ঢাকা ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৩৫৯)

আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চাবি কোথায়

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চাবি কোথায়

মসনবি শরিফের গল্পের ধারাবাহিকতায় আল্লাহর ওলির পরিচয় জানার জন্য আমরা একটু দূরে গিয়েছিলাম। কোরআন মজিদ ও হাদিস শরিফের বর্ণনা থেকে ওলি আল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধুজনের পরিচয় পাওয়ার চেষ্টা করেছি। আরও বিশদভাবে জানতে হলে সুরা মুমিনুনের ১-১১ আয়াতে মোমিনের সুনির্দিষ্ট গুণাবলি, সুরা ফুরকানের ৬১-৭৭ আয়াতে ইবাদুর রহমানের পরিচয় এবং সুরা কাহফের ৬০-৮২ আয়াতে খিজির (আ.) এর কাছে হজরত মুসা (আ.)-এর ইলমে লাদুন্নীর রহস্যাবলি আর হজরত সুলায়মান (আ.) এর একজন সভাসদ ইসমে আজমের শক্তিতে চোখের পলকে সাবার রানি বিলকিসের সিংহাসন হাজির করা সংক্রান্ত (সুরা নামল ৩৯ আয়াতের পূর্বাপর) বর্ণনাগুলো সবিস্তারে জানা দরকার।

আমাদের আলোচনা চলছিল এক বুড়োকে নিয়ে। বুড়োর ছেলে মারা যাওয়ার পরও তার চেহারায় শোকের আলামত না দেখে স্বয়ং বুড়ি রাগান্বিত হয়। প্রশ্ন তোলে, তোমার মতো মায়াদয়াহীন পিতা আর জগতে নেই। বৃদ্ধ জবাবে বলে, ওহে জীবনসঙ্গিনী! একথা মনেও আনবে না যে, আমার অন্তরে মায়াদয়া নেই। আল্লাহতায়ালা খাস দয়া ও রহমত দিয়েই আমার অন্তরকে বানিয়েছেন। এ কারণে মুসলমান কেন কাফেরের প্রতিও আমার দয়ামায়া প্রসারিত। রাস্তার তুচ্ছ কুকুরের জন্যও আমি চিন্তা করি। কুকুরের জন্যও আমি দোয়া করি, হে আল্লাহ একে তার স্বভাব থেকে মুক্ত কর, যাতে মানুষের পাথর কংকরের লক্ষ্যবস্তু সে না হয়।

যা’ন বিয়া’ওয়ার্দ আউলিয়া রা’ বর জমিন

তা কুনাদশা’ন রাহমাতান লিল আলামিন

আউলিয়াদের দুনিয়াতে পাঠানের কারণ জানো সঠিক

তারা যেন হন জগৎবাসীর প্রতি দয়া-মায়ার প্রতীক।

আল্লাহ রহমান রহিম দয়াময় মেহেরবান অসীম। সেই রহমতের সওগাত দিয়ে তিনি আউলিয়ায়ে কেরামকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। মওলানা রুমির দৃষ্টিতে আউলিয়ায়ে কেরাম সৃষ্টিকুলের প্রতি আল্লাহর রহমত। তবে কীভাবে তারা রহমত তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তারা একদিকে দুনিযার মানুষকে আল্লাহর খাস রহমতের ভাগি হওয়া ও খাস দরবারে বরিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। অপরদিকে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন, তোমার রহমত দুনিয়ার মানুষের জন্য অবারিত কর। এটিই আমার মতে আল্লাহর ওলিদের সঠিক পরিচয়। তারা আল্লাহর পবিত্র গুণাবলি ও অপার রহমতের বর্ণনা দিয়ে নানা কৌশলে মানুষকে আল্লাহমুখী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, অপরদিকে আল্লাহর দরবারেও ফরিয়াদ জানান, মানুষকে তুমি হেদায়াত নসিব করো। তোমার রহমতের চাদরে তাদের শামিল করো।

জাহ্দ বেনমা’য়দ আযিন সূ বাহরে পন্দ

চোন নশুদ গূয়াদ খোদা’য়া’ দর মবন্দ

একদিকে মানুষকে উপদেশ দান আর হেদায়তের চেষ্টারত

না হলে বলে, করো না বন্ধ তব রহমতের দরজা প্রভু!

মওলানা রুমি এবার আল্লাহর রহমতের স্বরূপ বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহর রহমতের দুটি রূপ। একটি আংশিক। আরেকটি সামগ্রিক। সাধারণত আল্লাহর আংশিক রহমত পেয়ে মানুষ জীবন নিয়ে বাঁচে, দ্বীনের পথে পরিচালিত হয়; কিন্তু যদি তার সামগ্রিক রহমতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তাহলে বিশাল সাগরের মতো হয়ে যাবে। মওলানার পরামর্শ, তুমি অংশতে থেকো না; সমগ্র হয়ে যাও। সাগরে পরিণত হও। আল্লাহর অপার রহমতের মতো বিশাল মন নিয়ে মানুষের প্রতি দরদি হও।

বুজুর্গের বক্তৃতা শুনে বিবিজান মুখ খুললেন। আপনার মন যদি এমনই হয়, মানুষের প্রতি যদি দরদ টগবগ করে তাহলে নিজের সন্তানের মৃত্যুতে শোকার্ত হন না, কারণ বলতে হবে। বললেন, বেগমজান! শীতকাল আর গ্রীষ্মকালে তফাৎ অনেক। আমার কান্না না আসা আর মানুষের কান্না না আসার মাঝে তফাৎ আছে। আমার সব সন্তানও যদি মৃত্যুবরণ করে, তুমি কি মনে কর যে, তারা আমার চোখের আড়াল হয়ে যায়? আমি যখন তাদের অন্তর্চক্ষে সামনে হাজির দেখি, তখন তাদের জন্য তোমার মতো কান্নাকাটি করব কেন?

খল্ক আন্দর খা’ব মী বীনন্দশা’ন

মন বে বীদা’রী হামী বীনম আয়া’ন

মানুষ তাদের দেখে স্বপ্নে আমি দেখি তাদের

জাগ্রত অবস্থায় যেন তারা আমার সম্মুখে।

বিবিজানের মনে প্রশ্ন, আমার ছেলে তো মারা গেছে। তার অধিবাস ওই জগতে। আপনি থাকেন এখানে, এই জগতে। তাকে কীভাবে দেখেন তা আমার বোধগম্য নয়। বুজুর্গ জবাব দেন,

যিন জাহা’ন খোদ রা’ দমী পিনহা’ন কুনাম

বর্গে হিস রা’ আয দেরাখত আফশা’ন কুনাম

মুহূর্তের জন্য নিজেকে গায়েব করি এই জগৎ হতে

অনুভূতির পত্রপল্লব ঝেড়ে ফেলি দেহের বৃক্ষ হতে।

অর্থাৎ আমার যে মানব সত্তা, তার জামাটি কিছুক্ষণের জন্য খুলে ফেলি। আমার অন্তরের বৃক্ষ হতে অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়ের পত্রপল্লবগুলো ঝেড়ে ফেলি। ঘুমের মধ্যে যেমন মানুষ বাহ্যিক চেতনাশূন্য হয়, আমার অবস্থাও তখন সেরূপ হয়ে যায়। তখন মানুষ যেভাবে স্বপ্নে ওই জগতের বিষয়াদি দেখে, আমি সজাগ অবস্থায় তা দেখতে পাই।

বিষয়টি খুবই সূক্ষ্ম ও কৌতূহল উদ্দীপক। আমাদের মন জানতে চায়, কীভাবে জাগ্রত অবস্থায় ভাবের তন্ময়তায় আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করা সম্ভবপর হতে পারে। মওলানার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা, কীভাবে আমরা আমাদের অস্তিত্বের গাছের পাতাপত্তরগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারব? কীভাবে ইন্দ্রিয় চেতনার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভবপর হবে। মওলানা জবাব দেন,

হিস আসিরে আকল বা’শদ আই ফোলা’ন

আক্ল আসিরে রূহ বা’শদ হাম বেদা’ন

অনুভূতি বন্দি আকলের কাছে শোনো মন দিয়ে

আকল বন্দি রুহের কাছে জানো তা ভালোভাবে।

মানুষের ইন্দ্রিয় আছে। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি ও চেতনা আছে। এই অনুভূতি ও চেতনা বন্দি থাকে আকল বা হুশজ্ঞানের কাছে। যতক্ষণ হুশ থাকে ততক্ষণ চেতনা ও ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকে। তার পরের কথা হলো, হুশ-জ্ঞান বন্দি থাকে রুহের কাছে। ইউসুফ ইবনে আহমদ মৌলভি বলেন, দেহের যে রাজ্য তাতে রুহ হলো বাদশাহ আর আকল হলো তার মন্ত্রী। আর অন্যান্য ইন্দ্রিয়শক্তি তার প্রজা। এখানে সমস্যা হলো, হুশ-জ্ঞান বা আকলের ওপর কুপ্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনার আধিপত্যের কারণে সে তার অধীন অন্যান্য শক্তিকে শাসন করতে পারে না। এরূপ অবস্থায় রুহ বা আত্মা এগিয়ে এসে আকলের হাতের শিকল খুলে দেয়। মওলানা রুমি রুহের এই স্পর্শকাতর অবস্থাকে একটি উদাহরণের সাহায্যে বোধগম্য করাতে চান। তা হলো, রুহের উদাহরণ স্বচ্ছ নির্মল স্ফটিকের মতো পানি আর ইন্দ্রিয় অনুভূতি ও কল্পনাপ্রসূত চেতনাগুলো পানির ওপরে ভাসমান খড়কুটো কচুরিপানার মতো। কচুরিপানা যখন স্বচ্ছ নির্মল পানিকে আচ্ছাদন করে ফেলে, তখন আকল রুহকে দেখতে পায় না। তখন সাধনার কশাঘাতে আকলের দুই হাত সক্রিয় হয়। আকল এগিয়ে এসে রুহ ও তার মাঝে আচ্ছাদিত কচুরিপনাগুলো সরাতে থাকে। এক পর্যায়ে রুহের স্বচ্ছ সলিল আকলের সামনে দৃশ্যমান হয়।

খাস বস আন্বুহ বুয়াদ বর জো চোন হুবাব

খাস চো য়্যকসো রফত পয়দা গশত আ’ব

কচুরিপানা প্রচুর থাকে পানিতে বুদ্বুদের মতো

কচুরিপানা সরে গেলে ভাসে পানি স্ফটিকের মতো।

কল্পনা ও ইন্দ্রিয় অনুভূতির কচুরিপানার সংখ্যা বুদ্বুদের মতো অসংখ্য অগণিত। এগুলো রুহের পানিকে আচ্ছাদন করে থাকে। কিন্তু আল্লাহপাক যখন আকলের হাতের বন্ধন খুলে সক্রিয় করেন, তখন জল্পনা-কল্পনা দূরে সরে যায়, আধ্যাত্মিক জগৎ তখন চোখের সামনে পর্দাহীনরূপে দৃশ্যমান হয়। আর যদি আল্লাহ আকলের হাতকড়া খুলে না দেন, তাহলে আমাদের রুহের পানি রাশির ওপর কল্পনা ও অনুমানের কচুরিপানা বাড়তেই থাকে আর আত্মার জগৎকে জ্ঞান ও বুদ্ধির চোখ থেকে আড়াল করে রাখে। তখন তোমার নফসে আম্মারা আনন্দে নাচে আর তোমার হুশ-জ্ঞান নিজের অসহায়ত্বের জন্য কাঁদে। এ অবস্থায়-

চোনকে তাকওয়া বস্ত দো দস্তে হাওয়া’

হক গুশায়দ হার দো দস্তে আকল রা’

তাকওয়া যদি বন্দি করে নফসের দুই হাত

তখন আল্লাহ খুলে দেন আকলের দুই হাত।

তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় ও সংযমী জীবন যখন নফসে আম্মারার কামনা-বসনার হাতে কড়া লাগায়, তখন আল্লাহতায়ালা তোমার আকল বা জ্ঞানবুদ্ধির দুটি হাত খুলে দেন। সাবযাওয়ারি বলেন, ভোগলিপ্সা বা শাহওয়াত আর ক্রোধ হচ্ছে কামনা দুই হাত। আর আকলের দুটি হাত হলো, জ্ঞান ও আমল বা সৎকর্ম।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৩খ. বয়েত-১৭৯৯- ১৮৩৪)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত