ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফেসবুকের পাপ থেকে বাঁচি

মুফতি শাহাদাত হোসাইন
ফেসবুকের পাপ থেকে বাঁচি

ফেসবুক একটি বহুল প্রচারিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানুষের যোগাযোগের নিমিত্তে তৈরিকৃত হলেও বর্তমান তা সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। বরং নিত্যনতুন বিনোদনের ফিচার তাতে যোগ করছে অনন্য মাত্রা। যা ব্যবহারকারীদের ডোবাচ্ছে পাপের সাগরে।

ফেসবুক এমন একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে মানুষের উপকারের তুলনায় অপকার হচ্ছে ঢের বেশি। এর মাধ্যমে মানুষ নিজের অজান্তে ও অনিচ্ছায় জানা-অজানা নানান পাপে জড়িয়ে পড়ছে। মনে রাখবেন, পাপ একটি অভিশপ্ত বিষয়। যা পাপীকে অভিশপ্ত বানানোর মাধ্যমে তার দুনিয়া আখেরাত বিনষ্ট করে। ফেসবুক ব্যবহারে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। যাতে করে তা আমাদের ধ্বংসের কারণ না হয়। আসুন, ফেসবুকের পাপ সম্পর্কে জানি এবং তা হতে সাবধান হই।

পাপ সব অনিষ্টের মূল : পাপ দুনিয়ার সব অনিষ্টের মূল। পাপ মানুষের সব বিপদাপদের জন্য একমাত্র দায়ী। মানুষের উচিত সব প্রকারের পাপ, পাপের উপকরণ ও মাধ্যম থেকে বিরত থাকা। কোরআনে এসেছে, আর তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে তা তোমাদের হাত যা অর্জন (পাপ) করেছে তার কারণে এবং অনেক অপরাধ-পাপ তিনি ক্ষমা করেন (সুরা শুরা : ৩০)। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, আদম সন্তান কাটার আঘাতপ্রাপ্ত হয় না কিংবা পায়ে হোঁচট খায় না, তবে সেগুলো হয় তার পাপের কারণে (তারিখে দেমাশক ২৪ : ১৯০)। ফেসবুক এমন অনেকগুলো গোনাহের আখড়ায় পরিণত হয়েছে, যার একেকটি ব্যক্তির আখেরাত নষ্টের জন্য যথেষ্ট। ফেসবুক মানুষকে এমন সব গোনাহে লিপ্ত করায়, যা ফেসবুক ব্যবহার না করলে মানুষ কখনোই করত না।

অতি মূল্যবান সময় নষ্ট : সময়ের সমষ্টিই জীবন। আর ফেসবুক একজন ব্যক্তির জীবনের অতি মূল্যবান সময় নষ্ট করার মাধ্যমে জীবন নষ্ট করে। ফেইসবুকের স্ক্রলিং মানুষের মধ্যে মাদকের মতো কাজ করে। যার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় নিমিষেই। জীবন থেকে মূল্যবান সময়গুলো অবহেলায় অবমূল্যায়ণে হারিয়ে যাচ্ছে, ফেসবুক আসক্তির কারণে।

আল্লাহতায়ালা সুরা আসরে মানবজাতির ক্ষতিগ্রস্ততার কথা বলার সময় যুগ-সময়ের শপথ করেছেন। যার থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানুষের জীবনে সময়ের মূল্য কত? নবীজি যথাযথ বলেছেন, দু’টি নেয়ামতের ব্যাপারে মানুষ বড্ড উদাসীন, সুস্থতা এবং অবসরতা (বোখারি : ৬৪১২)। ফেসবুক সময়ের প্রতি আমাদের উদাসীনতাকে আরো বাড়িয়েছে। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) পাঁচটি বিষয়ের সম্মুখীন হওয়ার আগেই পাঁচটি বিষয়ের মূল্যায়ন করতে বলেছেন। যার অন্যতম হলো, ব্যস্ততার আগে অবসরতাকে মূল্যায়ন করা (সহিহুল জামে : ১০৭৭)। ফেইসবুকে অনর্থক সময় অপচয়রোধ কল্পে আমাদের আজই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

গিবত ও পরনিন্দা চর্চার আখড়া : ফেসবুক গিবত ও পরনিন্দা চর্চার স্বর্গরাজ্য। যেখানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭-৮ ঘণ্টা বিরতিহীন গিবত ও পরনিন্দা চর্চার মতো গর্হিত কাজ হয়ে থাকে। পরনিন্দা যে একটি পাপের কাজ ফেসবুকিয়ানরা তা হতে সম্পূর্ণ বেমালুম। পরনিন্দা-গিবত এমন একটি ঘৃণিত কাজ যা করা, শোনা ও তার থেকে মজা নেওয়া সবই পাপ। অনেকেই অন্যের অনুমতি না নিয়ে বা অন্যের সম্পর্কে না জেনেই তার সম্পর্কে লিখছেন। যা ক্ষেত্রবিশেষে গিবত বা অপবাদের মধ্যে পড়ে। অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলার লোকের অভাব নেই এখানে। যা ইসলামে গুরুতর অপরাধ। আর অন্যরা সেখানে কমেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মজা নিচ্ছেন। এটাও অনুচিত।

রুচিশীল মানুষ যার তার বিষয়ে যে কোনো মন্তব্য করতে পারে না। কোরআনে এসেছে, হে ঈমানদাররা! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক, কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান কর না এবং অন্যের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর (সুরা হুজুরাত : ১২)। মোমেন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হলো, তারা গিবত, অনর্থক কথা ইত্যাদি শুনলে সেখান থেকে চলে যাবে। আল্লাহ বলেছেন, তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে, তখন যেন তা উপেক্ষা করে (সুরা কাসাস : ৫৫)। ফেসবুকের বদৌলতে গিবত করা, শোনা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। কিছু মানুষ নিশ্চিন্ত মনে গিবত করে যাচ্ছে। আর কিছু মানুষ শুনে যাচ্ছে। একবার ভাবছেও না যে, তার দ্বারা একটি বড় গোনাহ হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই ফেসবুক আমাদের দিয়ে পাপ করাচ্ছে।

পর্দার বিধান লঙ্ঘনের উন্মুক্ত ময়দান : ফেসবুক পর্দার বিধান লঙ্ঘনের উন্মুক্ত ময়দানে পরিণত হয়েছে। অথচ পর্দা আল্লাহতায়ালার শাশ্বত ফরজ বিধান। প্রতিটি নর-নারীর উচিত আল্লাহর বিধান মেনে চলা। নারী-পুরুষ সবার জন্য পর্দার প্রতিবিধান সমভাবে প্রযোজ্য। সুরা নুরের ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, মোমেন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং লজ্জা স্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে খুব পবিত্রতা। ঈমানদার নারীদের বলুন, তারাও যেন তাদের দৃষ্টি অবনত করে, লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং নিজেদের দেহের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। আর তারা যেন মাথার কাপড় দ্বারা বুক ঢেকে রাখে। পরিতাপের বিষয়, কোনো প্রকারের রাখণ্ডঢাক ছাড়াই মেয়েরা ফেসবুকে নিজেদের ছবি, পিকচার আপলোড দিচ্ছে। স্বামীরা নিজ বউদের ছবি আপলোড করছে। আর সেই ছবিতে ছেলেরা হুমড়ি খেয়ে লাইক, কমেন্ট, রিয়েক্ট ইত্যাদি করছে। ফেসবুকের বদৌলতে নারী-পুরুষ সবাই পর্দার বিধানকে লঙ্ঘন করছে এবং সেটাকে খুব সাধারণ ভাবে নেওয়া হচ্ছে। আমরা পাপ করছি’ কিন্তু পাপকে পাপ মনে করছি না। যা আমাদের ঈমান এবং সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। মেয়েরা নিজেদের ছবি আপলোড করে পর্দাহীন হচ্ছে। আর স্বামীরা নিজের বউদের ছবি আপলোড করে দাইয়ূছ হচ্ছে। নবীর ভাষ্যমতে, যে পুরুষ তার স্ত্রীকে পর্দায় রাখে না, সে জান্নাতে যাবে না। কাজেই ফেসবুকে ছবি আপলোড করার ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে ফেসবুকীয় এমন পাপ থেকে বেঁচে থাকার হিম্মত দান করুন।

অপরিণামদর্শী মন্তব্যের আঁতুড়ঘর : একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ হলো, প্রতিটি কথা, কাজ ও মন্তব্য ভেবে চিন্তে করা। যাতে করে সেই কথা বা মন্তব্যের জেরে তাকে ফেঁসে যেতে না হয়। ফেসবুকে প্রায় প্রতিটি মানুষেই অপরিণামদর্শী মন্তব্যে পটু। এ সব অপরিণামদর্শী মন্তব্যের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ওপর বিপদ ডেকে আনে। অন্যকেও সমস্যায় ফেলে। কথায় আছে, নিজের জন্য মরে বান্দা আল্লাহক দেয় দোষ। অপরিণামদর্শী মন্তব্যের দ্বারা ব্যক্তি নিজের মরণ ফাঁদ নিজেই তৈরি করে। পরে আবার পস্তাতে থাকে। তাই পস্তাতে না চাইলে এখনই সাবধান হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রতিটি কথা কাজ আমল এবং এর প্রতিটির হিসাব আল্লাহতায়ালার দরবারে দিতে হবে।

আবেগ ও হতাশা প্রকাশের আড্ডাখানা : আবেগ, ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা, হতাশা আর হতোদ্যমতা ইত্যাদি নিয়েই আমাদের জীবন। এগুলোকে পরিমাপিত আকারে প্রকাশ করা বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তির কাজ। যথায়-তথায় অনিয়ন্ত্রিত আবেগ-হতাশা প্রাকশ করা কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ নয়। এর কারণে ব্যক্তি প্রকারন্তরে নিজেরই ক্ষতি করে।

আশাহত হওয়া মোমেন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য নয়। যেমনটা আল্লাহতায়ালা বলেছেন, বলুন, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না (সুরা যুমার : ৫৩)। মাত্রাতিরিক্ত আবেগ কিংবা হতাশা দুটিই ব্যক্তির দুনিয়া আখেরাত এবং ঈমান আমলের জন্য ক্ষতিকারক। পাপের কাজ। যা থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। ফেসবুকের অনিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রকাশ আপনাকে যে কোনো মুহূর্তে বিপদে ফেলতে পারে।

ব্যক্তি জীবনে কাজের ব্যাঘাত : ফেসবুকে অধিক মত্ততা ব্যক্তি জীবনে কাজের ব্যাঘাত ঘটায় যা অনস্বীকার্য। কাজের মাধ্যমেই ব্যক্তি সফলতা ও কামিয়াবির শীর্ষ চূড়ায় আরোহিত হয়। আল্লাহতায়ালার নেজাম হলো, যে কাজ করবে সে পাবে।

হোক সে মুসলিম কিংবা কাফের। ফেসবুক আমাদের কর্মবিমুখ করে রেখেছে। ফেসবুকের স্ক্রলিং আমাদের জীবনের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় খেয়ে ফেলছে। যা আমাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। অনেক কাজ যথা সময়ে হচ্ছে না, অসমাপ্ত থেকে যাচ্ছে। যার কারণে আমরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। এমনটি চলতে থাকলে জাতি হিসাবে আমরা অনেকটা পিছিয়ে যাব। পৃথিবীর কোনো উন্নত জাতিই ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিকমাধ্যমে এতটা সময় দেয় না, আমরা ফেসবুকে যতটা সময় দেই। ব্যক্তিগত কাজে বিঘ্নতা এড়াতে ফেসবুক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনা খুব দরকার।

রুচি ও ভাষার ক্ষতি : কথায় আছে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। ফেসবুকে নানান প্রকারের মানুষের নানান রুচি। তবে খারাপ রুচির লোকদের আনাগোনাই বেশি। তাদের কথার রং ঢংও আলাদা। যা একজন মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলার সমূহ সম্ভবনা রাখে।

কারণ মানুষ পড়ার থেকেও অধিক শিখে দেখে ও শুনে। রুচি ও ভাষার ক্ষতি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে ফেসবুক পরিত্যাগ করার বিকল্প নেই। আর যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। ফেসবুকীয় শ্রোতে গা ভাসিয়ে যেন নিজের রুচিবোধ ও ভাষার বিসর্জন না দিই। ফেসবুকের রিলস আজকাল খুবই বাজেভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। এক মিনিটের ভিডিও সুস্থ চিন্তাচেতনা ও রুচিবোধকে নষ্ট করে দিচ্ছে। উলঙ্গপনা ও যৌনতাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই যথাসম্ভব ফেসবুক থেকে দূরে থাকা উচিত। একান্তই যদি ব্যবহার করতে হয় তাহলে রুচিশীল, সভ্য ও চরিত্রবান লোকদের সঙ্গে স্বল্প পরিসরের যোগাযোগ থাকতে পারে। এর অন্যথা বিপদ ও পাপমুক্ত নয়।

লেখক : খতিব-বায়তুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত