ঢাকা ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৩৬৬)

কুকুর থেকে শেখ সাফল্যের কাহিনি

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
কুকুর থেকে শেখ সাফল্যের কাহিনি

একজন সাহাবির কথা। জীবনযুদ্ধে তিনি বারবার পরাজিত। একদিন নবীজির (সা.) কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলেন। ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি তো জীবনকে গোছাতে পারছি না। লেনদেনে শুধুই ঠকে যাই। বেচাকেনায় বরাবর লোকসান হয়। সবাই আমার মাথায় কাঠাল ভেঙে খায়। যখন আমার কাছে কেউ কিছু বিক্রি করে অথবা আমি কারো কাছ থেকে কিনি তখন মনে হয় আমার ওপর কেউ জাদু করেছে। আমি যেন জাদুগ্রস্ত, বোকার হদ্দ। বাজারে গেলে আমার হুঁশ ঠিক থাকে না। আমাকে সবাই বোকা বানিয়ে বিপথে নিয়ে যায়। নবীজি বললেন, ‘তুমি একটা কাজ কর। যে বেচাকেনায় তুমি ভয় পাও

তাতে বিক্রেতার সঙ্গে শর্ত করে নিও, আমার এই ক্রয়ে তিন দিনের অবকাশ থাকবে।’ বলবে যে, আজ থেকে তিন দিনের ভেতর পছন্দ না হলে কেনা মালটি ফেরত দিতে পারব।

‘ধৈর্যশীল হও। মনে রেখো, ধীরস্থিরে কাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় আর তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে।’ সহজ-সরল সাহাবির প্রতি নবীজির অমূল্য উপদেশকে সম্বল করে মওলানা রুমি চিন্তার জগৎ আলোকিত করেছেন। সাহিত্যের নানা অলঙ্কার আরোপ করে হৃদয়গ্রাহী সংলাপ সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, তুমি ইচ্ছা করলে কুকুর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পার। ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে এক টুকরা রুটি ফেলে দাও। দেখবে যে, কুকুর রুটির টুকরাটি তাড়াতাড়ি মুখে নিচ্ছে না। আগে শুঁকে দেখছে। যখন বুঝতে পারে যে, খাওয়ার উপযুক্ত তখনই মুখে নেয়। এর আগে নয়। তুমি মানুষ। কুকুরের চেয়ে নিশ্চয়ই উত্তম। তোমার সামনে যে কোনো বিষয় এলে প্রথমে শুঁকে দেখ। তারপর তোমার আকল প্রয়োগ কর। জ্ঞানবুদ্ধির যে সম্পদ আছে তা দিয়ে পরখ করে নাও। তোমার দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে কতখানি কাজে আসবে মনে মনে নির্ণয় কর। সাবধান! যে কোনো মতবাদ চিন্তা-ভাবনা না করে গ্রহণ করবে না। কোনো সুযোগ সামনে এলে দুনিয়া আখেরাতে পরিণতির কথা না ভেবে লুফে নিও না।

পীশে সাগ চোন লোকমেয়ে না’ন আফকানী

বূ কুনাদ ওয়াঙ্গাহ খোরাদ আই মুওতানী

কুকুরের সম্মুখে যদি রাখ এক টুকরা রুটি

আগে শুঁকে দেখে, তারপর খায়, বুঝ কথাটি।

উ বেবীনী বু কুনাদ মা বা খেরাদ

হাম বেবূয়ীমাশ বে আক্লে মুন্তাকাদ

নাক দিয়ে সে গন্ধ নেয়, আমরা বুদ্ধি দিয়ে

শুঁকে দেখব আমাদের সূক্ষ্মবিবেক বুদ্ধিতে।

কথাটি বুঝার জন্য কুকুরের উদাহরণ। নচেৎ সব সৃষ্টিজগতের ব্যবস্থাপনায় এ নিয়মই বলবৎ। আল্লাহতায়ালা ধীরস্থিরে সৃজন করেছেন গোটা সৃষ্টিজগৎ। কোরআন মাজিদে বর্ণিত এ জমিন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন তিনি ছয় দিনে। (দ্র. সুরা আরাফ : ৫৪; ইউনুস-৩; হুদণ্ড৭; ফুরকান-৫৯ ও সজিদা-৪) কেন তিনি এমনটি করেছেন। তিনি তো এক মুহূর্তের মধ্যে কুন (হয়ে যাও) বললেই হাজার হাজার বিশ্বজাহান ফায়াকুন (সৃজিত), হয়ে যেত।

এ তো গেল, বিশাল সৃষ্টিলোকের কথা। তুমি তোমার ভেতরের দিকে তাকাও। একটু একটু করে তোমাকে তিনি পূর্ণ মানুষের অবয়বে গঠন করেছেন। এর জন্য সময় নিয়েছেন দীর্ঘ চল্লিশটি বছর। অথচ তিনি ইচ্ছা করলে এক নিঃশ্বাসের মধ্যে কত শত মানুষকে অনস্তিত থেকে অস্তিত্ব দান করতে পারেন।

তুমি জান যে, হজরত ঈসা (আ.) একটি দোয়া পড়লেই মৃতলোক জিন্দা হয়ে যেত। যিনি ঈসা (আ.) এর স্রষ্টা, মালিক ও প্রভু, তার কথা চিন্তা করে দেখ, তিনি কি চাইলে লাখো কোটি মানুষ নিমিষে সৃজন করতে পারেন না? তবুও তিনি ধীরে ধীরে করেন। সৃষ্টিজগতেও এই ব্যবস্থাপনাই বলবৎ রেখেছেন। তোমাকে শেখানোর পেছনে এটিই উদ্দেশ্য। কোনো কিছু পেতে চাইলে ধৈর্য ধরে চেষ্টা করতে হবে। এই চেষ্টা হতে হবে লাগাতার। বিষয়টি তোমার বোধগম্য হওয়ার জন্য আরো একটি উদাহরণ নাও। পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে আসে সরু চিকন ধারায়। সেই ঝরনা অবিরাম বয়ে চলে। এ কারণে অগভীর হওয়া সত্ত্বেও কোথাও নাপাক হয় না, পানি দূষিত হয় না। স্বচ্ছ নির্মল ধারায় এগিয়ে যায়।

বস্তুত ধীরস্থিরতা আনন্দ ও সৌভাগ্য বয়ে আনে। ধৈর্যের সঙ্গে ডিমে তা দিলে পাখির বাচ্চা ফুটবে। আকাশে ডানা মেলে উড়াল দেবে। কিন্তু সাবধান! এই তা দেয়ার মধ্যেও বিচক্ষণতা থাকতে হবে। কেননা, অনেক ডিম দেখতে এক রকম হলেও ভিন্ন প্রকৃতির।

বয়যায়ে মা’র আরছে মা’নদ দর শাবাহ

বয়যায়ে গুঞ্জাশক রা’ দূর আস্ত রা’হ

সাপের ডিম যদিও দেখতে চড়ুই পাখির ডিম

বাস্তবে উভয়ের মাঝখানে ব্যবধান সীমাহীন।

একটি থেকে বেরোয় সাপ, আরেকটি ফুটে জন্মায় চড়ুইছানা। কাজেই উভয়ের ফারাক না বুঝে তা দিলে বিপদ আছে। আরেকটি উপমা নাও। (পেয়ারা আকৃতির) গোলাবির দানা আর আপেলের দানা দেখতে এক। কিন্তু একটি থেকে গোলাবি, আরেকটি থেকে আপেল পাওয়া যায়। সাদৃশ্য ও বৈশাদৃশ্য শুধু এই দুই ফলে সীমাবদ্ধ নয়। গাছগাছালির দিকে তাকালে দেখবে, পাতাগুলো এক রকম; কিন্তু গাছে গাছে ফলের স্বাদ ও ধরন হাজার রকম।

গাছগাছালির মতো মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও পরস্পরের মতো অভিন্ন। কিন্তু ভেতরে খোঁজ নিয়ে দেখ একেক প্রাণএকেক আকর্ষণ নিয়ে বেঁচে আছে। মানুষ বাজারে যায়, এক রকম দেখায়। কিন্তু পকেটের স্বাস্থ্য থাকে একেক রকম। কারো মুখে হাসির ঝিলিক, কারো মন বেজার।

হামচুনা’ন দর মর্গ য়্যাকসা’ন মী রওয়ীম

নীম দরখুসরা’ন ও নীমি খুসরুয়ীম

অনুরূপ মৃত্যুর কোলে সবাই যাই আমরা

অর্ধেক লোকসান গুনে অর্ধেক বাদশাহ।

মানুষ হিসেবে আমরা সবাই মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করি। জাহেরিভাবে সবার মরণ এক সমান। সবার শেষ শয্যা মাটির বিছানা। কিন্তু কারো চিরবিদায় হয় ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। কারো বিদায় সাফল্যের জয়গানে। এরশাদ হয়েছে :

‘সেদিন তাদের প্রত্যেকের হবে এমন গুরুতর অবস্থা, যা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে। অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল এবং অনেক মুখমণ্ডল সেদিন হবে ধূলিধূসর। সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে কালিমা। এরাই কাফির ও পাপিষ্ঠ।’ (সুরা আবাসা : ৩৭-৪২)।

কাজেই জীবনে সাফল্য লাভ করতে হলে এই তফাত মানতে হবে। পরস্পরের পার্থক্য তারতম্য অনুধাবন করে চলতে হবে। তার আলোকে জীবনকে সাজাতে হবে। গড্ডলিক প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া যাবে না। যা কিছু সামনে আসে বাছবিচার না করে গ্রহণ করা যাবে না। সর্বাবস্থায় ধৈর্যই সাফল্যের জীয়নকাঠি- এ কথা মনে রাখতে হবে। তড়িঘড়ি ও তাড়াহুড়ার প্রবণতা ছাড়তে হবে। আল্লাহর সৃষ্টি ব্যবস্থাপনা হলো, ধীরে ধীরে পরিপক্বতা অর্জন। এ নিয়ম সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান। তুমি যদি জীবনে সাফল্য অর্জন করতে চাও, যদি চাও যে, কারো কাছে ঠকবে না, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তাহলে ধৈর্র্যের সঙ্গে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। মনে রাখবে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারাটাই জীবনের সাফল্য। আর অধৈর্য হয়ে চেষ্টা ত্যাগ করার মধ্যে তোমার পরাজয় নিশ্চিত। আল্লাহপাক চান, মানুষ যেন ধৈর্যের সড়ক বেয়ে সাফল্যের গন্তব্যে যাত্রা করে। তবে যাওয়ার পথে মনটা সন্দেহপ্রবণ রাখতে হবে। কোনো কিছু গ্রহণ বা বর্জন করার আগে বাছ-বিচার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প, ৩য় খণ্ড. বয়েত-৩৪৯৪-৩৫১৬)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত