ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এলজিবিটির পাপ থেকে বাঁচুন

জাহিদ হাসান সিফাত
এলজিবিটির পাপ থেকে বাঁচুন

‘তাদেরকে আমি আদেশ করব যাতে তারা জীবজন্তুর কান ফোঁড়ে এবং আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি ঘটায়’। (সুরা নিসা:১১৯)। ‘তোমরা তো কামবশত মহিলাদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন কর, বরং তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। (সুরা আরাফ:৮১)। কোরআনের আয়াত দুটির বাস্তবতা আমাদের সামনে দৃশ্যমান। পশ্চিমা এলজিবিটি আন্দোলন এই বাস্তবতারই প্রতিনিধিত্ব করছে।

এলজবিটির স্বরূপ : এলজিবিটি একটি আন্দোলন। এ আন্দোলনকে বুঝতে হলে প্রথমে এর স্বরূপ বুঝা প্রয়োজন। এলজিবিটি এর পূর্ণরূপ লেসবিয়ান (নারীসমকামিতা) গে (পুরুষ সমকামিতা) বাইসেক্সুয়াল (উভকাম) ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরকামী)। সবগুলোই একটি করে স্বতন্ত্র আন্দোলন। সার্বিকভাবে আন্দোলনটির ভিত্তি হলো যৌন স্বাধীনতা। তাদের ভাষায় যৌন বৈচিত্র্যতা। আন্দোলনটির প্রকাশ্য দাবি হলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের অবাধ যৌনাচারের সুযোগ করে দিতে হবে। তারা যেভাবে এবং যার সাথে ইচ্ছা তাদের কামবাসনা পূর্ণ করবে। এক্ষেত্রে কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। সুতরাং আমরা এলজিবিটির শাব্দিক বিশ্লেষণ থেকে এই ফলাফলে পৌঁছলাম যে এলজিবিটি হলো একটি যৌনতার আন্দোলন। যেখানে তারা চায় অবাধ যৌনাচার। থাকবে না কোনো সীমাবদ্ধতা।

এলজিবিটির ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ : ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকায় প্রকাশ্যে সমকামিতার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা হয়। যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল যৌন বিপ্লব। আন্দোলনটি তখন অতটা সফলতার মুখ না দেখলেও ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এর সময়ে এসে সেটি তার যৌবন খুঁজে পায়। এই সময় তারা সমকামিতার সাথে যুক্ত করে ট্রান্সজেন্ডার। তাই তাদের আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় ‘এলজিবিটি’। তখন আন্দোলনটির সফলতার নেপথ্যে খলনায়ক ছিল দুজন ভার্জিনিয়ান ডাক্তার। মার্শাল কার্ক এবং হান্টার ম্যাডসেন। তারা সমকামীদের সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত হিসেবে সমাজের কাছে তুলে ধরে সমাজের সহমর্মিতা অর্জনের কৌশল গ্রহণ করে। এসব বিষয়ে তারা মিডিয়াকে পূর্ণ কাজে লাগায় এবং আন্দোলনটিকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে। এসব করার জন্য তাদের ফান্ডিং জোগাতো এইডস নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিওগুলো। ফলে মানুষ আস্তে আস্তে তাদের প্রতি সহমর্মী হয়ে ওঠে। যার সুবাদে দৃঢ় হতে থাকে তাদের অবস্থান। এই ধারাবাহিকতায় ‘এলজিবিটি’ কর্মীরা তাদের কর্মদক্ষতা এবং ক্রমাগত কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় এতটা তৎপর হয়ে ওঠে যে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় ৩৪টি রাষ্ট্রে তারা বৈধতা পেয়ে যায়, এমনকি বর্তমানে একাধিক রাষ্ট্রে বৈধতার প্রক্রিয়া চলমান। বিশেষত বাংলাদেশে তাদের কর্মতৎপরতা ছিল রীতিমতো অবাক করার মতো।

বাংলাদেশে ‘এলজিবিটি’ : বাংলাদেশ সেই সমস্ত দেশগুলোর অন্যতম যারা সামাজিকভাবে এলজিবিটিকে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করে। তাই এখানে তাদের কর্মপদ্ধতি ছিল কিছুটা অভিনব। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এটি নিয়ে কাজ করতে উদ্ধত হয় ভারতের পশ্চিমা এজেন্ট শিবানন্দ দাশ। নব্বই দশকের শুরুর দিকে সারাবিশ্বে এইডস একটি মহামারির আকার ধারণ করলে এটাকে সে সমকামিতা প্রতিষ্ঠার অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে তখন বাংলাদেশ সফর করে এবং এইডস রোগে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার নামে বিভিন্ন সংগঠন ও এনজিও চালু করে। তার মধ্যে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি। সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তারা এদেশের সমকামীদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং তাদের বিভিন্ন মিলায়তন কেন্দ্রে জড়ো করতে থাকে। বিভিন্ন সময় তারা এদের নিয়ে ওয়ার্কশপ ও কর্মশালারও আয়োজন করে। এইডস এর ঝুঁকি এড়ানোর জন্য বিনামূল্যে কনডম বিতরণ করে। এভাবে দশ বছর এইডস প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবার নামে তাদের কার্যক্রম চলতে থাকে।

২০০৬-৭ সালে এসে তাদের কর্মপদ্ধতি পাল্টে যায়। তারা স্বাস্থ্যসেবা থেকে চলে আসে যৌনাধিকারের ব্যানারে। সমকামিতাকে ন্যাচারাল হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। তখন তাদের সাথে যোগ দেয় ব্র্যাক। ব্র্যাক এসে কাজগুলো আরো বেগবান করে। তারা রিসার্চের নামে প্রকাশ্যে কর্মশালা চালু করে এবং তাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে নানাভাবে প্রচারণা চালায়। তবে তখনো তারা তেমন প্রকাশ্যে কিছু করার সাহস করেনি। ২০০৮ সালে আগুনে ঘি ঢালে ‘বয়েস অফ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন। তারা প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এলজিবিটির প্রতীক রংধনু পতাকা টানিয়ে ধানমন্ডির জার্মান ইন্সটিটিউটের ছাদের ক্যাফেতে অনুষ্ঠান করে। আর চালাতে থাকে প্রকাশ্য প্রচারণা। এভাবে ২০১৫ পর্যন্ত ঢাকা, কক্সবাজার ও মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডিজে পার্টি এবং কর্মশালার মাধ্যমে তাদের কাজ চলমান থাকে। ২০১৫ সালে সর্বপ্রথম তারা সমকামিতার জন্য রাষ্ট্রীয় অধিকার দাবি করে। তখন তারা বয়েস অফ বাংলাদেশের মাধ্যমে জাতিসংঘে বাংলাদেশে সমকামিতার অধিকারের দাবি তোলে। এই সময় তারা নতুন করে যুক্ত করে ট্রান্সজেন্ডার। জাতিসংঘ তখন তাদের কথামতো বাংলাদেশের আইনের ৩৭৭ ধারা বাতিল করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তা নাকচ করে দেয়। ফলে তারা আন্দোলনের রূপ কিছুটা পালটে দেয়। দাবি তুলতে থাকে ইন্টারসেক্স বা হিজড়াদের অধিকার নিয়ে, কিন্তু তাদের কাছে হিজড়া বলতে শুধু জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ছিল না। বরং তারা ট্রান্সজেন্ডারকেও হিজড়া নাম দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে তারা অনেকটা অগ্রসর হলেও ২০১৫ সালের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি চাকরিতে হিজড়াদের কোটায় ১৩ জন ট্রান্সজেন্ডার ধরা পড়ে। যার ফলে তাদের এই চেষ্টা কিছুটা ব্যাহত হয়। তবে পুরোপুরি ম্লান হয়নি। এই পুরো সময়জুড়ে তারা মিডিয়াকে খুব জোর দিয়ে কাজে লাগায়। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি কিছু সাংবাদিকদের টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়। যারা নাটক, সিনেমা, গল্প এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এটিকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে। এবং সামাজিকীকরণের পূর্ণ প্রচেষ্টা করে। এতে তারা একটা মাত্রায় সফলও হয়। সমাজের একটা সুশীল শ্রেণিকে তারা ভাগে আনতে সক্ষম হয়। ফলে তারা দিনে দিনে সরকারিভাবে দারুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এমনকি ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতা নিয়ে একটি আইনের খসড়াও তৈরি করে। যার ফলে ২০১৯ সাল থেকে ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় ২০২২, ২৩ ও ২৪ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যপুস্তকে বিকৃত যৌনতা ও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলাফল স্বরূপ আমাদের আগামীর প্রজন্মের কাছে বিষয়টি ন্যাচারাল হতে থাকে। আর হতে থাকে বিকৃতি ও অশ্লীলতার বিশ্বায়ন।

তৃতীয় বিশ্বে এলজিবিটি : এলজিবিটি আন্দোলন পুঁজিবাদের পুঁজি কামানোর একটি বড় মাধ্যম। কারণ এলজিবিটির ফলে নিশ্চিত এইডস মহামারীসহ নানা রোগ ছড়াবে। ফলে চিকিৎসার জন্য আমাদের যেতে হবে পুঁজিপতিদের কাছে। খরচ করতে হবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। ফলে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থায় শোচনীয়। অন্যদিকে এটাকে কাজে লাগিয়ে প্রথম বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বকে সর্বোচ্চ শাসন ও শোষণ করতে থাকবে। কারণ যখন কোনো জাতির মাঝে অবাধ যৌনাচার ছড়িয়ে পড়ে তখন তাদের মেধা ও কর্মক্ষমতা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ফলে খুব সহজেই মানুষকে শাসন ও শোষণ করা যায়।

ইসলামে এলজিবিটি : এলজিবিটি আন্দোলনের ভিত্তিই হলো যৌনতা এবং যৌন বৈচিত্র্যতা। যা তাদের প্রকাশ্য স্লোগান। এলজিবিটির প্রথম তিনটি অংশের (এল/জি/বি) অর্থ হলো সমকামিতা এবং উভকামিতা। যা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তো কামবশত মহিলাদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন কর, বরং তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। (সুরা আরাফ:৮১)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। কেননা তা হলো চরম অশ্লীলতা’। চতুর্থ অংশটি হলো ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ জেন্ডার বা লিঙ্গ পরিবর্তন। ছেলেকে মেয়ে বানানো এবং মেয়েকে ছেলে বানানো। যা সম্পূর্ণ সৃষ্টির বিকৃতি। এটিও হারাম এবং মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহতায়ালা কোরআনে শয়তানের দম্ভপূর্ণ অভিসার ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তুলে ধরে বলেন, ‘তাদেরকে আমি আদেশ করব। ফলে তারা জীবজন্তুর কান ফুঁড়বে এবং আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি ঘটাবে’ (সুরা নিসা:১১৯)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ নারীদের মতো সাদৃশ্য রাখা পুরুষদের এবং পুরুষের মতো চলাচলনকারী নারীদের অভিশাপ দেন’। যৌনতার ব্যাপারে ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ বৈধ বিয়ের সম্পর্ক ছাড়া নারী পুরুষ কেউ কাউকে ভোগ করতে পারবে না। কোনো পুরুষ নিজ স্ত্রী বা দাসী (দাসী বর্তমানে লুপ্ত) ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করা হারাম। নারী নারীকে বা পুরুষ পুরুষকে বিয়ে করা পাপ। সমকামিতা নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত আচরণ, যা ঐতিহাসিকভাবে ধ্বংসাত্মক পাপ হিসেবে প্রমাণিত।

সামাজিক দৃষ্টিতে এলজিবিটি : এলজিবিটি আন্দোলন সমাজের দৃষ্টিতেও ব্যাপক ভয়াবহ। সামাজিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার জন্য এই একটি মতবাদই যথেষ্ট। এটির ফলে সমাজে এইডস মহামারিসহ নানা রোগ ছড়াতে পারে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনরা বিকৃত যৌনতায় লিপ্ত হবে। কিন্তু বাধা দেওয়ার অধিকার আমাদের থাকবে না। অন্যদিকে অবাধ যৌনতার ফলে সামাজের নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাবে এবং পরিবার ব্যবস্থার কাঠামো একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। যা আমরা পশ্চিমা বিশ্বে সচরাচর দেখতে পাচ্ছি। তাই বিকৃত যৌনতানির্ভর যাবতীয় কাজকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে সবাইকে। পরিশেষে আমরা এই ফলাফলে দাঁড়াতে পারি যে, এলজিবিটি আন্দোলন আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্য নৈতিক, আর্থিক ও ধর্মীয় সর্বদিক থেকে ক্ষতিকর। আন্দোলনটির সফলতা মানে হলো আগামীর বিশ্ব হবে যৌনতা ও অশ্লীলতার বিশ্ব। তাই সতর্কতাস্বরূপ বলা যায়, দেশের সচেতন নাগরিকদের এলজিবিটি থেকে দূরে থেকে পাপমুক্ত জীবন গড়তে হবে এবং সমকামিতাসহ এ জাতীয় বিকৃত সংস্কৃতি রোধ করে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ নিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত