ঢাকা ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪/১৯৫)

রহমতের পরশ লাভের চেষ্টা করো

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
রহমতের পরশ লাভের চেষ্টা করো

আল্লাহর অফুরান দয়া ও রহমত বিরাজিত সৃষ্টির সর্বত্র মিশরের নীলনদের স্বচ্ছ সলিলের মতো। কিন্তু যখন আমাদের মাথায় ফেরাউনী দেমাগ ভর করে, যখন নফসে আম্মারার তাঁবেদার হয়ে যাই, স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেই, তখন রহমতের সেই ঝর্ণাধারা গাঢ় কালো রক্তে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কোরআন মজীদে সূরা আরাফের ১৩৩ নং আয়াতের তাফসিরে মুফাসসিররা বলেন, আল্লাহতায়ালা হযরত মূসা (আ.)-কে যেসব অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন তার একটি ছিল, ফেরাউনের স্বজাতি কিবতীদের জন্য নীল নদের পানি রক্তে পরিণত হওয়া। ফেরাউনের স্বগোত্রের নাম ছিল কিবতী। এরা ছিল মিশরের শাসকগোষ্ঠী। শাসিত শ্রেণি ছিল মূসা (আ.)-এর স্বজাতি বনী ইসরাঈল। তাদের আরেক নাম ছিল সিবতী।

নীলনদের পানি রক্তে পরিণত হওয়ায় কিবতীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এক কিবতী একদিন পরিচিত এক সিবতীর কাছে এসে বলে : আমি তোমার পরিচিত বন্ধুজন। এসেছি কারণ, তোমার বাসায় নীলনদের পানি আসে সুপেয়। সেই পানি আমার বাসায় যায় রক্তমাখা। মূসা জাদু করে নীলনদের পানি আমাদের জন্য রক্তে পরিণত করেছে। চারিদিকে তাই হাহাকার, পিপাসায় প্রাণ যায় যায়। বাধ্য হয়ে তোমার কাছে এসেছি। চলো তোমার পাত্রটি নিয়ে পানি তুলে দাও, বুকফাটা তৃষ্ণায় একটু যেন স্বস্তি পাই।

কিবতীর অনুরোধে সিবতী রাজি হয়। পানির সুরাহী নিয়ে নীল নদে যায়। পানির পাত্র হতে অর্ধেকটা পান করে বাকি অর্ধেক কিবতীকে দেয়। কিন্তু আশ্চর্য, কিবতী মুখের কাছে নিতেই সেই পানি রক্তে পরিণত হয়ে যায়। একই পানি সিবতী পান করলে সুপেয়, কিবতী মুখে নিলে রক্তবর্ণ। কিবতী প্রচণ্ড রেগে যায়। দাঁত কড়মড় করে বলে, মূসার কেমন জাদু! কিন্তু যে নিরূপায়। মেজাজ শীতল হলে সিবতীকে বলে, বন্ধু! তুমিই বলো, এই গিঁট খুলবে কীভাবে?

আই বেরা’দর! ইন গিরাহ রা’ চা’রা চীস্ত

গোফত ইন রা’ উ খোরদ কূ মুত্তাকীস্ত

হে ভাই! এই গিঁটের জট খুলবে কীভাবে

বলল, এ পানি মুত্তাকীই শুধু পান করবে।

কিবতীর প্রশ্নের উত্তরে সিবতী বলল, আল্লাহর নেয়ামত এই পানি মুত্তাকীরাই শুধু পান করতে পারবে। মুত্তাকী কারা? যারা ফেরাউনের পথ ছেড়ে, গর্ব অহংকার ক্ষমতার দম্ভ ছেড়ে মূসার পথ, আল্লাহর নবীদের দেখানো পথ অবলম্বন করে তারই মুত্তাকী, নেককার, পরহেজগার। কাজেই মুসার পথ ধর, মূসার স্বজাতির সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলো। আকাশের চাঁদের আলোতে নিজেকে মেলে ধরো, রহমতের জোসনার বন্যায় তোমার জীবন তখন হেঁসে উঠবে। হাকিকতের সূর্যের সঙ্গে সংঘাতের জেদ যতদিন পোষণ করবে, বল, ততদিন কীভাবে তোমার অন্তরের নদীতে ঈমান ও সৌভাগ্যের প্রস্রবণ প্রবাহিত হবে?

তোমার মাথায় যে বড়ত্ব অহমিকার দেমাগ কাজ করছে তা তওবার পানি দিয়ে মাগফিরাতের বারীধারায় স্নাত করো। তুমি তো মিথ্যার জালে জড়িয়ে আছ, সত্যের উদ্ভাস কীভাবে, তোমার অন্তরে আলো বিকিরণ করবে? নানা ফন্দি ফিকির ছাড়, মূসার স্বভাব ধারণ কর, নচেত সত্যকে বুঝার শক্তি তোমার হবে না।

মওলানা রুমী মসনবির যারা সমালোচনা করে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তুমি তো মসনবীর গল্প উপমার মধ্যে ঘুরপাক খাও, তার আসল হাকিকত কীভাবে তোমার বুঝে আসবে। মসনবী সেই রূপসীর মতো, যে সুন্দর সাজ পরে লোকসম্মুখে হাজির হয়েছে। সে তো পোশাকের আবরণে নিজেকে তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে। অতীতের জাতিসমূহের বর্ণনা দেখে কোরআন মজীদও ইতিহাস গ্রন্থ বলে ভ্রমের মধ্যে পতিত হয় বাহ্যদর্শীরা। এর কারণ, যতক্ষণ আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীর সংযোগ না ঘটে, কোনটা আসল, কোনটা নকল বুঝা সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে।

ওয়ার না’ পুশ্কো মুশক পীশে আখশামী

হারদো য়্যাকসা’ন আস্ত চোন নবূয়াদ শামী

বিষ্ঠা ও মেশক নিয়ে যাও নসিকান্দ্রিয়হীনের কাছে

গন্ধ শুঁকার শক্তি নাই তাই উভয় অভিন্ন মনে হবে।

যার নাসিকান্দ্রিয় বিকল হয়েছে, খুশব-গন্ধ অনুভব করে না, তার নাকের সামনে বিষ্ঠা নেয়া হোক বা মিশক আম্বর, উভয়ের মধ্যে ফারাক করতে পারবে না। নবীজির মহান সত্তার স্বরূপ দর্শনের ব্যাপারটিও অনুরূপ। যার অন্তরে সত্যের প্রতি আকর্ষণ আছে, সেই শুধু তার চেহারার হাকিকত বুঝতে পারে, তাঁর আদর্শকে আলিঙ্গন করতে পারে; যাদের অন্তর কলুষিত, নেফাকে ভরা, কুফরির রোগে আক্রান্ত আবু জাহলের মতো দাম্ভিক, নবীজির আর নবীজির আদর্শের সৌন্দর্য দেখার শক্তি তার নেই।

গোফত ইয়াযদা’ন কে তোরা হুম ইয়ানযুরূন

নকশে হাম্মাম আন্দ হুম লা য়ুবসিরূন

আল্লাহ বলেন, তারা তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে

হাম্মামের নকশা তারা, দেখতে পায় না তাই তোমাকে।

কোরআন মজীদে সে কথাই বলা হয়েছে- ‘আপনি যদি তাদের সৎপথে আহ্বান করেন তারা শুনবে না এবং আপনি দেখবেন যে, তারা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে; অথচ তারা আপনাকে দেখতে পায় না।’ হাম্মাম, গণগোসলখানা। বাজারে, রাস্তার ধারে গণগোসলখানার বাইরে দেওয়ালে ছবি আঁকা থাকত সাধারণ লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। অঙ্কিত বীরের ছবির গোটা গোটা চোখ দুটি যেন তাকিয়ে আছে দর্শনার্থীর দিকে। মওলানা রুমি (রহ.) বলেন, যারা দুনিয়াপূজারী বাহ্যদর্শী তারা হাম্মামের ছবি দেখে বলবে, চোখ দুটি জীবন্ত তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এই চেতনার অনুসারী লোকেরা মূর্তির সামনে শ্রদ্ধায় নত হয়, প্রণতি জানায়। প্রণামের জবাব দিতে প্রতীমা ঠোঁট বা মাথা নাড়ছে না, দেখে বেজায় নাখোশ হয়। এরা বাহ্যদর্শী, বাইরের আকৃতি পর্যন্ত এদের চিন্তার গতি। তাই আকৃতিকে জীবন্ত ভেবে তার সামনে মাথা ঠুকায়। আকৃতির ভেতরে যে প্রকৃত বিরাজ করে তার রহস্য এদের জানা নেই। বিশ্বাসী বান্দাও সিজদায় লুটায় আল্লাহর সমীপে। তখন বান্দার সঙ্গে আল্লাহর আলাপন হয় অন্তরের গহিন কন্দরে। মওলানা বলেন, আল্লাহ ঠোঁট নেড়ে জবাব না দিলেও তোমার ভেতরটা ভরে দেন আত্মিক প্রেরণায়। সেই প্রেরণায় প্রাণিত হয়ে শত সিজদায় নত হয়, তোমার চিন্তাবুদ্ধি ও অন্তর। তুমি যদি কোনো প্রাজ্ঞ লোকের সান্নিধ্যে যাও, বিনিময়ে তুমি কী পাবে? নিশ্চয়ই তার দোয়া বা আশীর্বাদ। তিনি তোমাকে সৎপথটিই বাতলে দিবেন। মহান ব্যক্তির আশীর্বাদ ও হেদায়তে তোমার মনপ্রাণ প্রফুল্ল হবে। এগুলো নির্বস্তুক। সিজদার বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত্ব প্রেরণায় তোমার অন্তরাত্মাও পুলকিত, বিকশিত হয়। জগতের হাজারো টানাপড়নের মধ্যে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে অবিচল থাকার শক্তি পাও। আল্লাহ সম্মতি জানিয়ে তোমার দিকে মাথা ঝুঁকান না ঠিক; কিন্তু তিনি বিনিময়ে তোমাকে বানান সবার মাথার মুকুট।

লক্ষ্য কর, পাহাড়ে খনিতে অজস্র পাথরের মাঝে কিছু পাথরে আল্লাহ খাস রহমতের দৃষ্টি দেন। তাতে মামুলি পাথরকে অমূল্য রত্নে পান্না চুন্নি, স্বর্ণ রৌপ্যে পরিণত করেন। ঝিনুকের বুকে মুক্তার বিস্তার ঘটান তিনি। দেখ, মানুষ মাটির সৃষ্টি; অথচ সেই মানুষের অন্তরে রহমতের দৃষ্টি দিয়ে প্রতীভার স্ফুরণ ঘটান। তারপর আকাশের চাঁদের মতো তাকে জগতের শীর্ষে খ্যাতিমান করেন। অথচ দুনিয়াপূজারীরা শুধু বাহ্য আকৃতিই বুঝে। আকৃতির ভেতরে লুকায়িত এসব প্রকৃতি এর সন্ধান পায় না তারা।

কিবতী বলল, হে ভাই সিবতী! আমি বুঝেছি, সত্যের পরিচয় পেয়েছি। আমি তোমার কাছে দোয়া চাই। আমার অন্তরটা কালো। তাই দোয়া করার মুখ আমার নাই। তোমার মতো লোক দোয়া করলে আমার দিলের তালা খুলে যাবে, সত্যকে গ্রহণ করার, শয়তানি চক্রের হাত থেকে চিন্তা ও মন মুক্ত হওয়ার পথ আমি খুঁজে পাব।

সিবতী তখন এক গ্লাস পানি দিল কিবতীকে নীল নদের। পান করে প্রাণ জুড়াল। মনে হল কিবতীর জীবনের যত তৃষ্ণা মিটে গেছে। এ তো পানি নয়, ঈমানের শরবত, শরাবান তাহুরা। সিবতী সিজদায় লুটিয়ে কাতর কণ্ঠে কাঁদে কিবতীর জন্য। প্রভু হে! তোমার কাছে দোয়া করার প্রেরণা তো প্রথমে তুমিই দাও। সেই দোয়া আবার তুমিই কবুল করো। কাজেই শুরু ও শেষে একমাত্র তুমিই। কিবতীর ঈমানের জন্য প্রাণান্ত দোয়ায় সিবতী আত্মহারা। একবার সম্বিত ফিরে পায় আবার হারিয়ে যায় ধ্যানের তন্মতায়। এরিমধ্যে অন্তর দুমড়ে-মুচড়ে বাঁধভাঙা কান্নায় চিৎকার দিল কিবতী, বন্ধু হে! আমার অন্তরে মূসার প্রতি ঈমানের স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমাকে মূসার কালেমা পড়াও। তুমি সিবতী নও, তুমি মানুষ নও, আমার জন্য বেহেশতের দূত। আমি গিয়েছিলাম নীলনদের পানিতে প্রাণ জুড়াতে। বেহেশতের আবেহায়াতের বান এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনন্ত সাগরে। আমি এখন এখানে আবেহায়াত পান করে মাতোয়ারা, আত্মহারা।

শরবতী খোরদম যে আল্লাহুশ তারা

তা’ বে মাহশর তিশনাগী না’য়দ মোরা

পান করেছি ‘আল্লাহ কিনে নিয়েছেন’ আবেহায়াত

কিয়ামত পর্যন্ত স্পর্শ করবে না আমায় তৃষ্ণার হাত।

হ্যাঁ, আমি সেই সাগরের সন্ধান পেয়েছি, যেখানের ব্যবসা-বাণিজ্য সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, বিনিময়ে তাদের জন্য আছে জান্নাত ...।

(সূরা তওবা, আয়াত-১১১) (সূত্র: মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩৪৩১-৩৫৪৩)।

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত