ঢাকা ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবন হোক নামাজময়

হুমায়ুন কবীর
জীবন হোক নামাজময়

মোমেন নরনারীর জন্য দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে ১৭ রাকাত নামাজ পড়া ফরজ। তিন রাকাত ওয়াজিব এবং ১২ রাকাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এই ৩২ রাকাত নামাজ আমরা প্রতিদিনই পড়ি। এগুলো আমাদের জন্য নির্ধারিত। এছাড়া কিছু নামাজ আমরা পড়ি, যেগুলোকে নফল বলি। এই নফল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য হাসিল করা যায়। ফরজের ঘাটতি পূরণ হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের আমলের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। আল্লাহতায়ালা জানা থাকা সত্ত্বেও ফেরেশতাদের জিজ্ঞাসা করবেন, দেখো সে পূর্ণ নামাজ আদায় করেছে না তাতে ত্রুটি আছে? পূর্ণ হলে পূর্ণ লেখা হবে। আর ত্রুটি থাকলে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের বলবেন- দেখো, আমার বান্দার কোনো নফল আছে কি না? থাকলে তিনি সেটা দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূর্ণ করতে বলবেন। এভাবে ফরজের ঘাটতি নফল দ্বারা পূর্ণ করা হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৮৬৪)। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারলাম, আমাদের ফরজ নামাজের মধ্যে যদি ত্রুটি থাকে, তাহলে নফল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা সেটা পূর্ণ করে দেবেন। নফল সাধারণভাবে দুই প্রকার। প্রথমত যেগুলো কোনো সময় বা অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু তখনই ওই নফলগুলো পড়া যায়। অন্য সময় পড়া যায় না। যেমন তাহাজ্জুদ, ইশরাক ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত যেগুলো কোনো সময় বা আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। যেকোনো সময় চাইলেই পড়া যায়। আমরা এখানে শুধু প্রথম প্রকার নফল নিয়ে আলোচনা করব। দ্বিতীয় প্রকারের নফল নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু সেগুলো, যখন ইচ্ছা তখনই পড়া যায়।

তাহাজ্জুদ নামাজ : আল্লাহতায়ালার যে বান্দা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে, আল্লাহ তাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি তার প্রিয় বান্দাদের গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন কোরআন মাজিদে। ‘রাতের সামান্য অংশই তারা ঘুমিয়ে অতিবাহিত করত। রাতের শেষ প্রহরে তারা ইস্তেগফারে মগ্ন থাকত।’ (সুরা যারিয়াত : ১৭, ১৮)।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো তাহাজ্জুদ ছাড়তেন না। ফরজ নামাজের পরে তিনি সবচেয়ে বেশি তাহাজ্জুদের গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো গভীর রাতের নামাজ।’ (মুসলিম : ১১৬৩)। বাসায় অবস্থান করলে তিনি তো তাহাজ্জুদ পড়তেনই, এমনকি সফরে গেলে, জিহাদে গেলেও তিনি তাহাজ্জুদ ছাড়তেন না। (মুসলিম : ১৮০৮)। এজন্য আমরা চেষ্টা করব শেষ রাতে, ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার সামান্য আগে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার।

ইশরাক নামাজ : ফজরের ওয়াক্ত শেষ হলে নামাজের নিষিদ্ধ ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। সেটা থাকে ২০ মিনিটের মতো। এরপর ইশরাকের ওয়াক্ত হয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ইশরাকের নামাজ পড়ে, তার সারাদিনের সব প্রয়োজনের জন্য আল্লাহতায়ালা যথেষ্ট হয়ে যান।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ১০০৯)। তিনি আরো বলেছেন, ‘যে ফজরের নামাজ জামাতে পড়ে, এরপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহর জিকির করে, এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে; তার জন্য একটি হজ ও একটি ওমরার সাওয়াব রয়েছে। নবীজি তিনবার বলেছেন, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ।’ (সুনানে তিরমিজি : ৫৮৫)।

আওয়াবিন নামাজ : মাগরিবের ফরজ ও সুন্নাত শেষ হওয়ার পরে হাদিসে এক ধরনের নামাজের কথা বর্ণিত আছে। হাদিসে সে নামাজের নাম এসেছে আওয়াবিন। ৬ রাকাত থেকে ২০ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায় এ নামাজ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়ে, যার মধ্যে কোনো মন্দ কথা বলে না, তাহলে সে ১২ বছর ইবাদতের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। (তিরমিজি : ৪৩৫)। হজরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আরেক হাদিসে এসেছে, ‘নিশ্চয় ফেরেশতারা ওই লোকদের ঘিরে রাখেন, যারা মাগরিব ও এশার মাঝখানে নামাজ পড়ে। আর এটা হলো সালাতুল আওয়াবিন।’ (শরহুস সুন্নাহ লিলবাগাবি : ৮৯৭)।

আমরা উপরে তিন প্রকার নামাজের কথা বলেছি, যেগুলো বিশেষ সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন আরো তিন প্রকার নামাজের কথা বলব, যেগুলো বিশেষ অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

তাওবার নামাজ : কারো থেকে কোনো গুনাহের কাজ হয়ে গেলে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তাওবার নামাজ পড়তে উৎসাহিত করতেন। স্বাভাবিক নিয়মে দুই রাকাত নামাজ পড়বে, এরপর আল্লাহতায়ালার কাছে তাওবা ইস্তেগফার করবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘গোনাহ হয়ে যাওয়ার পরে কোনো মুসলমান যদি অজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়ে, এরপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তাকে মাফ করে দিবেন।’ (সুনানে তিরমিজি : ৪০৬)।

সালাতুল হাজত : হাদিসে এই নামাজের নাম এসেছে সালাতুল হাজাত। হাজাত শব্দের অর্থ প্রয়োজন। অর্থাৎ বিশেষ প্রয়োজনের সময় এই নামাজ পড়তে হয়। এটা শুধু আমাদের নবীর সুন্নাত নয়, সব নবীগণ প্রয়োজনের সময় এই নামাজ পড়তেন। কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘নবীগণ বিচলিত হলে নামাজের আশ্রয় গ্রহণ করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৮৯৩৭)। তিনিও এমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো বিষয় নবীজিকে বিচলিত করলে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১৩১৯)। নবীগণ পড়তেন, তিনি পড়েছেন; সঙ্গে সঙ্গে উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন এই নামাজ পড়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সে যেন ভালোভাবে অজু করে এবং পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে অন্যান্য নামাজের মতো দুই রাকাত নামাজ আদায় করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩৮৫)। জীবনে চলার পথে আমাদের কতো প্রয়োজন, কতো সমস্যা; আমরাও সালাতুল হাজাতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি। সালাতুল হাজত নামাজ পড়ার পর বিশেষ একটি দোয়া পড়ার কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সেই দোয়াটি পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করলে আল্লাহ হাজতগ্রস্ত ব্যক্তির হাজত পূরণ করে দেন।

ইস্তিখারার নামাজ : কেউ যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সিদ্ধান্ত নিবে, তখন সে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এটা হাদিসের শিক্ষা। নবীজি সাহাবাগণকে কোরআনের মতো করে এই নামাজ শিক্ষা দিতেন। হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের এমনভাবে ইস্তিখারার নামাজ শেখাতেন, যেভাবে কোরআন শিখাতেন। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ইচ্ছে করে, সে যেন দুই রাকাত নামাজ পড়ে।’ (বোখারি : ৬৩৮২)। আমরা সর্বমোট ছয় প্রকার নফল নামাজের আলোচনা করেছি। এছাড়া আরো অনেক নফল নামাজ রয়েছে। সেগুলোও বিশেষ সময় বা অবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা অনেক কারণে সময় থাকার পরেও নফল নামাজ পড়ি না। তার একটা কারণ হলো, আমরা মনে করি, একদিন তাহাজ্জুদ পড়লে মনে হয় সারাবছর পড়তে হবে। বিষয়টা এমন নয়। আপনি একদিন সময় পেলে একদিনই পড়ুন। যেদিন যেমন সময় আপনার হাতে আছে, সেদিন তেমন নফল পড়ুন। তবে সারাবছর, সারাজীবন পড়লে তার সাওয়াব তো আছেই। আমরা যেন বেশি বেশি নফল ইবাদত করতে পারি, নফলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে পারি; আল্লাহতায়ালা আমাদের সেই তৌফিক দান করুন।

লেখক : ফাজেল, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া,

আরজাবাদ মাদ্রাসা, দারুস সালাম, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত