ঢাকা ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪১৪)

আনন্দ বেদনার লুকোচুরির জীবন

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আনন্দ বেদনার লুকোচুরির জীবন

এক বাদশাহর এক ছেলে ছিল প্রখর বুদ্ধিমান। তার বাইরের গড়ন যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি স্বভাব আচরণও সুরভিত চন্দন। বাদশাহ তাকে নিয়ে স্বপ্ন রচেন, আমার ছেলে একদিন বিশাল রাজত্বের হাল ধরবে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। শান্তির পায়রারা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসবে দেশে। জনজীবনে সুখ ও আনন্দের বসন্তের সমারোহ হবে।

পরম সুখের সময়ে একদিন বাদশাহ স্বপ্নে দেখেন, তার প্রাণাধিক ছেলেটি মারা গেছে। মুহূর্তে আকাশটা যেন ভেঙে পড়ল বাদশাহ মাথার ওপর। সুখের দুনিয়া ছেয়ে গেল আঁখিধারায়। মনের আনন্দ রূপান্তরিত হলো শোকে দুঃখে, বিষাদের কালো মেঘে। গভীর বেদনায় শরীর তার চলনশক্তি রহিত নিথর। কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। অশ্রু শুকিয়ে চোখ দুটি নিশ্চল অপলক। সীমাহীন বেদনায় প্রাণ বেরিয়ে যায়। দেহ নিস্তেজ। এই বুঝি প্রাণটা উড়ে গেল, মিশে গেল বাতাসের গায়। কিন্তু মৃত্যুর জন্য যে দিনক্ষণ তা তখনো আসেনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার।

বাদশাহ দেখলেন, এতক্ষণ তিনি স্বপ্নে ছিলেন, দুঃস্বপ্ন। বাস্তবে রাজকুমারের বা কারো কিছু হয়নি। বাদশাহর মনে খুশির ঝিলিক খেলে গেল মুহূর্তে। আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে তার মনে উথাল পাতাল। মনে হয় আনন্দের আতিশয্যে তিনি মারা যাবেন। দেহের ওপর মনের অবস্থার এই প্রভাবের কারণ আছে। কারণ হলো, প্রাণ ও দেহ পরস্পর ভিন্ন, তবে খুব কাছের। দেহের কিছু হলে প্রাণের ওপর আঘাত আসে। প্রাণের দেশে কিছু ঘটলে দেহ প্রভাবিত হয় তাতে।

আয দমে গম মী বেমীরদ ইন চেরা’গ

ওয়ায দমে শাদী বেমীরদ ইনত লা’গ

দুঃখ বেদনার ফুৎকারে নিভে প্রাণের প্রদীপ

আনন্দের চোটেও নিভে প্রাণ, দারুণ জিনিস।

দুঃখ বেদনার প্রচণ্ডতায় প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়। আনন্দের আতিশয্যেও মানুষ বেসামাল হয়, মরে যাওয়ার অবস্থা দাঁড়ায়। বাদশাহ স্বপ্নে ছেলের মৃত্যু দেখে দুঃখ-দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন। ঘুম ভেঙে ছেলের কিছুই হয়নি, জেনে তার আনন্দ এখন ধরে না। তিনি আত্মহারা। হ্যাঁ, আনন্দ ও বেদনার লুকোচুরির মাঝেই এই জীবন। বাদশাহ মনে মনে বলেন, আল্লাহর মহিমা! তিনিই দুঃখ বেদনা দেন। সেই বেদনার মাঝে তিনিই পরম আনন্দ লুকিয়ে রাখেন। স্বপ্নে ছেলের মৃত্যু দেখে দুঃখের সীমা ছিল না; সেই দুঃখ থেকে সৃষ্ট আনন্দ এখন তর সয় না। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আনন্দ ও বেদনা আপেক্ষিক। নিরঙ্কুশ দুঃখ বা নিরঙ্কুশ সুখ বলতে কিছু নেই। হতে পারে একটা জিনিস এক হিসেবে মরণের উদ্দীপক। একই জিনিস অন্য হিসেবে জীবনের রক্ষক। যে জিনিস এক অবস্থায় ধ্বংসের কারণ, সে জিনিসই অন্য অবস্থায় জীবনের বাহন।

শাদীয়ে তন সূয়ে দুনিয়াবী কমা’ল

সূয়ে রূযে আ’কেবাত নক্স ও যওয়া’ল

দেহের আনন্দ দুনিয়াদারের দৃষ্টিতে জীবনের পূর্ণতা

সেই আনন্দে লুকায় পরকালের ক্ষতি ও ধ্বংসের বার্তা।

ভোগবাদীরা মনে করে, দেহের আনন্দ ফুর্তির মধ্যেই জীবনের সার্থকতা, পূর্ণতা। যারা পরিণামদর্শী, পরকালে বিশ্বাসী তারা বুঝতে পারেন, লাগামহীন ভোগ বিলাসিতায় নিহিত জীবনের ক্ষয় ও ধ্বংসের বার্তা। এই তত্ত্বটি বুঝার জন্য একটি উদাহরণ, কেউ স্বপ্ন দেখল, সে হাসছে। তার ব্যাখ্যা হবে তার জন্য কান্না অপেক্ষা করছে। আর যদি স্বপ্নে নিজে কাঁদতে দেখে, বুঝতে হবে তার হাসির উপলক্ষ্য সামনে আছে।

বাদশাহর মনে আনন্দের জোয়ার এলেও অজানা আশঙ্কায় মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। না জানি আমার ছেলের জীবনে কোনো দুর্বিপাক নেমে আসে কি না। তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, দুনিয়ার ফুলবনে পায়ে কাঁটা বিঁধলেও ভয় নেই, ফুল আমার হাতছাড়া না হওয়া চাই। এর জন্য একটা উপায় বের করতেই হবে। আমার ছেলে সুস্থ আছে। কিন্তু অসুস্থ হতে কতক্ষণ। মৃত্যুর জন্য তো একটি নয়, শতশত পথ খোলা। আমি কোন পথটি বন্ধ করব? মৃত্যু তো প্রতি মুহূর্তে মানুষের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে। এরপরও মানুষ মনে করে মৃত্যু শুধু অন্যের কাছে আসে। আমার ঘরে আসবে না সহজে। লোভাতুররা দুনিয়াকে নিয়ে এমন মত্ত যে, মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি তাদের কানে বাজে না।

যান হামে গুরহা’ দরিন খানে রাহ আস্ত

হার দো গামী পুর যে কাযদোমহা চাহ আস্ত

সব রোগ থেকে পথ তৈরি আছে এই বাড়ির দিকে

দুই পায়ের পদবিক্ষেপে আছে সাপ বিচ্ছুু ভর্তি কূপে।

তোমার দেহে যে রোগ শোকের আপদ নামে তা তোমার মৃত্যুর পদধ্বনি। তোমার দুশমনের শত্রুতায়ও আছে তোমার মৃত্যুর আগাম বাণী। এসব যেন মৃত্যুর পানে তোমার বাড়ির খোলা জানালা। ওহে প্রিয়জন! বেশি লেখাপড়ার দরকার তো নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দু’একটি তালিকা পড়লেই বুঝতে পারবে, কত অসুখ মানুষের জন্য ওঁতপেতে আছে। যে কোনো অসুখ মানুষের জন্য মৃত্যুর দুয়ার খুলে দিতে পারে। কাজেই অসুস্থতার কিংবা মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেয়ার আগেই তুমি আখেরাতের সঞ্চয় গড়। তোমার আমল চরিত্র স্বভাব শুধরে নাও। সুন্দর গুণাবলি, ব্যক্তিত্বের পূর্ণতায় নিজেকে সাজাও।

বাদশাহ মনে মনে বললেন। বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে প্রবল বেগে। আমার হাতে মাত্র একটি প্রদীপ। যদি হঠাৎ নিভে যায়। আঁধারে পথ চলা দায়। কাজেই আরেকটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে হবে। আমার ছেলের ঘরে যেন সন্তান আসে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার রাজপ্রাসাদে একটা বউমা চাই। দুর্বিপাকে একটি প্রদীপের ওপর যদি আপদ আসে অন্য প্রদীপ যেন জ্বলে উঠে। এই উপমার বাস্তব চিত্র সেই সাধক পুরুষ, যিনি দেহের জৈবিকতা দুর্বল করার সাধনা করেন। আর ভেতরে হৃদয়ের প্রদীপ জ্বালেন।

তা কে রূযী কীন বেমীরদ নাগহা’ন

শামএ দিল আফরোখত আয বাহরে ফরাগ

যাতে একদিন এই দেহ মরে গেলে অকস্মাৎ

দিলের প্রদীপ জ্বলে উঠে দূর হয়ে যায় মনস্তাপ।

যেদিন এই দেহের মরণ হবে, জীবন প্রদীপ নিভে যাবে, সেদিন যেন হৃদয়ের প্রদীপ জ্বলে ওঠে। ইঙ্গিতে এই যে কথাগুলো বলা হলো, বাদশাহ সেগুলোর মর্ম উপলব্ধি করতে পারলেন না। দেহের প্রদীপ নিভলে হৃদয়ের প্রদীপ জ্বালানোর তত্ত্বকথা তার হৃদয়ঙ্গম হলো না। তিনি তার অর্থ নিলেন পার্থিব। তাই শুধু একটি ক্ষয়িঞ্চু প্রদীপের বিয়োগে আরেকটি ক্ষয়িঞ্চু প্রদীপ জ্বালানোর চিন্তায় সীমাবদ্ধ রইলেন। রাজত্বের উত্তরাধিকার নিয়েই তিনি চিন্তিত।

গর রওদ সূয়ে ফনা ইন বা’য বা’য

ফারখে উ গর্দদ যে বা‘দে বা’য বা’য

যদি যায় বাজপাখি নির্বাণের দিকে মৃত্যুর কোলে

তার ছানা ডানা মেলবে পুনরায় বাজপাখি হয়ে।

কবিতায় দুই বা’য-এ শব্দের খেলা। একটির অর্থ বাজপাখি, আরেকটির অর্থ পুনরায়। উচ্চারণ বানান অভিন্ন। বাদশাহর সাহসী উচ্চারণ, বাজপাখি তুল্য আমার ছেলে জগৎ ছেড়ে গেলেও পুনরায় তার অস্তিত্ব বহাল থাকবে ছেলের মাধ্যমে। মানুষ মারে যায়; তবে সন্তানের সূত্রে পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব থেকে যায়। এই অর্থেই বলা হয়েছে-

‘সন্তান হলো পিতার গোপন রহস্যের স্মারক।’ এ কারণেই মানুষ আকুল প্রাণে জ্ঞান-বিদ্যা পেশা শিক্ষা দেয় সন্তানদের। আল্লাহতায়ালাই মাতাপিতার অন্তরে দয়ামায়া ঢেলে দিয়েছেন সহজাতভাবে। ফলে সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ করার সাধনায় প্রাণান্ত চেষ্টা চালায়। বাদশাহ মনে মনে বললেন, দুনিয়ার বুকে আমার বংশধারা, রাজত্বের পরম্পরা বজায় রাখতে হবে। কোনো ভালো নেককার লোকের মেয়ে আনব আমি বউমা বানিয়ে।

দোখতরী খা’হাম যে নসলে সা’লেহী

নায় যে নসলে পা’দশাহী কা’লেহী

এমন মেয়ে আনব নেককার বান্দার বংশ দেখে

রাজকন্যা, বাদশাহ দুলালি দরকার নাই অন্তপুরে।

কারণ আসল বাদশাহ কে? বাদশাহ তো সে ব্যক্তি, যে সবকিছু থেকে মুক্ত, স্বাধীনচিত্ত। যার মন যৌবন যৌনতার লোভাতুর, যার ধ্যানমন উদরপূর্তির কাছে বন্দি, সে কী করে বাদশাহ হয়। দুনিয়া পূজারীরাই এসব মূর্খ, দুনিয়া লোভীদের নাম দেয় নেতা কিংবা বাদশাহ। এ তো কালো কানা ছেলের নাম লালমিয়া পদ্মলোচনের মতো। যে লোক কামনা, ক্রোধ ও আকাশ কুসুম কল্পনার শিকলে বন্দি, মিছামিছি তাকেই আমির, বাদশাহ, নেতা আখ্যা দেয়া নিশ্চয়ই অন্যায়।

সদর খা’নান্দশ কে দর সফফে নেআল

জা’নে উ পস্ত আস্ত ইয়ানী জা’হ ও মা’ল

লোকেরা আমির নেতা বলে এমন লোকদের

বিত্ত-পদের শিকলে বন্দি হীনতুচ্ছ রূহ যাদের।

রাজকুমারকে নিয়ে বাদশাহর অভিপ্রায়ের কথা চাউর হয়ে অন্দর মহলে চলে গেল। রাণী ও সখিদের মাঝে আলোচনার ঝড় উঠল। কোন সে ভাগ্যবতী গুণবতীর পদচারণায় শাহি হেরেম মুখর হবে কেউ জানে না।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খ.০৪, বয়েত, ৩০৮৫-৩১২৮)।

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন। CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত