ঢাকা ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনীতির পাপ-পুণ্য

আবু নাঈম ফয়জুল্লাহ
রাজনীতির পাপ-পুণ্য

রাজনীতি শুধু রাষ্ট্রক্ষমতার সিঁড়ির নাম নয়। রাজনীতি একটি ইবাদতও। আবার তা পাপের আখড়াও। রাজনীতি কখন পাপের আর কখন পুণ্যের তা নির্ভর করে রাজনৈতিকের নিয়ত ও কর্মের ওপর। রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে যুক্ত থাকতে পারা বড় নেয়ামতের ব্যাপার, একই সঙ্গে তা বড় বিপজ্জনকও। তাই রাজনীতিতে তাসাউফের ক্ষেত্র ও পরিস্থিতি অহরহ বিরাজিত। অন্ধের চোখের পর্দাহীনতার গোনাহ নেই। পুরুষত্বহীন বিকল অঙ্গের অধিকারীর কাছে ষোড়শী সুন্দরী নারীর উপস্থিতি মূল্যহীন। পর্দাহীনতার গোনাহ চক্ষুষ্মানের। জেনার ভয় পৌরুষত্বের অধিকারীর। তেমনি একজন ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিকের ক্ষমতার কারণে পাপে ডুবে যাওয়ার ভয় অনেক বেশি একজন ক্ষমতাহীনের তুলনায়।

পুণ্যের রাজনীতি

একটা সময় ছিল যখন ভালো মানুষরা পৃথিবী শাসন করত। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম পরিচয় ছিল, তিনি শাসক ছিলেন। তিনি তার সময়ের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্বকে নিকৃষ্ট মানুষের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ভালো মানুষদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, শাসক হয়েও কীভাবে ভালো থাকা যায়। মিথ্যা, অনাচার, দুর্নীতি ও অরাজকতাকে ছুড়ে ফেলে সমাজে কীভাবে সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। তিনি ভালো মানুষদের নেতৃত্বের ধারা চালু করে গেছেন পৃথিবীতে। তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমেই পৃথিবী দেখেছে, রাষ্ট্রক্ষমতা ভালো মানুষদের হাতে গেলে পৃথিবী জান্নাত হয়ে উঠতে পারে। খলিফা আবু বকর, ওমর (রা.) থেকে শুরু করে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) হয়ে আঠার শতকে উসমানি খেলাফতের সমাপ্তি পর্যন্ত ইতিহাসের দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় অসংখ্য উদাহরণ উঠে এসেছে বিশ্বমঞ্চে, যাদের হাত ধরে পৃথিবী শান্তির নীড়ে পরিণত হয়েছিল। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও নীতিহীনতাকে তারা জাদুঘরে পাঠিয়েছিলেন। তাদের রাজনীতি ছিল দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের রাজনীতি। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ছিলেন একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার ছেলে, এক বাদশাহর জামাতা। তিনি বেড়ে ওঠেছিলেন রাজপরিবারে রাজকীয় পরিবেশে। সে ওমর শাসনক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর সে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গরিব মানুষে পরিণত হয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সম্পদের আমানত রক্ষা করে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ না করে সাধারণ জীবনযাপন করে। আল্লাহর ভয়ে নিজের স্ত্রীর গহনা, সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেছিলেন তিনি। কারণ তার শ্বশুর ছিলেন মুসলিম রাষ্ট্রের খলিফা। অসতর্কতাবশত খলিফা শ্বশুরের দেওয়া উপহারে রাষ্ট্রীয় সম্পদের কোনো অংশ থাকতে পারে এই সন্দেহমূলক ভয়ে তিনি তার স্ত্রীর সম্পদ ও অলংকারাদি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে দিয়েছিলেন। মুসলিম শাসকরা রাজনীতিকে সৃষ্টির সেবা মনে করতেন। আর নিজেকে ভাবতেন জনগণের কল্যাণে ও সেবায় নিয়োজিত একজন সেবক হিসেবে। যুগে যুগে চলে আসা এমন রাজনীতি নিঃসন্দেহে পুণ্যের রাজনীতি, যে রাজনীতিতে ছিল জনসেবা ও দায়িত্ব পালনে আল্লাহর ভয়।

রাজনীতি কি সওয়াবের কাজ?

নবীজি (সা.) হিজরতের পর মদিনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পর সেই রাষ্ট্রকে সুসংহত ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। সেই রাষ্ট্রকে ছড়িয়ে দিয়েছেন দূর থেকে বহু দূরে। যদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রচেষ্টাই রাজনীতি হয় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাজনীতি অনেক বড় সওয়াবের কাজ। কারণ নবী জীবনের বৃহৎ অংশ জুড়েই রয়েছে এর বিস্তৃতি। আল্লাহপাক কোরআন মাজিদে এরশাদ করেন, ‘তিনি তার রাসুলকে সঠিক দিশা ও সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি আল্লাহর দ্বীনকে সব মতাদর্শের ওপর বিজয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।’ (সুরা সাফ : ৯)। আর এটা স্পষ্ট কথা যে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো মতাদর্শ বিজয়ী হতে পারে না। তাই অন্য এক আয়াতে আল্লাহপাক মুসলিমদের সরাসরি রাষ্ট্রশক্তি সুসংহত করার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর তোমরা তাদের জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব ছাউনি প্রস্তুত কর, যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও নিজেদের শত্রুদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখবে।’ (সুরা আনফাল : ৬০)।

ওলামায়ে কেরাম বলেন, ইসলামের প্রায় ৬০ শতাংশ বিধান এমন আছে যার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন রাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব না। যেমন, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, জুলুম নির্যাতন বন্ধ করা, দারিদ্র্য বিমোচন করাসহ ইসলামের মৌলিক আদেশগুলো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তাই এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা শুধু সওয়াবের কাজ নয়, বরং মুসলমানদের জন্য তা আবশ্যকও বটে।

ধার্মিকরা কেন রাজনীতিবিমুখ?

কিন্তু এমন পুণ্য ও আবশ্যকীয় কাজটি আজ আমাদের সমাজে নানা পাপাচার ও অনৈতিকতা চর্চার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। যার কারণে সমাজের ভালো মানুষরা, ইসলামের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততাকে সৌভাগ্য মনে করে থাকেন, তারাও এ থেকে দূরে থাকাকেই নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে করছেন। এমনকি রাজনীতিতে নিজের সম্পৃক্ততাকে ধার্মিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করছেন। প্রচলিত রাজনীতিতে ঠিক কী ধরনের চর্চার কারণে ইসলামের অনুসারী ধার্মিক মানুষরা রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. ঈমান বিধ্বংসী স্লোগান ও প্রতারণা চর্চা

রাজনীতিসংশ্লিষ্ট লোকদেরকে অহরহ বলতে শোনা যায়, ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’। যদিও তারা এ ধরনের বিশ্বাস বাস্তবে রাখেন না। একজন মুসলমান একমাত্র আল্লাহ পাককেই সব ক্ষমতার উৎস বিশ্বাস করেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যখন কোনো মুসলমান রাজনৈতিক মঞ্চে এমন কথা বলে বেড়ান যা তিনি বিশ্বাস করেন না, তখন তিনি ধরেই নেন যে, রাজনীতিতে মুখের কথা ও মনের বিশ্বাসের মাঝে মিল থাকা জরুরি নয়। ফলে তারা জনগণকে আরো আরো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেন এবং আল্লাহকে খুশি করার পরিবর্তে তারা এমন কাজেই নিজেদের ব্যস্ত রাখেন, যা জনগণকে দেখানো সম্ভব হয়। ফলে সমাজের ভেতরের সমস্যাগুলো সমস্যা হিসেবেই থেকে যায়, আর বাইরে শুধু শোডাউনের খেলা চলতে থাকে। এভাবে রাজনীতিতে প্রতারণার জায়গা দিন দিন বাড়তে থাকে। জনগণ প্রতারিত হতে থাকে মারাত্মকভাবে। অথচ রাসুল (সা.) স্পষ্ট বলেছেন, ‘যে অন্যকে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১৮৪)।

২. অন্যকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা

ইসলামে রাজনীতি মানে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আর এখনকার প্রচলিত রাজনীতি মানে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রভাব-প্রতিপত্তির শোডাউন দেওয়া। যার কারণে অন্যকে ঘায়েল করে নিজের পেশিশক্তি প্রদর্শনের নষ্ট প্রতিযোগিতা দেখা যায় রাজনীতিতে। আর এই শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতার কারণে অন্যকে যেকোনো মূল্যে দাবিয়ে রাখা, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করা, সামাজিকভাবে অপমান করা, নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাসহ অন্যকে ঘায়েল করার সর্বাত্মক চেষ্টা চলতে থাকে। অথচ ইসলামে এগুলো স্পষ্ট হারাম। গোনাহের কাজ। জাগতিক কোনো কারণে কাউকে অপমান করা বা ঘায়েল করে রাখার চেষ্টা করা ইসলামে জায়েজ নেই। আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমাদের কোনো দল যেন অন্য দলকে অপমান না করে, হতে পারে অপমানিত ব্যক্তি (আল্লাহর কাছে) অপমানকারীর চেয়ে উত্তম। এবং তোমাদের নারীদের কোনো দল যেন অন্য নারীদের অপমান না করে। হতে পারে অপমানিতরা অপমানকারিণীদের থেকে উত্তম। আর তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না। এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পর মানুষকে মন্দ নামে ডাকা কতই না নিকৃষ্ট কাজ। আর যারা (এসব করার পর) তওবা না করে তারা নিঃসন্দেহে জালিম।’ (সুরা হুজুরাত : ১১)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে ‘কোনো দলের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফের পথ থেকে সরে যেতে উদ্বুদ্ধ না করে।’ (সুরা মায়েদা : ৮)।

৩. বিরোধী পক্ষকে অপবাদ দেওয়া

প্রচলিত রাজনীতিতে অন্যের সবকিছুকেই মন্দভাবে উপস্থাপন করা হয়। বিরোধী পক্ষের ভালো কাজকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। তারা ভালো কিছু করলেও তার পেছনে খারাপ উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা হয়। নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে বিরোধী পক্ষের কাজের খারাপ উদ্দেশ্য মানুষের সামনে প্রকাশ করা হয়, যা সুস্পষ্ট অপবাদ। অন্যের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা এখনকার প্রচলিত রাজনীতির বেঁচে থাকার অন্যতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ অপবাদ জঘন্যতম কবিরা গোনাহ। আয়েশা (রা.)-এর ওপর আরোপিত অপবাদ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে বলেন, ‘যখন তোমরা তা মুখে-মুখে রটনা করছিলে এবং তোমাদের মুখে এমন সব কথা উচ্চারণ করছিলে যে ব্যাপারে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই। এবং তোমরা এটাকে হালকা মনে করছিলে। অথচ তা আল্লাহর কাছে জঘন্য অপরাধ।’ (সুরা নুর : ১৫)।

৪. মন্দকে ভালো বলা

প্রচলিত রাজনীতিতে নিজের দলের অবস্থান, মতাদর্শ ও সকল সিদ্ধান্তকে সবচেয়ে সঠিক ও উপযুক্ত মনে করা হয়। এটা মানুষের মধ্যে অন্ধ জাহিলিয়্যাতকে জাগিয়ে তোলে। আরবে ইসলাম আসার আগে ঠিক এই কাজটাই করা হতো। নিজ গোত্রের লোক ভুল করলেও তার পক্ষেই কথা বলতে হতো। অন্য গোত্র সঠিক পথে থাকলেও তা মুখে আনা যেত না। এখনকার প্রচলিত রাজনীতিতেও জাহিলিয়াতের সেসব ধ্যান-ধারণা ফিরে এসেছে। বিবেককে তালা লাগিয়ে মানুষ নিজ দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে। অথচ কোরআনে কারিমে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘তুমি ধারণা করো না, যারা নিজেদের কৃতকর্মের ওপর বড় খুশি, আর যে কাজ তারা করেনি তার জন্য প্রশংসা শুনতে আগ্রহী, এরূপ লোকদের সম্পর্কে কিছুতেই মনে করো না যে, তারা শাস্তি থেকে আত্মরক্ষায় সফল হবে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সুরা আলে ইমরান : ১৮৮)।

পাপপুণ্যের রাজনীতিতে নিজেকে পাপমুক্ত রাখাই একজন রাজনৈতিকের প্রকৃত সফলতা। মনে রাখার বিষয়, একজন মোমিন যখন যে কাজ করে সে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহর ভয়কে হৃদয়ে জাগ্রত রাখলে সে যা-ই করুক না কেন সে কখনো পাপে লিপ্ত হতে পারে না। আল্লাহর ভয়ে পাপে নির্লিপ্ততাই তাসাউফের অন্যতম শিক্ষা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত