ঢাকা ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪১৫)

জাদুগ্রস্ত ছেলের জন্য বাদশাহর কান্না

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
জাদুগ্রস্ত ছেলের জন্য বাদশাহর কান্না

বাদশাহ ঠিক করলেন, দরবেশ প্রকৃতির একজন লোকের মেয়ে আনবেন পুত্রবধূরূপে। বিপত্তি ঘটল রানির আপত্তির কারণে। রানির যুক্তি, বিয়েতে কুফু চাই, বর কনের মাঝে সমমান সমকক্ষতা স্বীকৃত শর্ত। প্রস্তাব শুনে অগ্নিশর্মা রানি বাদশাহকে একহাত নিলেন। পাইছেন কী? এত কৃপণতা, মনের সংকীর্ণতা আর সহ্য হয় না। আমার ছেলের গলায় কোত্থেকে কোন ফকিরনীর মেয়ে ঝুলিয়ে দিবেন, তা হবে না। বিয়েতে টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে না, এই জন্য এমন চালাকি। ওসব কৃপণতা ছাড়েন। আমি মা, আমি মানব না। কথাবর্তার ধার ছেলের বাপের চেয়েও বেশি। বাদশাহ বুঝিয়ে বললেন, কোনো নেককার লোকের মেয়েকে ফকিরনীর মেয়ে বলা ঠিক হচ্ছে না। হতে পারে গরিব। কিন্তু এই সংসারে যারা আল্লাহর দানে রাজি, তারা তো মনের দিক থেকে ধনী। কিতাবে আছে ‘মনের দিক দিয়ে ধনী হওয়াই প্রকৃত ধনী।’ তিনি তো তাকওয়ার কারণে অল্পেতুষ্টির দরিদ্র জীবন বেছে নিয়েছেন। অলসতা, ভোগ ও লোভের কারণে দরিদ্র সেজেছেন এমন নন। কাজেই আল্লাহর এমন

নেক বান্দার প্রতি তাচ্ছিল্য দেখানো অন্যায়।

কিল্লতি কান আয কানাআত ওয়ায তুকাস্ত

আন যে ফকরো কিল্লতে দুনা’ন জুদাস্ত

যে দারিদ্র্যের উৎপত্তি অল্পেতুষ্টি ও তাকওয়া হতে

আলাদা তা হীন লোকদের দারিদ্র্য অল্পেতুষ্টি থেকে।

ভিক্ষুক যদি দেখে, পথের মাঝে কিছু একটা পড়ে আছে, অমনি মাথা নিচু করে তুলে নেবে। অথচ আল্লাহর নেক বান্দা কোথাও স্বর্ণের থলি পড়ে আছে দেখলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। আবার যদি কোনো বাদশাহ লোভের বশে হারাম কাজে জড়িয়ে পড়ে, আল্লাহর নেক বান্দারা সেই নেতা, বাদশাহকে ভিক্ষুক হিসেবে জানে। বাদশাহর এসব নীতিবাক্য কিন্তু রানির মর্মে পৌঁছল না। কারণ তার মাথায় অন্যকিছু ঘুরপাক খায়। বাদশাহর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রানি বলেন, বলুন, আমার ছেলেকে যৌতুক হিসেবে দেয়ার শহর, কিল্লা, অঢেল সম্পদ কই? বউ সাজানোর স্বর্ণ মণি-রত্ন কী কী দেবে বলুন আমাকে? বাদশাহ একটু কঠোর হলেন।

গোফত রও হারকে গমে দীন বরগুযীদ

বাকীয়ে গমহা খোদা আয ওয়েই বুরীদ

বললেন, থামো। দীনের চিন্তামগ্নতা যার মাথায় ঢুকেছে

দুনিয়ার দুশ্চিন্তা আল্লাহ, দূর করে দিয়েছেন তার মন থেকে।

বাদশাহ রানিকে বললেন, তোমার এসব প্যাঁচাল ছাড়। তুমি তো শুধু সোনাদান, বালাখানা নিয়ে মত্ত। জান, আল্লাহর দুনিয়ায় কত বিচিত্র মানুষ আছেন? যারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা ছেড়ে আল্লাহর কাজে, দ্বীন নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে, স্বয়ং আল্লাহ দুনিয়ার বাদ বাকি চিন্তা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। আমাদের হবু বেয়াই এমনই একজন নেক বান্দা। হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি তার সকল চিন্তাভাবনাকে একটি মাত্র চিন্তায় রূপান্তরিত করেছে, আল্লাহ তার যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে একটিমাত্র চিন্তায় রূপান্তরিত করেন। আর যার মাথা দুনিয়ার বিচিত্র চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকে, সে দুনিয়ার কোনো প্রান্তে গিয়ে প্রাণ দিল তাতে আল্লাহর কিছু যায় আসে না।’

নরমে গরমে যুক্তির জোরে শেষ পর্যন্ত বাদশাহ বিজয়ী হলেন। একটি ভদ্র, দ্বীনদার, গরিব খান্দানি বংশের মেয়ে তুলে আনলেন রাজপ্রাসাদে। এই মেয়ে তো মেয়ে নয়, স্বর্ণের টুকরো, অমূল্য মণিরত্ন। তার রূপের বিভায় রাজপ্রসাদ আলোকিত। চেহারা যেন সকাল বেলার উদীয়মান সূর্য। এতো গেল তার বাহ্যিক রূপ। তার ভেতরের রূপ গুণ ও স্বভাব আচরণের বর্ণনা দিতে তো ভাষা অক্ষম। এই মেয়ের চরিত্রে দ্বীনদারির ঐশ্বর্য ছড়ানো। তাই তো ভেতর বাইরের সব রূপ-ঐশ্বর্য তার ওপর ভর করেছে। ইমাম জাফর সাদেকের একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে তার রূপ ও সম্পদের কারণে বিয়ে করে, সে নারীর রূপমাধুরী ও সম্পদ থেকে সে বঞ্চিত হবে। আর যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে, তার দ্বীনদারির কারণে, আল্লাহতায়ালা সেই নারীর রূপসুধা ও সম্পদ উভয় দ্বারা তাকে লাভবান করবেন।’ (আল মুহাজ্জাতুল বায়দা, ৩খ. পৃ. ৮৫ এর বরাতে করিম যামানি ৪খ. পৃ. ৮৮৫)।

কারো চরিত্রে দ্বীনদারির গুরুত্ব বুঝার জন্য একটি প্রবাদের উপমা দিয়ে মওলানা রুমি বলেন, তুমি ঘোড়ার মালিক হও, পশমের মালিক নয়। ঘোড়ার মালিক হলে, ঘোড়ার পশম, চামড়া, দুধ সবকিছু তোমার এখতেয়ারে চলে আসবে। আর যদি শুধু পশম লাভ করো, তাহলে ঘোড়া তোমার ভাগ্যে জুটবে না। অনুরূপ যদি আখেরাতকে লাভ করতে পার, তোমার প্রয়োজন অনুপাতে দুনিয়া তোমার কাছে এমনিতে আসবে। আর যদি শুধু দুনিয়ার ধান্ধায় থাক, আখেরাত তো হারাবেই; আমও যাবে, ছালাও যাবে। একুল ওকুল দুকুল হারিয়ে নিঃস্ব হবে। বাদশাহ আল্লাহর নেক বান্দার অপরূপ সুন্দরী মেয়েটি রাজপ্রাসাদে তোলার পর দেখা দিল আরেক বিপত্তি। ভাগ্যের ফেরে এক কুটনী বুড়ি যুবরাজের প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। ৯০ বছর বয়সের এই বুড়ি জাদুমন্ত্রে ছিল ডাইনির মতো। দেখতে না দেখতে যুবরাজও আসক্ত হয়ে পড়ল এই বুড়ির প্রেমে। কারণ, কাবুলি ওয়ালী ডাইনি বুড়ি জাদুমন্ত্র চালিয়ে ডাকাত হয়ে যুবরাজের জ্ঞানবুদ্ধি হরণ করে নিল। শাহজাদা এখন বাকশক্তি হারিয়ে শুধু বুড়ির পেছনে ঘোরে। একটি বছর বুড়ির সঙ্গে কাটিয়ে শাহজাদার শরীর মন ভেঙে হাহাকার। মানুষ দেখে মায়া করে, হায় এমন টগবগে তরুণ জাদুর প্রভাবে এমন দুর্দশায় পড়েছে। এমন চলনশক্তিহীন কীভাবে হতে পারে? এদিকে বাদশাহর অবস্থা-

ইন জাহা’ন বর শাহ চোন জিন্দা’ন শুদে

ওয়ীন পেসর বর গেরয়েশা’ন খন্দা’ন শুদে

এই জগৎ বাদশাহর কাছে যেন জিন্দানখানা

শাহজাদা হাসে দেখে তাদের অসহায় কান্না।

দুনিয়া এত প্রশস্ত, বাদশাহর এত বিশাল রাজত্ব যেন তার জন্য কারাগারে পরিণত হলো। চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখে। বিশাল রাজত্বের ভবিষ্যৎ সম্রাট আমার ছেলের কী হলো। বাদশাহকে দেখে আত্মীয়স্বজনও কেঁদে যারযার হয় যুবরাজের দুর্দশায়। কিন্তু শাহজাদা পিতা ও আত্মীয়স্বজনের কান্না দেখে হাসে। বাদশাহ সম্পূর্ণ অসহায়। কী উপায়। দিশকুল পায় না ছেলের বিপদমুক্তির কথা ভেবে। রাত-দিন কোরবানি দেয়, দান-সদকার দুয়ার খুলে আকাতরে সম্পদ বিলায়। কিন্তু অবস্থা হলো, বাদশাহ যত উপায়ে বিপদ কাটানোর চেষ্টা করেন, ছেলে যেন বুড়ির প্রেমে আরো বেসামাল হয়। শেষ পর্যন্ত-

পস ইয়াকীন গশতশ কে মুতলক আন সিরিস্ত

চারা উ রা বা-দ আযীন লা’বে গরীস্ত

নিশ্চিত হলেন, কোনো রহস্য নিশ্চয় লুকিয়ে আছে

একমাত্র উপায় হলো, কান্না আর কান্না এখন থেকে।

বাদশাহ রাত-দিন চিন্তার পর নিশ্চিত হলেন যে, আমার ছেলের এই বিপদ কোনো স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নয়, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটি পথই খোলা আছে। তা হলো আল্লাহর দরবারে রোনাজারি, কান্না ও প্রার্থনা। মওলানা রুমি বলেন, যখন চেষ্টা তদবিরের ঘোড়ায় চড়ে কোনো সমস্যার সমাধান ও বিপদ কাটানোর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন সেই ঘোড়া ছেড়ে উড়াল দিতে হবে দোয়ার বোরাক হাঁকিয়ে। এ জন্যই বলা হয়েছে : ‘যখন স্বাভাবিক উপায় উপকরণ ছিন্ন হয়ে যাবে, তখন নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো দোয়া।’

বিভিন্ন রেওয়ায়াতের ভাষায় তকদিরের ফয়সালাকেও ফিরিয়ে দেয়ার শক্তি রাখে দোয়া। আমিরুল মোমেনিন আলি (রা.)-এর ভাষায়- ‘আদ্দোয়াউ তুরসুল মু‘মিন’ ‘দোয়া হলো মুমিনের ঢাল।’ (আল মুহাজ্জাতুল বায়দা, ২খ. পৃ. ২৮৩-এর বরাতে করিম যামানি ৪খ. পৃ. ৮৮৯)।

অর্থাৎ দোয়া তকদিরের ফায়সালায় নির্ধারিত বালা-মুসিবতের তীর বল্লম ফিরিয়ে দিতে পারে। ইমাম মুহাম্মদ গাযযালির ভাষায় তোমার এমন অজুহাত খাড়া করা উচিত নয় যে, বালা-মুসিবত যখন তকদিরে লেখাই আছে, আমি দোয়া করে লাভ কী?’ কারণ, তকদিরের ফায়সালার কথা যেমন লেখা আছে, দোয়ার মাধ্যমে তা কেটে যাওয়ার কথাও তকদিরেই লেখা আছে। আগেকার দিনে যুদ্ধের ময়দানে একহাতে তলোয়ার থাকত, আরেক হাতে ঢাল। শত্রুপক্ষের ছোঁড়া তীর বল্লম প্রতিহত করা হত বাম হাতের ঢাল দিয়ে আর শত্রুর উপর আক্রমণ চালানো হত- ডান হাতের তলোয়ার দিয়ে। অস্তিত্ব জগতেও বালা-মুসিবতের একের পর এক তীর তোমার দিকে উড়ন্ত অবস্থায় ধেয়ে আসছে। সেই তীর প্রতিহত করার সম্বল তোমার দোয়ার ঢাল। হাকিকতের ইলম অবগত হওয়ার পর বাদশাহর অবস্থা হলো-

সাজদা মী কর্দ উ কে ফরমানত রওয়াস্ত

গাইরে হক বর মুলকে হক ফরমান কে রাস্ত

সিজদা করছিল, বলছিল আদেশ একমাত্র তোমার

আল্লাহর রাজত্বে আল্লাহর শাসন ছাড়া, ক্ষমতা কার।

বাদশাহ সেজদার পর সেজদা করেন, নামাযে বিনয়ে সেজদায় লুটে আর্তি জানান। বুকফাটা কান্নায় আহজারিতে বলেন, ওহে আদেশ দানের ক্ষমতা যে একমাত্র তোমারই। তোমারই রাজত্ব এই বিশ্বচরাচরে। এখানে তোমার হুকুমের বাইরে হুকম চালানোর সাধ্য কার আছে?

লে কে ইন মিসকীন হামী সূযদ চো ঊদ

দস্ত গীরশ আই রহীম ও আই ওয়দূদ

কিন্তু এই অসহায় কাঁদে চন্দনসম জ্বলে ধূমায়িত হৃদয়

হে দয়াময়, প্রেমময় হাত ধর উদ্ধার কর, বড় অসহায়।

বাদশাহর দোয়া কবুল হলো, সুসংবাদ এলো। জাদুমন্ত্র তছনছ করার ব্যবস্থা হলো। কান্নার এমনই ফল।

তা যে ইয়া রব ইয়া রব ও আফগা’নে শাহ

সাহেরী ঊস্তাদ পীশ আ’মদ যে রা’হ

বাদশাহর ইয়া রব ইয়া রব কান্নার আওয়াজে শেষে

এলো এক জাদুকর দক্ষ উস্তাদ বাদশাহর কাছে।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩১২৯-৩১৫৯)।

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন।

CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত