ঢাকা ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অতি কথায় নানান ক্ষতি

শাহাদাত হোসাইন
অতি কথায় নানান ক্ষতি

কথাবার্তা মানুষের যোগাযোগের বাহন। আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। যা মানুষকে অন্য সকল সৃষ্টিজীব থেকে আলাদা করেছে। আমরা যেসব নেয়ামত অপচয়ে অভ্যস্ত কথন-নেয়ামত তার অন্যতম। আমরা সর্বক্ষণ অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথাবার্তা আর বাকবিতণ্ডায় মজে থাকি। কথায় ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা পরিমাপিত হয়, আবার মূর্খতাও প্রকাশিত হয়। আল্লাহ আমাদের জবান ও ভাষা দিয়েছেন, মানব ও মানবতার কল্যাণ সাধনার্থে। যে কথায় কারো কোনো উপকার নেই, সে কথা না বলাই শ্রেয়। লোকমান (আ.) বলেছেন, চুপ থাকাই প্রজ্ঞা, তবে অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই তা মান্য করে (আল-জামে : ৫০৭)।

কথাবার্তা রবের বিশেষ দান : কথাবার্তার শক্তি বান্দার প্রতি মহান রবের বিশেষ দান। আল্লাহ স্বীয় কৃপাগুণে মানুষকে কথাবার্তা শিক্ষা দিয়েছেন। সুরা আর-রহমানে আল্লাহ বলেছেন, তিনিই মানুষকে ভাষা-শৈলী শিখিয়েছেন (৪)। জিহ্বা তাঁরই দান। আল্লাহ বলেন, আমি কি তাকে (মানুষকে) দেইনি চক্ষুদ্বয়, জিহ্বা ও ওষ্ঠদ্বয় (সুরা বালাদ : ৯-১০)? মানুষের কর্তব্য হলো, আল্লাহর দেয়া এই নেয়ামতের ব্যবহারে তার বিধি-নিষেধের প্রতি খেয়াল রাখা। যে কথা বৈধ, যে কথা উপকারী তা বলা নয়তো চুপ থাকা। একজন ব্যক্তি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার জন্য কোনো জিনিসকে অধিক ভয়ানক বলে মনে করেন? তখন তিনি হাত দ্বারা স্বীয় জিহ্ববা ধরলেন (আল-জামে : ৪১২)। এর দ্বারা নবীজি বুঝিয়েছেন, কথা মানুষের জন্য বড্ড ভয়ানক। তাই, কথাবার্তায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।

জিহ্বার হেফাজতকারী সর্বোত্তম মুসলিম : মূর্খ কিংবা শিক্ষিত দুনিয়ার কোনো ব্যক্তিই বাচালকে পছন্দ করে না। আল্লাহতায়ালাও তাকে পছন্দ করেন না। বাচাল ব্যক্তি তার অযাচিত কথার দ্বারা অন্যকে আঘাত পৌঁছায়। হজরত আলি (রা.) বলেছেন, কথার আঘাত তরবারির আঘাতের চেয়েও অধিক কষ্টদায়ক। নবীজি বলেছেন, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে (কথার) অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে (মুসলিম : ১০)। আমাদের সমাজে এমন লোকের সংখ্যা গৌণ নয়, যাদের প্রত্যেকটি কথা অন্যকে কষ্ট দেয়, আঘাত করে। তাদের উচিত নবীজির উপরোক্ত বাণীটি গভীরভাবে অনুধাবন করা এবং উত্তম মুসলিম হওয়ার প্রাক্টিস করা।

বচন-দোষে ধ্বংস আনে : মধ্যমপন্থা সব ক্ষেত্রেই উপকারী। বারাবারি কোনো ক্ষেত্রেই কাম্য নয়। অতিরিক্ত কথা ব্যক্তিকে সমস্যা ও বিপদে ফেলে। নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যকেও কষ্টে নিপতীত করে। অতিরিক্ত কথা ব্যক্তিকে লজ্জার মুখোমুখি করে। হজরত দাউদ (আ.) বলেছেন, কথার কারণে আনেক সময় লজ্জিত হয়েছি, কিন্তু চুপ থাকার কারণে কখনো লজ্জিত হইনি (আল-জামে : ৪১৮)। অতিরিক্ত কথা দুনিয়া ও আখেরাত বিনষ্টের কারণ। নিম্নে তার বিবরণ তুলে ধরা হলো।

মানুষের প্রতিটি কথা আমল : আমাদের জীবনের প্রতিটি কথা একেকটি আমল। যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব কেয়ামতে আল্লাহর দরবারে দিতে হবে। অতএব, কথা বলার আগে একটু হলেও ভাবা উচিত এবং নিয়ন্ত্রিত কথা বলা উচিত। অনিয়ন্ত্রিত কথার কারণে দুনিয়াতে যেমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আখেরাতেও এর জবাবদিহি করতে হবে। দুনিয়াতে পার পেলেও আখেরাতে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজ কথাবার্তাকে আমল এবং চরিত্রকে দ্বীন হিসাবে দেখে না। সে নিজের অজান্তেই ধ্বংস হয়ে যায় (আল-জামে ১:৬১)। বস্তুত যে ব্যক্তি কথাকে আমল মনে করে, নিশ্চয়ই সে অল্প কথা বলে। (আয-যুহুদ:৩৮৩)।

কথায় জান্নাত কথায় জাহান্নাম : গ্রামীণ প্রবাদে আছে- কথায় ভাত কাপড় আর কথায় চড়-থাপড়। কথার ভিত্তিতে মানুষের জান্নাত হবে, কথার ভিত্তিতে হবে জাহান্নাম। যে কথায় সৃষ্টি জীবের উপকার হয়, সে কথায় আল্লাহ খুশি হয়। আর যে কথায় ক্ষতি হয়, তাতে আল্লাহ রাগান্বিত হন। কোরআনে এসেছে, তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শ (কথাবার্তা) ভালো নয়; কিন্তু যে কথাবার্তা দান-খয়রাত, সৎকাজ কিংবা মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাাপনের জন্য হয় তা ভিন্ন। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এমনটা করে, আমি তাকে বিরাট সাওয়াব দান করব (সুরা নিসা : ১১৪)। নবীজি বলেছেন, অনেক কথার কারণে আল্লাহ বান্দার সম্মান বৃদ্ধি করে এবং জান্নাত দেন এবং অনেক কথার কারণে বান্দাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়। (আল-জামে : ৪০৭)।

অধিক কথায় ফেতনা : কথার আধিক্য ব্যক্তিকে বিভিন্ন ফেতনা ও বিপদের সম্মুখীন করে। নিত্য-নতুন সমস্যায় জর্জরিত করে। ইয়াজিদ ইবনে হাবিব (রহ.) বলেন, অধিক বাগ্মিতা ব্যক্তিকে ফেতনায় আক্রান্ত করে আর নীরব ও নিস্তব্ধতা ব্যক্তিকে রহমতের উপযুক্ত করে। (আল-জামে : ৪৩৯)। ফেতনাবিমুখ ব্যক্তি মাত্রই অধিক-কথন পরিহারকারী। জিহ্বার হেফাজতকারী সম্পর্কে নবীজি বলেছেন, আল্লাহ যাকে দু’টি জিনিসের খারাপি থেকে রক্ষা করবেন তাকে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। জিহ্বা (কথাবার্তা) এবং লজ্জাস্থানের খারাপি (বোখারি : ৬৪৭৪)।

বেশি কথায় বেশি ভুল : ইবনে ওয়াহাব (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তির কথা বেশি তার ভুলও বেশি (আল-জামে : ৪৯৫)। প্রকৃতপক্ষে ত্রুটিমুক্ত কথা বলতে অধিক জ্ঞানের প্রয়োজন। আর যখন কোনো ব্যক্তি প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হয়, তখন তার কথা কমে যায়। বনি ইসরাঈলের একজন তাপস বলেছেন, নারীর সৌন্দর্য লজ্জায় আর জ্ঞানীর সৌন্দর্য অল্প কথায় (আয-যুহুদ : ৩৮৩)। অধিক ভুল থেকে রক্ষা পেতে অনর্থক কথা পরিহার করার বিকল্প নেই।

নীরবতায় নিরাপত্তা : ভুল ও লজ্জা হতে রক্ষা পেতে নীরবতার জুড়ি নেই। বাচাল ব্যক্তি অনর্থক ও অযৌক্তিক কথা বেশি বলে। যার কারণে ভুলের পরিমাণ অধিক হয়। আর ভুল ব্যক্তিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি নিরাপদ থাকতে পছন্দ করে, সে যেন চুপ থাকাকে আবশ্যকীয়ভাবে অবলম্বন করে (আত-তারগিব৪ : ২৬)। একবার সাহাবি আবু জার (রা.) কে নবীজি বললেন, আমি তোমাকে এমন দু’টি স্বভাবের কথা জানিয়ে দেব? যা প্রকাশত সহজ তবে মিজানে ভারী। তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবীজি বলেন, সুন্দর ব্যবহার এবং চুপ থাকা (আয-যুহুদ : ৩৮৪)। আর মিযানে যার নেকির পাল্লা ভারী হবে, সেই নিরাপদ থাকবে আজাব হতে।

সফলতার পূর্বশর্ত : একাল, পরকাল উভয় জগতে সফলতা পাওয়ার পূর্বশর্ত অনর্থক কথা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা থেকে দূরে থাকা। অপকারী কথা পরিহার করা। সুরা মুমিনুনে সফলকাম মোমেনের গুণাবলির বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, যারা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে (৩)। নবীজি বলেছেন, অনর্থক কথা-কাজ পরিহার করাই মুসলিম ব্যক্তির সৌন্দর্য (তিরমিজি : ২৩১৭)।

যে কথা বলা উচিত : অনর্থক কথাবার্তায় সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। তবে সত্য কথায় চুপ থাকা অনুচিত। সাহাবি আবু জার (রা.) বলেছেন, সত্য কথায় চুপ থাকার থেকে বলা উত্তম। আর অনর্থক কথা বলার থেকে চুপ থাকা উত্তম (আল-জামে : ৪৫৭)। আমাদের সমাজের চিত্র হাদিসের বর্ণনার স¤পূর্ণ বিপরীত! আমাদের সত্য কথা গলায় আটকে যায়। ভয়ে ভীতু হয়ে যাই। অনর্থক কথায় বিচলিত হই না। বিরতিহীন বলতে পারি বিনা ভাবনায়। এক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা উচিত। নবীজি বলেছেন, নিশ্চয়ই কথকের জিহ্বার পাশে আল্লাহর অবস্থান। অতএব, কথাবার্তার ক্ষেত্রে মানুষ যেন আল্লাহকে ভয় করে। (আল-জামে লি-ইবনে ওয়াহাব : ৪৫০)।

আত্মবিচার আবশ্যক : কথা বলার আগে একটু ভাবুন, যে কথা বলতে যাচ্ছেন তার প্রয়োজন আদৌ আছে কি? প্রয়োজনীয় হলে বলুন, নয়ত চুপ থাকুন। মুক্তি লাভ করুণ। কথা বলাকে হিংস্র প্রাণীর থেকেও অধিক ভয় করা উচিত। হিংস্র প্রাণী শুধু দুনিয়ার ক্ষতি করে কিন্তু কথায় দুনিয়া আখেরাত সবই ধ্বংস হয়। নবীজি বলেছেন, যে চুপ থাকে সে মুক্তি পায় (তিরমিজি : ২৫০১)। মুক্তি পেতে চুপ থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

লেখক : খতিব-বায়তুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত