ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৪/১৯৬)

নফসে আম্মারাকে বিশ্বাস করো না

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
নফসে আম্মারাকে বিশ্বাস করো না

আল্লাহর নবী মুসা (আ.)-এর লড়াই ছিল মিশরের ক্ষমতাধর সম্রাট ফেরাউনের বিরুদ্ধে। ফেরাউনের অজস্র সৈন্য সামন্তের মোকাবিলায় মুসা (আ.)-এর ছিল দোয়ার শক্তি আর হাতের অলৌকিক লাঠি। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মুসা (আ.)-এর লাঠির কারিশমায় নীল নদের পানি তাজা রক্তে রূপান্তরিত হয়। অনাবৃষ্টিতে গবাদি পশুতে মড়ক লাগে। খেত-খামার আক্রান্ত হয় ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের আক্রমণে। ফেরাউন প্রমাদ গুনে, তার রাজত্বের আয়ু বুঝি শেষ হয়ে এলো। মাথায় তখন অন্যরকম বুদ্ধি খেলে গেল। যেভাবেই হোক মুসাকে বশে আনতে হবে। একদিন গোপনে মুসার কাছে গিয়ে ফেরাউন ধর্ণা দিল, জনাব মুসা! আমি বুঝতে পেরেছি দেশ ও দশের ওপর যে বালা মুসিবত নেমে এসেছে আপনার দোয়া ছাড়া তা থেকে নিস্তার নেই। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার সঙ্গে আমি বহু খারাপ আচরণ করেছি, আমি লজ্জিত। আমি কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আপনার অনুগত হয়ে চলব। তবে একটু সময় চাই। রাজত্ব আর মান-ইজ্জতের বিষয়টি আমার মজ্জাগত হয়ে গেছে কি না। তাই আমার অপারগতাকে আপনি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখুন। দেশের মানুষের দিকে চেয়ে আপনি দয়া করুন, দোয়া করুন।

হীন বেজুন্বা’ন লব বে রহমত আই আমীন

তা’ বেবন্দদ ইন দাহা’নে আ’তাশীন

রহমতের কামনায় দুটি ঠোঁট নাড়ুন হে বিশ্বাসভাজন

দয়া করুন, যেন বন্ধ হয় চারিদিকের আগুন এখন।

মুসা (আ.) বুঝতে পারলেন, ফেরাউন নতুন ফন্দি এঁটে আপাতত বিপদ কাটানোর কৌশল করছে। তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, প্রভুহে! ফেরাউনের কথাগুলো তুমি শুনেছ। সে চায় আমাকে প্রতারিত করবে। আমাকে তো নয়, স্বয়ং তোমাকেই ধোঁকা দেবে। প্রভুহে! আমি কি ফেরাউনের কথা মতো রহমতের বরিষণের জন্য হাত তুলব? নাকি তার প্রতারণার জবাবে পাল্টা কৌশল প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দেব যে, দুনিয়াতে যত চালাকি, কূটকৌশল হয় তার গোড়া আসমানে। আসমান থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়? কাজেই আমাকে ধোঁকা দেয়ার শক্তি তোমার নেই।

আল্লাহ বললেন, মুসা! তুমি এতবড় কাজটি করবে, ফেরাউনের মতো কুকুর তো সে ধরনের আচরণ পাওয়ার উপযুক্ত নয়। তাকে বরং দূর থেকে কয়েকখানা হাড়গোড় ছুড়ে দাও। তোমার হাতের লাঠিখানা সক্রিয় কর। মটিতে আঘাত কর, দেখবে সবকিছুর রূপ বদলে যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল মরে যাচ্ছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ জেগেছে। দুনিয়ার মানুষও বুঝতে পারবে, মহান রব্বুল আলামীন চাইলে বিশ্বপ্রকৃতিকে মুহূর্তে বদলে দিতে পারেন। এর জন্য কোনো কার্যকরণ তার প্রয়োজন হয় না। প্রমাণিত হোক,

কে সববহা নীস্ত হাজত মর মারা’

আ’ন সবব বাহরে হেজাবাস্তো গেতা’

কোনো কার্যকারণের প্রয়োজন নেই আমার, দেখুক

কার্যকারণ বাহ্যদর্শীর আড়াল ও পর্দাস্বরূপ।

কোনো কিছুর পরিবর্তন করতে আমার কোনো কারণ, উপায়-উপকরণ প্রয়োজন হয় না। বরং যারা বস্তুবাদী, বাহ্যদর্শী, বাইরের কারণ দেখে যারা সবকিছু বিচার করে, তাদের সামনে কার্যকারণ পর্দা ও আড়ালস্বরূপ। এরা কার্যকারণের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খায়। সত্যকে কদাচিৎ দেখতে পায়।

তা’ তবীয়ী খেশ বর দা’রু যনাদ

তা মুনাজ্জেম রু বে ইস্তা’রে কুনাদ

প্রকৃতিবাদী বলে ওষুধেই সারবে যত রোগশোক

জ্যোতিষী ভাবে সব বদলায় রাশিচক্রের হলে যোগ।

যারা প্রকৃতিবাদী, অতিপ্রাকৃতিক কোনো কিছুতে যারা বিশ্বাস করে না, তারা রোগ হলে কেবল ওষুধ ও চিকিৎসায় বিশ্বাস করে। দৃশ্যমান উপকরণের বাইরে আল্লাহর ইচ্ছার বা শেফা দানের মালিক আল্লাহ- একথা বিশ্বাস করে না। একইভাবে যারা জ্যোতিষী, তারা মনে করে গ্রহতারার পরিক্রমণের প্রভাবে রাশিচক্রের কারিশমায় সবকিছু হচ্ছে, এই প্রকৃতি চলছে। মোনাফিকদের অবস্থাও অনুরূপ। তারা আল্লাহর রহমত ও সাহায্য হলে ভাগ্য বদলে যেতে পারে- এ কথা বিশ্বাস করে না, তাই দৌড় দেয় দোকানে। মনে করে, আমার পরিশ্রম ও চেষ্টাই আমার জন্য সাফল্য বয়ে আনবে।

একই বয়েসি সমান মেধার দুই বন্ধু পাশাপাশি ব্যবসা করে সমান পূঁজি খাটিয়ে। প্রত্যেকের আশা ব্যবসায় মুনাফা। ক্ষতি কেউ চায় না। কিন্তু দেখা যায়, একজন বিরাট ধনী হয়ে গেল, আরেকজনের ব্যবসা মার খেল। সবকিছু প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন হলে উভয় বন্ধু সমান ধনী হওয়ার কথা ছিল। কাজেই প্রাকৃতিক নিয়মের অন্তরালে একজন স্রষ্টা ও নিয়ন্তার অস্তিত্ব মানতে হবে। প্রকৃতিবাদীরা মোনাফিকরা এই দর্শন মানে না। তাই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার গরজ তারা অনুভব করে না, ইবাদত বন্দেগিতে মন বসে না। এর পরিবর্তে ধ্যানে মনে লেগে যায় দুনিয়া কামানোর ধান্ধায়। অথচ জীবনকে সফল ও সুন্দর করতে হলে আত্মিক পরিশুদ্ধি আর আল্লাহর রহমতের সংযোগ অবশ্যই লাভ করতে হবে। মওলানা অন্যত্র বলেন,

রূয় না শুসতে নবীনদ রূয়ে হূর

লা সালাতা গোফত ইল্লা বিত তুহুর

আধোয়া মুখে দেখতে পাবে না হুরের চেহারা

বলা হয়েছে নামাজ শুদ্ধ হবে না পবিত্রতা ছাড়া।

সাধারণত লোকেরা কেবল খাওয়া ও ভোগের চিন্তায় থাকে। এদের অবস্থা চারণভূমির খাসির মতো।

এক ছাগলছানা তার মাকে বলে, মা! আমরা না এই বাড়িতে অনেকদিন থেকে আছি? আমাদের তো কোনো আদর যত্ন নেই। অথচ গতকাল বাজার থেকে যে খাসি এনেছে তার কত আদর কদর। বাড়িওয়ালী ভাতের মাড় এনে তাকে দিয়েছে সকালে। অফিসে যাওয়ার সময় বাড়িওয়ালা তার গায়ে হাত বুলিয়ে গেছে। দেখ, বাড়িওয়ালার ছেলে তাকে সবুজ ঘাসের চারণভূমিতে রেখে এসেছে? মা-ছাগল সান্ত¡না দেয়, বাচ্চা! সবুর কর, সামনের শনিবার তুমি বুঝতে পারবে। - কেন মা, কীভাবে? শুক্রবার বাড়িওয়ালার ছেলের খতনা অনুষ্ঠান, সেদিনের যেয়াফতের জন্যই তো এই খাসি আর তার এত আদর কদর।

যারা ভোগের রাজ্যে বেসামাল, তাদের পরিণতিও হবে এমন।

আমাদের সময়েও যে ডায়াবেটিকস রোগী লাগাতার মিষ্টান্ন খায় তার পরিণতি কী হবে তা তো জানাই। অনুরূপ যারা হারাম হালাল যাচাই-বাছাই করে না, ‘দুনিয়া কা মজা লে লও দুনিয়া তোমারী হ্যায়’ - যাদের জীবন দর্শন, তাদের পরিণতি কোথায়? ‘যারা কুফরি করে তারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে এবং জন্তু জানোয়ারের মতো উদরপূর্তি করে; আর জাহান্নামই ওদের নিবাস।’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত-১২)।

মওলানা রুমির উপদেশ হলো,

কা’রে খোদ কুন রূযীয়ে হেকমত বেচার

তা শওয়াদ ফরবে দিলে বা’ কররো ফার

নিজের কাজ কর, হেকমতের আহার যোগাড় কর

কলব যাতে হৃষ্টপুষ্ট হয় তার জন্য চেষ্টা সাধনা কর।

যে কাজের জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার সঞ্চয় গড়ার চেষ্টা কর, নিজের কাজ নিজে কর। আত্মাকে পুষ্ট ও বিকশিত করাই যেন তোমার জীবনের লক্ষ্য হয়। কেননা, দেহের খাবার ভুরিভোজ, ভোগ বিলাসিতার অতিরিক্ত মেদচর্বি তোমার আত্মিক খাবারের প্রতিবন্ধক।

তুমি নিজের পরিচয় জানার চেষ্টা কর। তুমি বলতে কী? তোমার চিন্তা, হুঁশ-জ্ঞান ও বুদ্ধি বিবেকই তুমি। এ ছাড়া বাকি সব খোলস।

কে তো আন হুশিই ও বাকী হুশপুশ

খেশতন রা গুম মকুন ইয়াওয়ে মকূশ

তুমি হলে তোমার হুশজ্ঞান, বাকি সব বাকল ছাল

নিজেকে হারিয়ে দিও না অনর্থক দৌড়ঝাঁপ।

তুমি মানুষ। তুমি বলতে কি তোমার হাত-পা চোখ কান বা অন্যকিছু? নাহ। তোমার চিন্তা, চেতনা ও হুঁশটাই তুমি। হাত-পা দেহ কাঠামো তোমার ‘তুমি’র ওপর আচ্ছাদন। আচ্ছাদনকে পুষ্ট করার জন্য তোমার সকল সাধনা নিয়োগ করো না। মনে রেখো সব ধরনের কামনার বস্তু আফিমতুল্য, যা তোমার হুঁশজ্ঞান রহিত করে। কেবল মাদকই হুঁশজ্ঞান রহিত করে না; যে কোনো কামনার বস্তুই তোমার চোখণ্ডকান বন্ধ করে দিতে পারে। ইবলিসকে দেখ, সে তো মদ খায়নি; কিন্তু মদের চেয়ে জঘন্য অহমিকা ও সত্যের বিরোধিতায় আক্রান্ত হয়েছিল। ফেরাউনও ছিল অহংকারে শক্তিমদমত্ত।

আল্লাহ বললেন, এই খাসিকে আমি অবকাশ দিতে চাই। পরে জাহান্নাম হবে তার ঠিকানা। আল্লাহর হুকুম পেয়ে মুসা (আ.) দোয়া করলেন, লাঠির কারিশমায় চারিদিকে সবুজের সমারোহ দেখা দিল। তাতে ফেরাউন, তার স্বজাতি লোক লস্কর, এমনকি গবাদি পশুরাও হৃষ্টপুষ্ট হলো। সুখের মাঝে আত্মহারা ফেরাউন মুসার কাছে আগের মিনতির কথা ভুলে গেল। মানুষের অবস্থাও একই রকম।

‘বস্তুত মানুষ তো সীমালঙ্ঘন করেই থাকে, কারণ সে নিজকে অভাবমুক্ত মনে করে।’ (সুরা আলাক : আয়াত-৬, ৭)।

নফস ফেরআউনীস্ত হান সীরাশ মাকুন

তা নয়া’রদ য়াদে আ’ন কুফরে কুহান

নফস সে ফেরাউন পরিতৃপ্ত করো না তাকে

আগের কুফরিতে লিপ্ত না হয় পুনরায় সে যাতে।

নিজকে পরিতৃপ্ত অভাবমুক্ত মনে করলেই নফস অবাধ্য হয়ে যাবে। যতক্ষণ কৃচ্ছ্রসাধন, ইবাদত বন্দেগির কষাঘাত না করবে, ততদিন নফসে আম্মারা তোমার বশীভূত থাকবে না। লোহাকে যখন আগুনের ভাটিতে লাল করা হয়, তখন পিটিয়ে সোজা করা যায়। দেহের ওপরও ক্ষুধা, কৃচ্ছ্রের বোঝা না চাপালে সত্যের পথে চালানো দায়। যদি দেখ, নফসে আম্মারা কেঁদে যারযার, তবুও তাকে বিশ্বাস করো না, সে মুসলমান হবে না। সে ফেরাউনের মতো। মুসার সামনে এলে কাচুমাচু করে, অভাবমুক্ত মনে করলে অবাধ্য হয়ে ইশ্বরত্ব দাবি করে। প্রবাদ আছে ‘বোঝা নামালেই গাধা লাফ দেয়’। কাজেই এক মুহূর্তের জন্যও নফসকে আশকারা দিতে নেই। প্রতি মুহূর্তে তার ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই।

(সূত্র: মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৩৫৯০-৩৬৩৬)

মসনবি শরিফের গল্পভিত্তিক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদীর আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন CHAYAPATH PROKASHONI

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত