেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করব, আমার আজাব থেকে তাদের নিরাপত্তা দান করব এবং তাদের ৫০০ বছর আগেই জান্নাতে দাখিল করব, তারা সেখানে পরম সুখ উপভোগ করবে এবং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বাস করবে। অতপর নবী করিম (সা.) এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, ‘জেনে রেখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক, মুসনদে আহমদ)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত